হিজড়া কিংবা ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য এবং তাঁদের বঞ্চনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা লেখাজোখা মাঝেমধ্যে আমরা পত্রিকায় দেখতে পাই। এ বিষয়ে আলোকপাত করে গত আগস্টের প্রথম ভাগে প্রথম আলোয় একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হয়। এ ছাড়া ‘হিজড়া/ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও অধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠককেন্দ্রিক ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘সরকারি সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা: জবাবদিহি-ব্যবস্থার বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে, যেখানে হিজড়ারাও রয়েছেন।
এটি উৎসাহের কথা, হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার, চিকিৎসা এবং জীবনযাপনের জন্য সরকারের স্পষ্ট নীতিমালা থাকার প্রয়োজনীয়তার ওপর ওই বৈঠকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এটি সুপারিশসমূহের শীর্ষে রয়েছে। তবে ফলপ্রসূ একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি করার জন্য যে নির্ভরযোগ্য ভিত প্রয়োজন, আমরা সেটা তৈরি করতে পেরেছি কি না, তা ভাবার বিষয়।
হিজড়াদের বিভিন্ন সমস্যার কথা পত্রিকায় এসেছে। যেমন ঘরে-বাইরে সর্বত্র হেয় হওয়া, যৌন হেনস্তার শিকার হওয়া, আইডেনটিটি অর্থাৎ নারী, নাকি পুরুষ বুঝতে না পারা এবং এ কারণে প্রচলিত ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়া ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় এবং সাধারণ সমস্যা যেটি, তা হলো পরিচয় সংকট।
হিজড়াদের লিঙ্গ কী? নারী, পুরুষ নাকি অন্য কিছু? গুরুত্ববহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ এ জিজ্ঞাসায় বিভ্রান্তি লক্ষ করা যায়। এ বিষয়ে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। নাহলে পুরোনো সমস্যা জিইয়ে রাখা হবে। অনেকে মনে করতে পারবেন, কয়েক বছর আগে সংবাদপত্রে একটি খবর ছিল, চাকরি দেওয়ার মানসে কয়েকজন হিজড়ার ডাক্তারি পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল তাঁরা পুরুষ। অতএব, চাকরি হয়নি। লক্ষণীয়, দাপ্তরিক কাগজপত্রে হিজড়া জনগোষ্ঠীর কারও নাম পুরুষের, কিন্তু তিনি সে নামে পরিচিত হতে চান না। চান নারীর নামে পরিচিত হতে। আবার কারও নাম নারীর, তিনি পরিচিত হতে চান পুরুষের নামে। হিজড়াদের স্বকীয় সত্তা বা আইডেনটিটি যথাযথভাবে বোঝার জন্য যৌন অঙ্গ নয়, সার্বিকভাবে মানুষের যৌনতা বা সেক্সুয়ালিটি বিষয়টি আলোচিত এবং বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।
হিজড়াদের বিভিন্ন সমস্যার কথা পত্রিকায় এসেছে। যেমন ঘরে-বাইরে সর্বত্র হেয় হওয়া, যৌন হেনস্তার শিকার হওয়া, আইডেনটিটি অর্থাৎ নারী, নাকি পুরুষ বুঝতে না পারা এবং এ কারণে প্রচলিত ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়া ইত্যাদি। সবচেয়ে বড় এবং সাধারণ সমস্যা যেটি, তা হলো পরিচয় সংকট।
