মতামত

হুদার নির্বাচন-বিলাস ও রিটার্নিং কর্মকর্তার মৃত্যু

সিইসি কে এম নূরুল হুদা
ছবি: প্রথম আলো

উচ্চ আদালত সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচন স্থগিত করায় কথিত ভোট গ্রহণের দায় থেকে আপাতত নির্বাচন কমিশন রেহাই পেল। করোনাকালে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালন করতে হলো না বলে সরকারও দায়মুক্ত থাকল।

কিন্তু ওই উপনির্বাচনের প্রথম রিটার্নিং কর্মকর্তা ইসরাইল হোসেনকে আমরা হারালাম। নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিনি ছিলেন সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা। উপনির্বাচনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যে মারা গেলেন এবং নির্বাচনও হলো না, এর দায় ইসি কীভাবে এড়াবে? নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আরও চার কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সরকার লকডাউন দিয়ে বলেছে, কেউ ঘরের বাইরে বের হবেন না। সিইসি বলেছেন, আসুন আমরা ভোট ভোট খেলি।

নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা নির্বাচন বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছিলেন আগেই। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে ভোটারদের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। মানুষের জীবন রক্ষার খাতিরে নির্বাচন কমিশনের উচিত এই নির্বাচন স্থগিত করা।

কিন্তু সিইসি কে এম নূরুল হুদা অনড়। তাঁর কথা হলো, উপনির্বাচনের তফসিল যখন ঘোষণা করা হয়েছে, তখন ওই তারিখে নির্বাচন হবে। সিলেট-৩-এর উপনির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যেও দ্বিমত ছিল। কমিশনার মাহবুব তালুকদার অসুস্থ। রফিকুল ইসলাম জানিয়ে দিলেন, করোনাকালে তিনি নির্বাচন করার পক্ষপাতী নন। পত্রিকান্তরে তিনি বলেছেন, ‘আমার মতামত ছিল ভোট না দেওয়ার ব্যাপারে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য যে ভোট প্রয়োজন, সেটাতে আমি মত দিয়েছি। অন্যগুলোর ক্ষেত্রে আমি ডেফার করলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যরা (অন্য কমিশনাররা), যাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ (মানবজমিন, ২৬ জুলাই ২০২১)

এরপর নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলাকালেই মারা গেলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা ইসরাইল হোসেন। নির্বাচন কমিশন তাঁর স্থলে নতুন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করল সিলেটের জেলা প্রশাসককে। গত শনিবার সিলেটে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক অনুষ্ঠানে সিইসি জানান, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার ফলে সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচন পেছানোর সুযোগ নেই।

কিন্তু মাননীয় আদালত বলেছেন, নির্বাচন ৫ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত থাকবে। এরপর পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সিইসি হেলিকপ্টারে উড়ে সিলেটে গিয়েছিলেন ভোটের প্রস্তুতি দেখতে। ভোটারদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক পরে ভোটকেন্দ্রে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু দেশের মানুষ জানে হুদা কমিশন যে ধরনের নির্বাচন কর আসছে, তাতে ভোটকেন্দ্রে কারও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ভোটার এলেও ভোট হালাল, না এলেও। নির্ধারিত সময় পর একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দিলেই হলো কে বিজয়ী হয়েছেন।

নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কে মারা গেলেন, কতজন অসুস্থ হলেন, তা নিয়ে বিজ্ঞ সিইসির কোনো মাথাব্যথা নেই। তিনি যে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিয়েছেন, তা-ও সঠিক নয়। দৈবদুর্বিপাকের কারণে নির্বাচন কমিশন অতিরিক্ত যে ৯০ দিন সময় নিয়েছে, তা শেষ হবে আগামী ৩ সেপ্টেম্বর। এখনো এক মাসের বেশি সময় আছে। তাহলে কেন তিনি তাড়াহুড়া করলেন? সিইসি নিশ্চয়ই জানতেন, করোনার ঢেউয়ের মধ্যে ভারতের পাঁচ রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন করে কী অবস্থা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা এবং বালাগঞ্জ উপজেলার একাংশ নিয়ে গঠিত সিলেট-৩ আসনের সাংসদ মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ১১ মার্চ মারা যান। ১৫ মার্চ আসনটি শূন্য ঘোষণা করে ইসি। নিয়মানুযায়ী মধ্য জুনের মধ্যে এ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। কিন্তু দৈবদুর্বিপাকের দোহাই দিয়ে তারা আরও তিন মাস সময় বাড়িয়ে নেয়। পরে ইসি ২৮ জুলাই ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে।

