দূরদেশ

হিলারির জন্য কী অপেক্ষা করছে?

হিলারি ক্লিনটন, ডোনাল্ড ট্রাম্প
হিলারি ক্লিনটন, ডোনাল্ড ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সব সময়ই সারা পৃথিবীর মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে। ২০১৬ তা থেকে ব্যতিক্রম নয়। তবে এবার অতিরিক্ত মনোযোগ আকর্ষণের কারণ দুই প্রধান প্রার্থী। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকেই বিতর্কের সূচনা করে আসছেন তাঁর দেওয়া বক্তব্যে। অভিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ, নারী, ইসলাম ধর্মাবলম্বী থেকে শুরু করে সমাজের প্রায় সর্বস্তরের মানুষের ব্যাপারে অবমাননাকর বক্তব্য প্রদান এবং রিপাবলিকান দলের নেতৃত্বের বড় একটি অংশের আপত্তির পরও তিনি দলের প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছেন। কেননা, দলের তৃণমূলের এক বড় অংশের সমর্থন তিনি লাভ করেছেন। দেশের প্রধান প্রধান নীতিনির্ধারণী বিষয়ে ট্রাম্পের অজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছে। অনেক বিষয়েই তাঁর অবস্থান যেমন স্পষ্ট নয়, তেমনি সেসব বিষয়ে তাঁর অবস্থান পরিবর্তনশীলও—সুবিধা অনুযায়ী তা বদলে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে।
অন্যদিকে হিলারি ক্লিনটন ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন যতটা সহজে পাওয়ার আশা করেছিলেন, ততটা সহজে পাননি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহার করা এবং সে বিষয়ে যথেষ্ট স্বচ্ছভাবে ভুল স্বীকার না করার কারণে তাঁর বিষয়ে সাধারণ ভোটারদের, এমনকি দলের পুরোনো অনেক সমর্থকের মধ্যেও আছে প্রশ্ন। দুই প্রার্থীর ক্ষেত্রেই পছন্দের পরিমাপ যেমন করা হচ্ছে, তেমনি তাঁদের প্রতি অপছন্দের মাত্রাও এখন প্রতিদিনের জরিপের বিষয়। কয়েক দিন ধরে হিলারি ক্লিনটনকে যেসব প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তার উৎস বিল ক্লিনটনের নেতৃত্বাধীন ক্লিনটন ফাউন্ডেশন। অভিযোগ উঠেছে যে হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে দান করেছেন এমন অনেকে হিলারির সঙ্গে সহজেই দেখা করেছেন। যদিও এখন পর্যন্ত এসব অভিযোগ (যেগুলো রিপাবলিকান দলের রক্ষণশীলেরা ব্যাপকভাবে প্রচার করছেন) দেশের কোনো আইন ভঙ্গের ইঙ্গিত দেয় না; তারপরও অনেকের আশঙ্কা, এগুলো হিলারি ক্লিনটনের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাঁকে এই বিষয়গুলোতে যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তা তো সহজেই দেখা যাচ্ছে।
রিপাবলিকান দলের সম্মেলনের আগে এবং অব্যবহিত পরে দলের ভেতরে বিভিন্ন রকম সমালোচনা সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্প জনমত জরিপে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছিলেন যে হিলারির জন্য নির্বাচনটি কঠিনই হবে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট দলের সম্মেলনের সময় থেকে হিলারি ক্লিনটনের প্রতি সমর্থন বাড়তে শুরু করে। দলের সম্মেলনের পরপর দলের প্রার্থীর প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি বা ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সেই সমর্থন হিলারি ধরে রাখতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে হিলারির পক্ষে ইতিবাচক ইঙ্গিত মিলছে জাতীয় পর্যায়ের জনমত জরিপগুলোতে, ট্রাম্পের চেয়ে হিলারি এখন এগিয়ে আছেন।