‘যৌনাঙ্গ’ এবং ‘যৌনতা’ দুটি ভিন্ন বিষয়; যেমন ‘সেক্স’ এবং ‘জেন্ডার’ দুটি আলাদা বিষয়। দুটি আলাদা হলেও ব্যক্তির পরিচয় বা আইডেনটিটির ক্ষেত্রে দুটিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার অবকাশ নেই। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির যৌনসত্তা/সেক্সুয়াল আইডেনটিটির নিয়ামক হচ্ছে তার ভেতরগত উপলব্ধিভিত্তিক ইচ্ছা। এটার স্বীকৃতি প্রয়োজন বলেই হিজড়াদের অনেকেই তাঁদের বর্তমান নাম-পরিচয় পরিবর্তন করতে চান। যে নাম তাঁরা পরিবর্তন করতে চান, সেটি জন্মের সময় দৃশ্যত জৈবিক লিঙ্গের ভিত্তিতে পরিবারের দেওয়া। আর আকাঙ্ক্ষিত নামটি হচ্ছে তাঁর বয়সের একটা পর্যায়ের পরে স্বকীয় সত্তার উপলব্ধিজাত।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর সবাই শারীরিকভাবে পুরুষ এবং মানসিকভাবে নারী-এ কথা ঢালাওভাবে বলা যায় না। ‘হিজড়া’ শব্দটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণা হিসেবে অতীতকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এর মধ্যে জন্মগতভাবে নারী এবং পুরুষ যেমন রয়েছেন, তেমনই আছেন অলিঙ্গ, নপুংসক, দ্বৈত লিঙ্গ, আন্তলিঙ্গের মানুষেরা। তবে দেখা যায়, হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে জন্মগতভাবে যারা পুরুষ, তাঁদের উপস্থিতি জন্মগতভাবে নারীর তুলনায় বেশি। এর পেছনে আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে।
আমরা দেখি, ছেলেদের লম্বা চুল, শাড়ি, লিপস্টিক ইত্যাদি পরা পরিবার ও সমাজে যতটা না গ্রহণীয়, তার চেয়ে বেশি গ্রহণীয় মেয়েদের ছোট চুল এবং প্যান্ট-শার্ট পরা। ফলে একটি গ্রুপ নিজ মাতৃ-পিতৃপরিবারে স্থান পায় না। তাই বাধ্য হয়ে তারা নিজেদের নিরাপত্তা এবং জীবিকার তাগিদে গুরু ধরে। এরা দৃশ্যমান, দলে চলে এবং রাস্তাঘাটে টাকা তোলে আর নানা রকম সহিংসতার শিকার হয়। আরেকটি গ্রুপের বেশির ভাগই পরিবার ও সমাজে মিশে যান।
হিজড়া জনগোষ্ঠীতে যাঁরা জন্ম থেকে শারীরিকভাবে পুরুষ কিংবা নারী, তাঁরা মন-মানসিকতায় নিজেদের বিপরীত লিঙ্গের বলে মনে করেন এবং তাঁদের আচরণে সে রকম প্রকাশ ঘটে। যেমন, বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে এবং পুরুষ যৌনাঙ্গ নিয়ে জন্মানো সত্ত্বেও নিজেকে নারী ভাবেন, সে ধরনের পোশাক পরে সাজসজ্জা করেন। আবার একইভাবে উল্টোটা ঘটে অর্থাৎ জৈবিকভাবে (বায়োলজিক্যালি) নারী কিন্তু মানসিকভাবে পুরুষসুলভ। জন্মগতভাবে এই নারী-পুরুষদের ভেতরগত যৌনসত্তা এবং আচরণ/চর্চা পূর্বোল্লিখিত যেকোনো ধরনের যৌনতা/সেক্সুয়ালিটির হতে পারে।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার এবং মানবিক মর্যাদার ক্ষেত্রে কাজ করা প্রয়োজন গভীর থেকে। সমস্যা সংকটের প্রাথমিক উৎস আমাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং অমানবিকতা। এখানে পরিবর্তন আনতে উক্ত জনগোষ্ঠীর কষ্ট ও বঞ্চনার স্বরূপ বিশদভাবে জনমানুষের সামনে তুলে ধরা দরকার। এর জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিজীবনঘনিষ্ঠ প্রাথমিক গবেষণা।
যৌনতা প্রতিটি জীবনের জন্য একটি মৌলিক বিষয় এবং এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে পরিবার এবং সমাজের সুস্থতা। বিষয়টি আড়ালে না রেখে এ নিয়ে যত বেশি খোলামেলা কথা বলা এবং লেখালেখি করা যাবে, ততই এগোনোর পথ প্রশস্ত হবে। পরিবার তথা মানুষকে সচেতন করার ক্ষেত্রে মিডিয়া শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষাক্রমে শরীর, বয়োসন্ধি, যৌনতা, মানুষের বৈচিত্র্য, সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন। রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে জাতিকে সভ্যতা, সমতা এবং মানবিকতাচর্চায় এগিয়ে নেওয়ার।
হাস্নাহেনা প্রাক্তন কর্মকর্তা, জাতিসংঘ