হুদা কমিশন নেই এটাই ডাকসুর ভরসা

নির্বাচন কমিশন ১ মার্চ জাতীয় ভোটার দিবস পালন করার ঘোষণা দিয়েছে। এবার তাদের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘ভোটার হব, ভোট দেব’। গত সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন ১০ কোটি ৪০ লাখ নাগরিককে ভোটার করলেও তাঁদের ভোট দেওয়ার নিশ্চয়তাও দিতে পারেনি। ভবিষ্যতে পারবে, সে, রকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মানুষ ভুল স্বীকার করলে ভবিষ্যতে ভুল থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তো স্বীকারই করছে না তারা কোনো ভুল করেছে। তাদের দাবি, ৩০ ডিসেম্বর তারা একটি সেরা নির্বাচন উপহার দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে ঘটা করে জাতীয় ভোটার দিবস উদ্‌যাপন ভোটারদের সঙ্গে একধরনের রসিকতাও বটে।

এই প্রেক্ষাপটে আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন। আর ১১ মার্চ হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। ২৮ বছর পর হতে যাচ্ছে ডাকসু নির্বাচন। ডাকসু নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। আমরা আশা করতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অন্তত ছাত্রদের ভোটাধিকার রক্ষা করবে।

ডাকসুর বিষয়ে পরে আসছি। ঢাকা সিটি করপোরেশন নিয়ে আলোচনা করলে দেখতে পাব, সেখানে সব অর্থেই একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এখানে উপনির্বাচন হচ্ছে সাবেক মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর দেড় বছর পর। পদ শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেন হলো না, সে প্রশ্নের জবাব সম্ভবত আমাদের বাক্পটু প্রধান নির্বাচন কমিশনার খান মোহাম্মদ নূরুল হুদারও জানা নেই। তিনি ততটুকুই জানেন, যতটুকু সরকার তাঁকে জানতে দেয়।

ক্ষমতাসীন দল চাইলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়, না চাইলে নির্বাচন হয় না। আবার নির্বাচিত হলেও যে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সব ক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, সে কথাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ২০১৩ সালে পাঁচ সিটিতে বিরোধী দলের সমর্থক প্রার্থীরা জিতেছিলেন। সেই পাঁচজনের মধ্যে চারজন দীর্ঘ সময় জেল খেটেছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে এমন সব হাস্যকর মামলা দেওয়া হয়েছিল, তাতে সম্ভবত এখন বাদীরাও লজ্জা পাবেন।

পত্রিকায় দেখলাম, সিলেট সিটি করপোরেশনের সমস্যার সমাধান না হওয়ায় একটি সংগঠন মেয়র আরিফুল হকের প্রতীকী কফিন তৈরি করে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। নিকট অতীতে যাঁরা সিলেটে গিয়েছেন, তাঁরা সাক্ষ্য দেবেন, দেশের যেকোনো শহরের তুলনায় সিলেট অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন ও সুশৃঙ্খল। তারপরও সেখানে মেয়রের কফিন তৈরি করে কর্মসূচি পালন করা হলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনায় কী কর্মসূচি নেওয়া উচিত, সেটি নিজ নিজ শহরের ভুক্তভোগী নাগরিকেরা বলতে পারবেন। কিন্তু আমরা নিশ্চিত, এ রকম কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হবে না। কারণ, এসব সিটিতে যাঁরা মেয়র আছেন, তাঁরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের।

যে সিটি করপোরেশন এলাকায় বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনবান মানুষগুলো বসবাস করেন, যে সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতি অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয়, সে এলাকার মেয়র নির্বাচন সবচেয়ে বেশি উৎসবমুখর হওয়ার কথা। কিন্তু নির্বাচন সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখছি না। গত মঙ্গলবার উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বললে তাঁদের মধ্যে অত্যন্ত নিস্পৃহতা ও উদাসীনতা লক্ষ করেছি। তাঁরা বলছেন, যে নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সেই নির্বাচনে ভোট দিয়ে কী হবে। ফলাফল তো আগেই জানা।

উত্তর সিটি করপোরেশনে পাঁচজন প্রার্থী থাকলেও নৌকার প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ছাড়া কারও পোস্টার চোখে পড়েনি। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার উপজেলা নির্বাচনকে জৌলুশহীন বলে অভিহিত করেছেন। উপজেলা নির্বাচন জৌলুশহীন হলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে বলা যায় একেবারেই ঠান্ডা। যে বাম দলগুলো নির্বাচন হলেই অংশ নেয়, সেই বামপন্থীরাও এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বিএনপি আগেই ঘোষণা দিয়েছে, তারা এ নির্বাচনে যাবে না। জাতীয় পার্টি মনোনয়ন দিয়েছে সংগীতশিল্পী শাফিন আহমেদকে। শাহিন খান, আবদুর রহিম ও আনিসুর রহমান নামে আরও তিন প্রার্থী আছেন। যে দেশের মানুষ ভোটের নাম শুনলেই চোখ-কান খাড়া রাখে, সে দেশে সবচেয়ে অভিজাত এলাকার নির্বাচন এ রকম ঠান্ডা হবে, সে কথা কেউ ভাবেনি।

উপজেলা নির্বাচনে যেটুকু উত্তাপ আছে, তা বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে। রাজশাহীর একজন সাংসদ উপযুক্ত চিকিৎসা দিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীদের ‘বিছানায়’ পাঠানোর দাওয়াই দিয়ে রেখেছেন। নারায়ণগঞ্জের একজন সাংসদ বলেছেন, ‘আমি উপজেলা নির্বাচন করব। আর কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না।’ এ রকম দাওয়াই ও হুমকির পর উপজেলা নির্বাচনের চেহারা কী দাঁড়াতে পারে, তা অনুধাবন করা কঠিন নয়।

তবে ২৮ বছর পর ১১ মার্চ যে ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে সব ছাত্রসংগঠনই অংশগ্রহণ করছে। ডুবন্ত জাহাজের যাত্রী যেমন খড়কুটো অবলম্বন করে বাঁচতে চায়, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষও শেষ ভরসা হিসেবে ডাকসু নির্বাচনকে দেখতে আগ্রহী।

অন্যান্য নির্বাচন যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন, অন্তত ডাকসু নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হোক, এই মুহূর্তে সবারই সেটি কায়মনো প্রার্থনা। দীর্ঘদিন পরে হলেও ক্যাম্পাসে সব ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা যেতে পারছেন, ভোট চাইতে পারছেন, এটুকু সান্ত্বনা। আশা করি, ১১ মার্চ বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এবং তারপরও এই পরিবেশ অটুট থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ-ও আশা করেন যে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পর যেন তাঁদের শুনতে না হয় ‘আপনার ভোট তো দেওয়া হয়ে গেছে।’ তাহলে হয়তো আমরা সুড়ঙ্গের শেষের ক্ষীণ আলোকরেখাটি হারিয়ে ফেলব।

জাতীয় নির্বাচনে নয়ছয় হওয়ার পরও ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। অতীতে এ রকম বহু নজির আছে। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, এমন দাবি বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারাও করবেন না। কিন্তু ডাকসুসহ সব ছাত্র সংসদের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ডাকসু নির্বাচনের ইতিহাসে একবারই ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে, ১৯৭৩ সালে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের ভরাডুবির মুখে। সেই নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ প্যানেল দিয়েও পাস করতে পারেনি। বিজয়ী হয়েছিল তৎকালীন জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ। এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সেই সময়ের মিত্ররা এখন মিত্র নেই। আবার প্রতিপক্ষও বন্ধু হয়েছে।

ইতিমধ্যে সব ছাত্রসংগঠন তাদের প্যানেল ঘোষণা করেছে। ছাত্রলীগের ভিপি ও জিএস প্রার্থী হচ্ছেন যথাক্রমে সংগঠনের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। ছাত্রদলের পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ভিপি পদে মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে খন্দকার আনিসুর রহমান। বাম ছাত্রজোট থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজীর। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নামে কোটা সংস্কার আন্দোলন যাঁরা করেছেন, তাঁরাও একটি পৃথক প্যানেল দিয়েছেন।

ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, বাম ছাত্রসংগঠন বা সাধারণ ছাত্র পরিষদ, যাঁরাই জয়ী হোন না কেন, ভোটটা ঠিকমতো হোক। এ নির্বাচনে বড় পরীক্ষা হলো নির্বাচনে দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের। বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর হলে ভোট নেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তির কারণ ছিল হলগুলোর প্রশাসনে সরকার-সমর্থক শিক্ষকেরাই নিয়োজিত আছেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, সরকার-সমর্থক শিক্ষকদের সহায়তায় সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী কোনো অঘটন চান না, একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চান।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com