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এক অর্থে জাতীয় নির্বাচন নয়। কেননা, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল প্রার্থীদের সারা দেশে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না। প্রার্থীদের জিততে হয় অঙ্গরাজ্যগুলোতে। দেশের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে বরাদ্দ করা আছে ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ ভোট, যার মোট সংখ্যা ৫৩৮। দুটি ছাড়া বাকি সব অঙ্গরাজ্যে প্রাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রার্থীরা সেই ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে বিজয়ী হন, আর তাঁর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট অর্থাৎ ২৭০টি পেলেই একজন প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারেন। যেহেতু জনসংখ্যার অনুপাতে এই ইলেকটোরাল কলেজের সংখ্যা নির্ধারিত হয়, সেহেতু বড় অঙ্গরাজ্যগুলোতে বেশি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট রয়েছে। ফলে এক অর্থে যদিও সাধারণভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের সমর্থন ছাড়া বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম, তথাপি সেটা একেবারে অসম্ভব নয়। এ রকম ঘটনা ঘটেছে খুব কম; যেমন ১৮২৪, ১৮৭৬ ও ১৮৮৮ সালে এ ঘটনাই ঘটেছিল। সাম্প্রতিককালে আমরা সেই ঘটনার সাক্ষী হয়েছি ২০০০ সালে, যখন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী আল গোর রিপাবলিকান পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বী জর্জ বুশের চেয়ে বেশি ভোট পাওয়ার পরও প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। এই ব্যবস্থার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কাগজে-কলমে চারটি বড় অঙ্গরাজ্যের গুরুত্ব বেশি। এগুলো হচ্ছে নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস ও ফ্লোরিডা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে এর মধ্যে তিনটির ফলাফল আমরা ভোটের অনেক আগেই বলে দিতে পারি। নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়া ডেমোক্র্যাটদের শক্ত ঘাঁটি আর টেক্সাস রিপাবলিকানদের। বাকি অঙ্গরাজ্য ফ্লোরিডা কোন দলকে ভোট দেবে তা আগে থেকে বলা কঠিন। গত ১০টি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল দেখলেই অবস্থাটা বোঝা যায়। এর মধ্যে ডেমোক্র্যাটরা জিতেছেন চারবার আর রিপাবলিকানরা জিতেছেন পাঁচবার; ২০০০ সালে কার্যত দুই প্রার্থীই সমান ভোট পেয়েছিলেন। আর কখনো কখনো ফল নির্ধারিত হয়েছে খুব সামান্য ব্যবধানে। যেমন ২০১২ সালে বারাক ওবামা জিতেছেন ১ শতাংশেরও কম ভোটের ব্যবধানে।
একবার এদিকে একবার ওদিকে ভোট দিয়েছে এমন অঙ্গরাজ্য যেমন ফ্লোরিডা একমাত্র নয়, তেমনি বাকি তিন অঙ্গরাজ্যই কেবল এক দল বা অন্য দলের পক্ষে স্থির হয়ে থেকেছে তা–ও নয়। গত দুই দশকের ভোটের বিবেচনায় রিপাবলিকানদের পক্ষে উপর্যুপরিভাবে ভোট দিয়েছে এমন অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা ১৩টি, অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে ভোট দিয়েছে ১৯টি। শুধু তা-ই নয়, ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে যে অঙ্গরাজ্যগুলো ভোট দিয়েছে, সেগুলোতে তুলনামূলকভাবে জনসংখ্যা বেশি; ফলে তাদের কাছে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যাও বেশি। স্থায়ীভাবে রিপাবলিকান সমর্থক অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে গড়ে ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যা ৮টি, ডেমোক্র্যাট সমর্থক অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে গড়ে ভোট ১৩টি। ফলে এই হিসেবে যেকোনো ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রিপাবলিকান দলের প্রার্থীর চেয়ে খানিকটা বেশি সুবিধা নিয়েই যাত্রা শুরু করেন। এসব অঙ্গরাজ্য যদি তাদের অতীত ইতিহাস ধরে রাখে, তবে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ইতিমধ্যে ২৪২টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের আশা করতে পারেন, অন্যদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প আশা করতে পারেন ১০২টি ভোটের। এই একই বিবেচনায় নির্বাচনের কথা উঠলেই শোনা যায় ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটের কথা, অর্থাৎ যেগুলো কোন দিকে ভোট দেবে, আমরা তা ইতিহাস থেকে বলতে পারি না। এ রকম অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা সব নির্বাচনের ক্ষেত্রেই এক নয় এটা ঠিক; কিন্তু কিছু অঙ্গরাজ্য এ জন্যই পরিচিত, যার মধ্যে ফ্লোরিডার কথা আগেই উল্লেখ করেছি, আর রয়েছে ওহাইও। ওহাইওর আরেক গুরুত্ব হচ্ছে তাঁর ইতিহাস—গত ১০টি নির্বাচনে পাঁচবার ডেমোক্র্যাট এবং পাঁচবার রিপাবলিকান প্রার্থী জিতেছেন; কিন্তু প্রতিবার ওহাইওর ভোটাররা যার পক্ষে ভোট দিয়েছেন, তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। একইভাবে ফ্লোরিডা ও নেভাডা নয়বার বিজয়ীর পক্ষে গেছে, কলোরাডো ও নিউ হ্যাম্পশায়ার গেছে আটবার করে।
আমরা জানি যে নির্বাচন মানেই অনিশ্চয়তা, অতীতে কে কাকে ভোট দিয়েছেন, সেটা দিয়ে সব নির্ধারিত হয় না। তা ছাড়া যেসব অঙ্গরাজ্যে গত নির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ বা তার কম ভোটে বিজয়ী নির্ধারিত হয়েছে, সেগুলোকে নির্বাচনের পর্যবেক্ষকেরা ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ বলেই ধরে নেন। ফলে প্রতিটি নির্বাচনেই আমরা নতুন তালিকা দেখতে পাই। সে হিসেবে ২০১৬ সালের নির্বাচনের প্রচারণার গোড়াতে ১১টি অঙ্গরাজ্যকে এ রকম সুয়িং স্টেট বা ব্যাটলগ্রাউন্ড বলে বিবেচনা করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে: কলোরাডো অঙ্গরাজ্য, ফ্লোরিডা, আইওয়া, নেভাডা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, নর্থ ক্যারোলাইনা, ওহাইও, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, ভার্জিনিয়া ও উইসকনসিন অঙ্গরাজ্য। এসব অঙ্গরাজ্যে মোট ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের সংখ্যা ১৪৬। ফলে এর একটা বড় অংশ যাঁর পক্ষে যাবে, তাঁর বিজয়ের পথ হবে সুগম। এসব অঙ্গরাজ্যের সাম্প্রতিক যে জনমত জরিপগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য আপাতত কোনো সুখবর নেই। এর প্রতিটি অঙ্গরাজ্যেই ট্রাম্প পিছিয়ে আছেন। শুধু তা–ই নয়, কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের প্রতি সমর্থন এতটাই বেশি যে কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে বড় ও নাটকীয় ধরনের ঘটনা না ঘটলে এগুলো ইতিমধ্যে ট্রাম্পের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ভার্জিনিয়া, কলোরাডো, উইসকনসিন, নিউ হ্যাম্পশায়ার ও পেনসিলভানিয়া।
শুধু তা-ই নয়, এত দিন ধরে যেসব অঙ্গরাজ্যকে রিপাবলিকান পার্টির শক্ত ঘাঁটি বলে বিবেচনা করা হতো, সে ধরনের দুটি অঙ্গরাজ্যে হিলারির প্রতি সমর্থনের মাত্রা রিপাবলিকানদের জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে; সেগুলো হচ্ছে অ্যারিজোনা ও জর্জিয়া। অ্যারিজোনা গত ৪০ বছরে মাত্র একবার ডেমোক্র্যাট প্রার্থীকে জয়ী করেছে। এ থেকেই বোঝা যায় যে এই অঙ্গরাজ্যগুলোতে রিপাবলিকানদের কোন রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবিলা করতে হবে তা কখনোই ভাবা হয়নি। কিন্তু গত কয়েক দিনের যেসব জরিপ, তাতে মনে হচ্ছে এগুলো এখন আর ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর ধরাছোঁয়ার বাইরে নেই।
এসব জনমত জরিপের ফলাফল এবং গত কয়েক সপ্তাহের প্রবণতা সত্ত্বেও বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই যে নির্বাচনের বাকি ১১ সপ্তাহ। বলা হয়ে থাকে, রাজনীতিতে এক দিন এক মাসের চেয়েও বেশি সময়; সেখানে ১১ সপ্তাহ যে কত দীর্ঘ সময় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচনের সময় একটি ঘটনাতেই সবকিছু বদলে যেতে পারে। আর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ‘অক্টোবর সারপ্রাইজ’ বলে একটা কথা চালু আছে, যা সাধারণত এগিয়ে থাকা প্রার্থীর জন্যই বিপদ ঘটায়। তেমন কিছু হিলারি ক্লিনটনের জন্য অপেক্ষা করছে কি না, তা বলা মুশকিল; তবে গত কয়েক সপ্তাহের ধারা অব্যাহত থাকলে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য সামনের দিনগুলো খুব আশাব্যঞ্জক নয়।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।