এই প্রেক্ষাপটে করোনা সংক্রমণের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচন স্থগিত করার অনুরোধ জানিয়ে রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বরাবরে আইনি নোটিশ পাঠান পাঁচ আইনজীবী। ইসি আইনি নোটিশের জবাব না দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের ছয় আইনজীবী ও আসনটির সাতজন ভোটার সোমবার হাইকোর্টে রিট করেন।

শুনানিতে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘রিটার্নিং কর্মকর্তাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে রোববার মারা গেছেন। এখানে জীবনের অধিকারের প্রশ্ন। এখানে কারও পক্ষে বা বিপক্ষের প্রশ্ন নেই। নির্বাচন স্থগিতের পক্ষেও নই। নির্বাচন কমিশনের হাতে ৪২ দিন সময় আছে। সরকার টিকা দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছে। আগামী ৭ আগস্ট এক দিনে ৬০ লাখ টিকা দেবে বলে বলছে সরকার। করোনাকালে ২০ কোটি টিকা সরকার ব্যবস্থা করছে বলে বলেছে। এই সময়ের মধ্যে আমরা সুরক্ষা নিশ্চিত করব। ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কোনো প্রশ্ন নেই।’

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের একক ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘সবকিছু বিবেচনা করলাম, যেহেতু আগামী ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নির্বাচন করার সময় আছে। আপাতত ৫ আগস্ট পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত করছি। যেহেতু সরকারি সার্কুলারে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিধিনিষেধ আছে। পরে আদালত খোলার পর সময় ঠিক করে নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

করোনায় রিটার্নিং কর্মকর্তার মৃত্যু। দুই সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ চার নির্বাচন কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত। একের পর এক নির্বাচন কর্মকর্তার দায়িত্ব বদল। পুরো জেলায় ঊর্ধ্বমুখী করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তবুও সিইসির নির্বাচন করার বিষয়ে একগুঁয়েমি দেখিয়ে এসেছেন। এ অবস্থায় জনপ্রশাসনও তাঁর অভিপ্রায় অনুযায়ী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। ওই এলাকাকে বিধিনিষেধের আওতাবহির্ভূত ঘোষণা করে। আইনে আছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেই রূপ কর্মচারীর প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেই রূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’

করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির মধ্যে সিইসি নূরুল হুদা যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাতে সহকর্মী কমিশনারদেরও সায় ছিল না। অন্তত একজন কমিশনার প্রকাশ্যে এর সঙ্গে দ্বিমত করেছেন।

সিইসি নূরুল হুদা দায়িত্ব নেওয়ার পর যতগুলো নির্বাচন ও উপনির্বাচন হয়েছে, তাকে নির্বাচন না বলে তামাশা বলাই শ্রেয়। আদালতের রায়ের আগে সিলেট উপনির্বাচন প্রসঙ্গে আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছিলেন, ইসি আরও একটি তামাশা করতে যাচ্ছে। তারপরও সিইসি নুরুল হুদা বলেছেন, আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশে ভালো ভোট হচ্ছে। তিনি আমেরিকানদের বাংলাদেশে এসে নির্বাচনের বিষয়ে শিক্ষা নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছিলেন।

ভাগ্যিস, তাঁরা কেউ সেই পরামর্শে শোনেননি। শুনলে ডোনাল্ড স্টাম্প এখনো প্রেসিডেন্ট থাকতেন। জো বাইডেনের পক্ষে কখনো জনগণের রায় নিয়ে প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব হতো না।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি।