চলতি জুনের প্রথম সপ্তাহে দুটি ঘটনা ঘটেছে। এর একটি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ভারতের বিদেশনীতিকে সামনে এনেছে। আরেকটি দেশটিতে ক্রমাগত বাড়তে থাকা বিষাক্ত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে সৃষ্ট চোরা খানাখন্দকে দেখিয়ে দিয়েছে।
স্লোভাকিয়ার ব্রাতিস্লাভাতে অনুষ্ঠিত গ্লোবসেক ২০২২ ফোরামে যোগদানের এক ফাঁকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সেখানে ইউক্রেন যুদ্ধসংক্রান্ত একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছেন, তাতে ভারতীয় বিদেশনীতির পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত হয়েছে। জয়শঙ্করের প্রতিক্রিয়া এত জোরালোভাবে অনুরণিত হয়েছে যে এটি কেবল ভারতে নয়, ইউরোপ এবং অন্যান্য অনেক দেশেও তাঁর বক্তব্য অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় ভাইরাল হয়েছে।
ইরানি এবং আরবরা তাদের নিজস্ব ভাষায় সাবটাইটেল করা ওই সাক্ষাৎকারের ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চালাচালি করেছে। কিছু আন্তর্জাতিক ভাষ্যকার রসিকতার সুরে এটিকে ‘ভারতের সাবালকত্বের মুহূর্ত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাক্ষাৎকারটিতে ইউক্রেন যুদ্ধে ভারত কেন কোনো পক্ষ বেছে নিল না, সে বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমা দেশগুলো ও তাদের মিত্ররা রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের নিন্দা করলেও ভারত তা করতে অস্বীকার করেছে। একই সময়ে ভারত ইউক্রেনে মানবিক সাহায্য পাঠিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অটুট রাখতেও চাইছে।
ওই সাক্ষাৎকারে জয়শঙ্কর খুব দৃঢ় ভাষায় ইউক্রেন সংঘাত সম্পর্কে ইউরোপীয়দের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে অন্য দেশগুলোর ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করা উচিত বলে ইউরোপীয় নেতারা যে ধারণা করে থাকেন, তা থেকে তাঁদের বেরিয়ে আসা উচিত। জয়শঙ্কর বলেছেন, ‘ইউরোপের নেতারা তাঁদের সমস্যাকে সারা বিশ্বের সমস্যা বলে ভেবে থাকেন। কিন্তু তাঁদের এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ, আজকের বাস্তবতা হলো, ইউরোপের সমস্যা ইউরোপের কাছে, বাকি বিশ্বের সমস্যা বাকি বিশ্বের কাছে। বিশ্ব এখন আর আগের মতো ইউরোপকেন্দ্রিক নয়।’
ভারত দীর্ঘকাল ধরে মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণে সংবেদনশীল হিসেবে পরিচিত। দেশটি তার জাতিগত বৈচিত্র্য গৌরবের সঙ্গে উদ্যাপন করে এসেছে। ভারত তার নিজস্ব উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম জনসংখ্যাকে আলিঙ্গন করার জন্য একটি খ্যাতি উপভোগ করে আসছিল। কিন্তু এখন এমন একটি সরকার দেশ চালাচ্ছে, যারা খুব ভালো করে জানে তারা বিজেপিকে সর্বোচ্চ মাত্রার নৈরাজ্যবাদী কণ্ঠস্বরকে লাগামহীন হতে অনুমতি দিয়ে রেখেছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ যখন স্পষ্ট জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করে, তখন অবশ্যই জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
জয়শঙ্কর বলেছেন, পশ্চিমারা যা করে থাকে, ইউক্রেন ইস্যুতে ভারতও ঠিক তা-ই করছে। ভারত নিজের বিবেচনা দিয়ে ইউক্রেন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং সেই মোতাবেক নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে ইউরোপ যেমন নিজেদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে একটি অবস্থান নিয়েছে, ভারতও তেমনি এই ইস্যুতে নিজের স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে একটি অবস্থান নিয়েছে।
জয়শঙ্করের এই বক্তব্য ছিল ভারতের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের একটি স্পষ্ট, আত্মবিশ্বাসী ও প্রতিবাদী দাবি। সবচেয়ে যেটি আশ্চর্যজনক ছিল তা হলো, জয়শঙ্করের মন্তব্য পশ্চিমা দেশগুলোর খবরদারিতে তিতিবিরক্ত মুসলমান প্রধান কিছু দেশকেও মুগ্ধ করেছিল। ভারতের এই স্পষ্টবাদিতার জন্য উন্নয়নশীল বিশ্বজুড়ে যখন করতালি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, ঠিক তখনই ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দুই মুখপাত্রের মুখে উচ্চারিত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য সব ওলট–পালট করে দিয়েছে।
