লেবাননজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার ১৩ দিন পর গত ২৯ অক্টোবর দেশটির প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার সময় তিনি এটিকে দেশের জন্য খুব বেশি প্রয়োজনীয় ‘ইতিবাচক ধাক্কা’ বলে অভিহিত করেন। চলতি সপ্তাহের শুরুতে সাদ হারিরি আউনের সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং সরাসরি হিজবুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই গোষ্ঠী নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পক্ষে। এ ব্যাপারে কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে, তা নিয়ে হারিরি তাদের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। পদত্যাগের অর্থ এই নয় যে হারিরি পুরোপুরি শাসকগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। বরং এতে তাঁর ফিউচার মুভমেন্ট, হিজবুল্লাহ ও ফ্রি প্যাট্রিয়টিক মুভমেন্ট জোটের মধ্যে ২০১৬ সালে স্বাক্ষরিত রাজনৈতিক চুক্তির পরিধিতে পরিবর্তন আনার অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয়েছে। ওই চুক্তিই মিশেল আউনের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ প্রশস্ত করেছিল।
এ নিয়ে দ্বিতীয়বার হারিরি লেবাননের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ালেন। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে হারিরির ওয়াশিংটন সফরকালে হিজবুল্লাহ ও ফ্রি প্যাট্রিয়টিক মুভমেন্টের (এফপিএম) প্রতিনিধিত্বকারী মন্ত্রীরা পদত্যাগ করে তাঁর সরকারকে অচল করে দিয়েছিলেন এবং নাজিব মিকাতির নেতৃত্বে একটি নতুন সরকার গঠনের দিকে দেশকে ঠেলে দিয়েছিলেন। এবার অবশ্য চাপের উৎস ভিন্ন ছিল, যা হারিরিকে তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অবসান ঘটানোর দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা দাবি করেছে, একটি নতুন সরকার গঠন করা হোক, সেটা চালাবে টেকনোক্র্যাটরা, যাদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। কিছু রাজনৈতিক শক্তি বর্তমান পার্লামেন্টের মতো একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের কথা বলছে, যা গত বছর নির্বাচিত হয়েছে।
লেবাননের চলমান বিক্ষোভ ২০১৬ সালে স্বাক্ষরিত প্রেসিডেনশিয়াল চুক্তিতে চাপ সৃষ্টি করেছে, যা লেবাননের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করলেও একটি উপদলীয় ক্ষমতার ভাগাভাগির চুক্তির পথ প্রশস্ত করেছিল; সেটা দুর্নীতি এবং জবাবদিহিহীনতাকে উৎসাহিত করেছে। জনগণের এই চাপ শাসকগোষ্ঠীকে ওই চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা এবং নতুন করে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করার দিকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু পরিবর্তনের জন্য বিক্ষোভকারীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শাসন পরিচালনার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা না করে রাজনৈতিক শ্রেণিকে ক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ নিয়ে বেশ ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছে।
সাদ হারিরি প্রগ্রেসিভ সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রধান ওয়ালিদ জুম্বলাত এবং লেবানিজ বাহিনীর প্রধান সামির গিয়াগাকে সঙ্গে নিয়ে এই রাজনৈতিক চুক্তির পরিধি নিয়ে আবার আলোচনা করতে চান। তিনি অবশ্য এই আলোচনায় প্রেসিডেন্ট আউনের জামাতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিবরান বাসিলকে রাখতে চান না। কারণ, বাসিল বিভাজনমূলক বক্তৃতা দিয়ে এবং সরকারি পর্যায়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করার জন্য ব্যাপক সমালোচিত হয়েছেন। হিজবুল্লাহ এবং আউন এখনই তাঁকে সরকারে রাখার জন্য জোর দিচ্ছেন। তবে তাঁর নিজের পরিবারের মধ্যে অন্তর্বিরোধের কারণে প্রেসিডেন্টের অবস্থান অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। আউনের তিন মেয়ের মধ্যে দুজন বিশ্বাস করেন যে বাসিল তাঁদের বাবার বিশ্বাসযোগ্যতাকে কলঙ্কিত করছেন এবং তাঁর চলে যাওয়া উচিত। এদিকে হিজবুল্লাহ আভাস দিয়েছে যে হারিরি যদি তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব বহাল রাখেন, তাহলে সরকার থেকে বাসিলকে অপসারণে তারা রাজি হবে না। হারিরি তাঁর পক্ষে লম্বা খেলা খেলবেন বলে মনে হচ্ছে, তাঁর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত তাঁর ওপর জনগণের ক্ষোভকে প্রশমিত করবে এবং তাঁকে রাজনৈতিক অবস্থান ফিরে পেতে সহায়তা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে হারিরির পদত্যাগের পর তিনটি ঘটনা ঘটতে পারে। প্রথমত, সংসদে হিজবুল্লাহ এবং তার সহযোগীরা হারিরিকে একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের ম্যান্ডেট দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে মন্ত্রিপরিষদ একত্র করার চেষ্টা করবেন, যা হিজবুল্লাহ-এফপিএমকে খুশি রাখবে বা বিক্ষোভকারীদের দাবি মেনে নেবেন এবং সব মন্ত্রী পদের জন্য টেকনোক্র্যাটদের এগিয়ে রাখবেন। জনগণের চাপ এবং তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ওপর নির্ভর করে হিজবুল্লাহ এবং আউন প্রতিরোধ করতে পারেন বা জনগণের দাবি মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে হিজবুল্লাহ এটা বুঝতে পেরেছে যে টেকনোক্র্যাটদের দ্বারা পরিচালিত সরকারকে স্বীকার করার অর্থ আগাম সংসদ নির্বাচন এবং একটি নতুন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যা তার ক্ষমতাকে হ্রাস করবে। হারিরি যদি টেকনোক্র্যাটদের নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে দেন, তাহলে হিজবুল্লাহ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে পারে। বিকল্পভাবে আউন, হারিরি এবং হিজবুল্লাহ একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেন, যা বাসিলের মতো বিতর্কিত মন্ত্রীদের অপসারণ করে কিছু টেকনোক্র্যাটকে মন্ত্রীর পদে রাখবে এবং একটি সংস্কার পরিকল্পনার প্রস্তাব দেবে। তবে সদ্য পদত্যাগ করা মন্ত্রিসভার সংশোধিত সংস্করণ সম্ভবত আবারও জনগণের ক্ষোভকে উসকে দেবে।
দ্বিতীয়ত, হিজবুল্লাহ এবং তার সহযোগীরাও নতুন মন্ত্রিসভায় পার্লামেন্টের ভোটে নেতৃত্ব নিতে পারে এবং হারিরির জায়গায় কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রধানমন্ত্রীর নাম প্রস্তাব করতে পারে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিজবুল্লাহ এবং হারিরির সম্মতিতে একটি টেকনোক্রেটিক মন্ত্রিসভা গঠনের চেষ্টা করতে পারেন, যা প্রতিবাদকারীদের সন্তুষ্ট করবে, তবে উভয় পক্ষই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এমন মন্ত্রীদের কাছে নীতিনির্ধারণের ক্ষমতা সমর্পণ করবে তা কল্পনা করা শক্ত। বিকল্পভাবে আউন এবং হিজবুল্লাহ হারিরিকে কোণঠাসা করার জন্য তাদের সহজ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করতে পারে এবং নতুন প্রধানমন্ত্রীকে টেকনোক্র্যাটদের সমন্বয়ে সরকার গঠনের প্রস্তাব দিতে পারে। এটি হারিরিকে বিরোধী দলের দিকে ঠেলে দেবে। লেবাননে এ ধরনের সরকার হিজবুল্লাহ-নিয়ন্ত্রিত বলে বিবেচিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে পারে, যারা হিজবুল্লাহকে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে সম্ভাব্য দৃশ্য হচ্ছে বর্তমান মন্ত্রিসভা তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে রয়ে গেছে এবং রাজনৈতিক অভিজাতরা পরবর্তী খেলার জন্য অপেক্ষা করছেন। এটি প্রতিবাদকারীদের হাল ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করবে এবং দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। সুতরাং, হারিরির পদত্যাগ সংকটের সমাধানের চেয়ে দেশকে আরও রাজনৈতিক সংকটের দিকে ঠেলে দেবে বলেই মনে হচ্ছে।
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
জো ম্যাকারন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