বাঘা তেঁতুল

হায় আশরাফুল মখলুকাত

বাংলার মাটিতে মানুষ মরে পোকামাকড়ের মতো, মানুষের মতো নয়।
টিভির পর্দায় দেখেছি লঞ্চটি পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যাবে। এক নারীর কণ্ঠ, সম্ভবত তিনি তাঁর বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে উচ্চারণ করছেন—লা ইলাহা ইল্লালাহু...।
কলেমা শাহাদত আমি এ জীবনে লাখোবার শুনেছি। সেদিনের লঞ্চের তলা থেকে ধ্বনিত হওয়া অমনটি কখনো শুনিনি। মাস খানেক যাবৎ প্রতিদিন ওই কথাগুলোই আমার কানে বাজে। মানুষগুলো জানছে, তারা এখনই মরবে। কিন্তু এ কথা ভাবার সময় তারা পায়নি যে তাদের মরদেহ তাদের প্রিয়জনরা পাবে না দাফন করতে।
লঞ্চটির উদ্ধারকাজ সাঙ্গ করার পরদিন আমি মুন্সিগঞ্জে যাই। স্থানীয় লোকজন বলেন, ডুবে যাওয়া লঞ্চটি উদ্ধার হয়নি, কারণ ওর খোলের মধ্যে যে শতাধিক যাত্রীর লাশ ছিল, তা পদ্মাপাড়ে সারি সারি শুইয়ে রাখলে যে হৃদয়বিদারক দৃশ্য হতো, তা জনগণের সরকারবিরোধী আবেগ উসকে দিত। নদীর তলদেশে বিনা পয়সায় তাদের দাফন করে দিল কর্তৃপক্ষ। যেখানে জীবনের দাম নেই, সেখানে গলিত লাশের কী দাম?
লঞ্চটির ৮৫-৯০ যাত্রীর ধারণক্ষমতা ছিল। সেখানে আড়াই শ যাত্রী কীভাবে ওঠে, তা তদারকের কেউ নেই। থাকলেও তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। কর্তব্যে অবহেলার কারণে তাদের শাস্তি হয় না।
বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন চারজন, গুরুতর আহত হয়েছেন পাঁচজন। রেলের ডিজি হোসেন সাহেব বলেছেন, ‘লাইনের ওপর কেউ দাঁড়ানোর পর (মরলে) সেই দুর্ঘটনার দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষ নেবে না।’
তাঁর এই বক্তব্যে তথ্যগত ভুল নেই। যা আছে, তা হলো নির্মমতা ও নির্লজ্জতা। দুর্ঘটনার দুই ঘণ্টা পরে আমি ওই জায়গায় যাই। তখন রেললাইনের ওপর ছোপ ছোপ রক্ত, যেন বঁটি দিয়ে মাছ কেটেছে ওখানে কেউ। এবং সুনসান নীরবতা।
একটি লাইন দিয়ে চট্টগ্রামগামী কর্ণফুলী এক্সপ্রেস কমলাপুর থেকে আসছিল। সেটা সবাই দেখেছিল। আর একটি ট্রেন যমুনা এক্সপ্রেস ছিল কমলাপুরগামী। ওই ট্রেনটি হুইসেল দিয়ে আসেনি। সবাই বলছিলেন, হুইসেল দিলে এ দুর্ঘটনা ঘটত না। গেটম্যানও বলেছেন, ‘দুটি ট্রেন পাশাপাশি আসায় বিষয়টি অনেকে খেয়াল না করায় দুর্ঘটনা ঘটে।’
রেলপথে মুহূর্তের বিভীষিকারেলের ডিজি মহোদয়ের চেয়ে গেটম্যানের বক্তব্য অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। রেললাইনের ওপর বাজার বসায় সরকারি দলের মাস্তানেরা ‘মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে’। ওই টাকার ভাগ সবাই পায়। কে কে পায়, তাদের নাম বলতে পারব না।
দুর্ঘটনাটি ঘটে সকাল নয়টার আগে। তাই ধারণা করি, মন্ত্রী ও ডিজি তখনো প্রাতঃকৃত্য শেষ করে উঠতে পারেননি। ওই সময় এ-জাতীয় মরার খবর বিরক্তির উদ্রেক করতেই পারে। এখন মোবাইল ফোনের যুগ। পাঁচ সেকেন্ডে খবর পৌঁছে যায় সবার কাছে। ওখানে মন্ত্রীসহ সবার ছুটে যেতে আধা ঘণ্টাই খুব বেশি।
ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের কোনো গরু বা বাছুর অসুখে মারা গেলে বাঁশের সঙ্গে চার পা বেঁধে ঝুলিয়ে পদ্মার পাড়ে নিয়ে ফেলে আসা হতো। কারওয়ান বাজারে দুর্ঘটনার পর নিহত হতভাগ্যদের ঠিক ওইভাবে বাঁশে ঝুলিয়ে ওখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে গরু-বাছুরের মতো উলঙ্গ নয়, চটের বস্তায় জড়িয়ে। দৃশ্যটি আমার কাছে বর্বরোচিত ও বীভৎস মনে হয়েছে এই জন্য যে আমিও ওই লোকগুলোর মতোই একটি মানুষ, গরু-ছাগল বা কুকুর নই।
মাননীয় ডিজি মহোদয় ও মাননীয় রেলমন্ত্রী, যিনি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সুখের নতুন জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, কী রকম দাপ্তরিক কর্তব্য বা নৈতিক দায়িত্ব পালন করছেন? তাঁদের বিবেক, যদি আদৌ থেকে থাকে, কী বলে সেই বিবেক? কোনো দুর্ঘটনায় তাঁদের নিকটজন বা শ্বশুরবাড়ির অথবা হবু শ্বশুরবাড়ির কেউ যদি মারা যেতেন এবং লাশ বস্তায় জড়িয়ে বাঁশে ঝুলিয়ে ডোমেরা বহন করতেন, তাহলে তাঁদের কেমন লাগত?
দুর্ঘটনাটি যেখানে ঘটে, সেটি কোনো নির্জন প্রান্তর নয়। জায়গাটি নগরের সবচেয়ে জনাকীর্ণ এলাকাগুলোর একটি। ওখান থেকে যেকোনো দিকে ৫০০ গজের মধ্যে পুলিশ গিজগিজ করে। সরকার কিছু করবে না জানি, প্রাইভেট ক্লিনিক চারদিকে বহু। একটি অ্যাম্বুলেন্স বা পিকআপ কোথাও পাওয়া গেল না!
যদি আমাদের রাষ্ট্র মানুষ হতো বা চেতনাসম্পন্ন কোনো বস্তু হতো, তাকে জিজ্ঞেস করতাম: হে রাষ্ট্র মহোদয়, আপনার কাজ কী?§ আপনি যাদের আপনার ম্যানেজার বানিয়েছেন, তাদের কাজই বা কী? §আপনি যত প্রকাণ্ড অবয়ববিশিষ্টই হোন, আপনি সৃষ্টির সেরা জীব নন। কিন্তু আমরা ছোট্ট শরীরবিশিষ্ট হলেও আমরা আশরাফুল মখলুকাত। আমাদের আত্মা ও শরীর দুটোই পবিত্র। তাকে অসম্মান করার অধিকার আপনার নেই।
এই রাষ্ট্রে নিজেকে মানব পরিচয় দিতে লজ্জা ও গ্লানি বোধ করি। নিহত ব্যক্তিদের বাবা-মা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কাছে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে করজোড়ে ক্ষমা চাই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