এর মধ্য দিয়ে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি যে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে ভোট নিতে মরিয়া হয়েছে, তা তারা আরও একবার বুঝিয়ে দিয়েছে। এর আগে বহুবার মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে বিজেপির নেতারা পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা করেছেন। তবে এবারের আক্রমণ একেবারে সীমা ছাড়িয়ে গেছে। স্বয়ং মহানবী (সা.)-কে অবমাননা করে তাঁরা বক্তব্য দিয়েছেন।
হিন্দি ভাষায় অনুষ্ঠিত হওয়া ভারতের রাজনৈতিক বিতর্ক শুধু ভারতের ঘরোয়া হিন্দিভাষীরাই বুঝবেন এবং এটি বাইরের দেশের ভিন্নভাষীরা বুঝতে পারবেন না—এই ধারণা ইন্টারনেট বহু আগেই বাতিল করে দিয়েছে। ফলে মুসলিম দেশগুলোর ক্ষোভে ফেটে পড়তে সময় লাগেনি। উপসাগরীয় চারটি দেশসহ নয়টি মুসলিম দেশ তাদের রাজধানীতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের তলব করেছে। ‘অগ্রহণযোগ্য’ বিবৃতির জন্য তাদের ভর্ৎসনা করেছে এবং এসব মন্তব্য যাঁরা করেছেন, তাঁদের শাস্তি দাবি করেছে।
কাতারে সফররত ভারতের উপরাষ্ট্রপতির পূর্বনির্ধারিত আনুষ্ঠানিক মধ্যাহ্নভোজ বাতিল করেছে কাতার সরকার। অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) তাৎক্ষণিকভাবে এর নিন্দা করেছে এবং জাতিসংঘকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হয় এবং উপসাগরীয় দেশগুলোতে কর্মরত কিছু ভারতীয়কে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ভারতীয় কর্মকর্তারা ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হন। মুসলিম বিশ্বকে আশ্বস্ত করা হয়, আক্রমণাত্মক বক্তব্যগুলো কোনোভাবেই ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে না এবং এ কথাগুলো যাঁরা বলেছেন, তাঁরা দলের একেবারে ‘প্রান্তিক পর্যায়ের’ লোকজন। মুসলিম দেশগুলোকে শান্ত করতে বিজেপির অভিযুক্ত দুই মুখপাত্রকে তাঁদের পদ থেকে সরানো হয়েছে। তাঁদের একজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং অন্যজনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
কিন্তু এ ঘটনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের ইসলামবিদ্বেষী চেহারাকে তুলে ধরেছে এবং এটি মুসলিম বিশ্বে ভারতের অবস্থানের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। ইসলামি বিশ্বের প্রতিক্রিয়া এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, উপসাগরীয় অঞ্চলটি ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চল ভারতের একটি বড় বাণিজ্য অংশীদার। ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তায় এ অঞ্চলের অবদান অপরিহার্য। আশি লাখ ভারতীয় প্রবাসী কর্মী এসব দেশে কাজ করেন এবং তাঁদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ভারতের অর্থনীতি অনেকখানি নির্ভর করে। এ ছাড়া সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে এ দেশগুলো ভূমিকা রাখে।
শুধু গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিজেপির এ প্রতিহিংসামূলক ও বিনা উসকানির মুসলিম-নিপীড়ন এই সব জাতীয় স্বার্থকে বিপন্ন করেছে। এর মধ্য দিয়ে বিজেপি অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে। কূটাভাষ হলো এই, মোদি সরকার মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে যথেষ্ট পরিশ্রম করেছে এবং এ ক্ষেত্রে অর্জন করা সফলতাকে বিজেপি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির সার্থকতা হিসেবে প্রচারও করেছিল।
ভারত দীর্ঘকাল ধরে মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণে সংবেদনশীল হিসেবে পরিচিত। দেশটি তার জাতিগত বৈচিত্র্য গৌরবের সঙ্গে উদ্যাপন করে এসেছে। ভারত তার নিজস্ব উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম জনসংখ্যাকে আলিঙ্গন করার জন্য একটি খ্যাতি উপভোগ করে আসছিল। কিন্তু এখন এমন একটি সরকার দেশ চালাচ্ছে, যারা খুব ভালো করে জানে তারা বিজেপিকে সর্বোচ্চ মাত্রার নৈরাজ্যবাদী কণ্ঠস্বরকে লাগামহীন হতে অনুমতি দিয়ে রেখেছে। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ যখন স্পষ্ট জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করে, তখন অবশ্যই জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এ অবস্থায় জয়শঙ্করের উচিত বিদেশে তাঁর অর্জন করা সাফল্য নিজের দেশের দলীয় কর্মীরা নস্যাৎ করে দেওয়ার আগেই এ নিয়ে তাঁর নিজের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলা। নইলে ভারতকে অনেক বড় খেসারত দিতে হবে।
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী