‘বান্ধব’ সাংবাদিক, পাকিস্তানের হামিদ মিরের হঠাৎ নাটকীয় ঘোষণায় নড়েচড়ে বসেছি। অবাক হয়েছি এই দেখে যে এই নাটকীয়তা তাঁর বাবার সম্মাননাকে ছেড়েও কথা বলছে না।
মিরকে ‘বান্ধব’ বলছি এই জন্য যে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সাংবাদিকতা করার জন্য তিনি মশহুর। নিজের দেশ পাকিস্তান, পাশের আফগানিস্তান তো বটেই, চেচনিয়া, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, বোধ করি বলকান এলাকাতেও তিনি সাংবাদিকতা করেছেন মাঠে গিয়ে। তাঁর সেই সব অভিজ্ঞতা শোনার জন্য হামেশাই তিনি দাওয়াত পান সাংবাদিকদের নানা আন্তর্জাতিক ‘জলসা’য়। এর অনেকটিতে যাওয়ার সুবাদে মিরের সঙ্গে আমার একধরনের সখ্য গড়ে ওঠে। তিনিও এই সম্পর্ককে গুরুত্ব দেন। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক, ১৯৭১ সালে তাঁর বাবার ভূমিকার প্রতি বাংলাদেশের শ্রদ্ধাবোধ, আঞ্চলিক রাজনীতির গতি–প্রকৃতি নিয়ে কেটেছে অনেক সময়।
এসব আলোচনা ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয় যখন করাচি প্রেসক্লাবের সামনে তিনি একা এই ব্যানার নিয়ে দাঁড়ান যে ‘১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলায় গণহত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের জন্য বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ÿক্ষমা চাইতে হবে’। বছর চারেক আগে ঢাকাতেই এক টিভি সাক্ষাৎকারে মির বলেছিলেন, এই দাবির সমর্থনে তাঁর সঙ্গে রয়েছেন সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান। দাবি ছিল, পাকিস্তান পার্লামেন্টের ৩০ থেকে ৩৫ জন সদস্যও তাঁর সঙ্গে রয়েছেন এবং পাকিস্তানের পার্লামেন্টেও তিনি এই দাবির সমর্থনে প্রস্তাব উত্থাপন করবেন।
কিন্তু সময় সাক্ষ্য দেবে—যত গর্জেছিল, তত বর্ষেনি। তাঁর বাবাকে দেওয়া বাংলাদেশের সম্মাননা ফিরিয়ে দিতে মিরের সর্বশেষ নাটকীয় ঘোষণায় প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে তাঁর আগের উদ্যোগটি কি নিছক নাটুকে আয়োজন ছিল?
হামিদ মির বাংলাদেশের মানুষের মনে ঠিকানা করতে পেরেছিলেন তাঁর বাবার জন্য। তাঁর বাবা ওয়ারিস মির পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন, অনিয়মিত কলাম লিখতেন মূলধারার বিভিন্ন সংবাদপত্রে। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নানা কৌশলে তাঁর ছাত্রদের নিয়ে সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তান সফর করেছিলেন। সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নারকীয়তার চিত্র। পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে শিক্ষক ওয়ারিস মির লিখেছিলেন পাকিস্তানেরই একটি অংশে পাকিস্তান সরকার তার সেনাবাহিনী দিয়ে কী ধরনের নারকীয় তাণ্ডব চালাচ্ছে। সে সময় হাতে গোনা যে কজন মানুষ খোদ পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে কথা বলেছিলেন, ওয়ারিস মির ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সে কারণেই বাংলাদেশ তার দায়িত্ব পালন করেছে। ২০১৩ সালে তাঁকে দেওয়া হয় ‘মুক্তিযুদ্ধে বন্ধু’র সম্মাননা। ওয়ারিস মিরের সাংবাদিক পুত্র হামিদ মির বাবার এই সম্মাননা গ্রহণ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে।
হামিদ মির এখন তাঁর বাবার সেই সম্মাননা ফেরত দিতে চান। তাঁর অভিযোগ, পাকিস্তানিদের কয়েকজনকে ওই সম্মাননা দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের ‘ধোঁকা’ দিয়েছেন। শেখ হাসিনার আমলেই বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি যে তর্জনী তুলেছেন হামিদ মির, তা নামিয়ে নিজের দিকে তাকাতে বলি, পাকিস্তানের দিকে নজর দিতে বলি। দুই দেশের সম্পর্ক যদি তলানিতে গিয়েই দাঁড়ায়, তাহলে সে জন্য হামিদ মিরের পাকিস্তানই দায়ী, কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন। মির সাহেব অনুসন্ধান করলেই জবাব পাবেন।
ভারত ও পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার সময় দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি ও ইসলামাবাদ সফর করেন। মুম্বাইতে তাজ হোটেলে হামলার পর তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আঞ্চলিক টাস্কফোর্স গড়ে তোলার জন্য। কেন তা কার্যকর করা যায়নি, হামিদ মির তাঁর দেশের প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।
মাত্র গত বছর সীমান্তে হত্যা নিয়ে পাকিস্তান-ভারতের রণপ্রস্তুতি ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেও স্থির কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই দুই পক্ষকে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে, বুঝতে হবে, যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়।’ বিশেষ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে অনুষ্ঠেয় সার্ক সম্মেলন স্থগিত হয়ে গেলে সার্কের অস্তিত্বই যখন সংকটে পড়ে, নানামুখী চাপের মধ্যেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বলেন, সার্কের প্রয়োজন এখনো ফুরিয়ে যায়নি, সময়ই বলবে সার্ক টিকে থাকবে কি না। তিনি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাননি।
বিপরীতে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় পাকিস্তানে। ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশ তার নাগরিকদের অপরাধের বিচার করবে, তাতে পাকিস্তানে উত্তেজনা দেখা দেবে কেন? কেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে শিশু ও নারী হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ আর অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রমাণিত সত্যের ভিত্তিতে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড হলে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব ওঠে? কেন সব কূটনৈতিক রীতি লঙ্ঘন করে পাকিস্তানের মন্ত্রী বা কতিপয় রাজনীতিক বাংলাদেশের একান্ত নিজস্ব বিষয়ে নাক গলান?
তাই হামিদ মিরকে বলি, যদি ওই অপরাধীদের পাকিস্তান তার নাগরিক বলে মনে করে, তাহলে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিক। তাদের আইনগত সহায়তা দিতে বাংলাদেশের আইন মেনে এগিয়ে আসুক। ওদের পরিবার-পরিজনকে পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে সসম্মানে পাকিস্তানে নিয়ে যাক, বাংলাদেশের কোনো আপত্তি নেই। যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি পাকিস্তানের প্রকাশ্য ও ন্যক্কারজনক সমর্থনের প্রতিবাদেÿ ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্কচ্ছেদের জন্য উচ্চকণ্ঠে সোচ্চার, তখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্ত দিয়ে বলেন, ‘আজকের পৃথিবীতে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকবে, প্রয়োজনে “ঝগড়া”ও চলবে।’
হামিদ মির কি পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে বিশ্লেষণ করে বলবেন, ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক কাদের কারণে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে? খোঁজ নেবেন, পৃথিবীর পার্লামেন্টারিয়ানদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সর্বশেষ সম্মেলনে পাকিস্তান থেকে কেন কোনো প্রতিনিধিদল আসেনি? শুধু সম্মেলনটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে?
হামিদ মির, আপনাকে আপনার বাবার দিকে তাকাতে বলি। পাকিস্তানের কঠিনতম সময়ে তিনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। তিনি পাকিস্তানে লড়েছেন শরিয়া আইনের বিরুদ্ধে, সেই সত্তর-আশির দশকে পাকিস্তানে তিনি লিখেছেন নারীদের সমান অধিকারের পক্ষে, লিখেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার পক্ষে। রাজনীতিতে জড়িয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীই কীভাবে পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, সাহসের সঙ্গে উন্মোচন করেছেন সেই চিত্র।
আজ যে পাকিস্তানের আকাশ আমেরিকান ড্রোনের দখলে, যে পাকিস্তানের অর্ধেক সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে তালেবানরা, যে পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা চষে বেড়ায় ধর্মান্ধ উগ্র গোষ্ঠী, যে পাকিস্তানের রাজনীতি আর ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনী আর সেনা গোয়েন্দা চক্রের হাতে, সেই পাকিস্তানকে আপনি আপনার বাবার চোখ দিয়ে দেখুন, মির সাহেব। যে পাকিস্তান অপরের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অসম্মান করে, সেই পাকিস্তান কারও কাছ থেকে সম্মান প্রত্যাশা করতে পারে না।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ইসলামাবাদে ওআইসি সম্মেলনে গিয়েছিলেন নিজের সিদ্ধান্তে। নানা টানাপোড়েন ছিল, ’৭১-এর নয় মাসে যারা বঙ্গবন্ধুকে বারবার ফাঁসিতে লটকাতে চেয়েছিল, সেই বীভৎস মুখগুলো তখনো পাকিস্তান চালাচ্ছে—সব জেনেও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে গিয়েছিলেন তাঁর বিশাল হৃদয়ের উদারতা নিয়ে। এটিই বাঙালির সংস্কৃতি, বাংলাদেশের সংস্কৃতি। পাকিস্তানের মতো দেশের মধ্য থেকেও বন্ধু খুঁজে বের করে সেই উদারতাকে ধারণ করেই বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনার হাতে তুলে দিয়েছিলেন আপনার বাবার জন্য সম্মাননা। সেই সম্মাননা যদি আপনার কাছে ভারী মনে হয়, তাহলে আপনার বাবার চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কার হবে?
উদারতা ও লড়াই—এই দুইয়ে মিলে বাংলাদেশ ও বাঙালির যে সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতিকে কেউ পরাস্ত করতে পারবে না। নিম্নমানের সংস্কৃতি দিয়ে বাংলাদেশকে হয়তো বিব্রত করা যাবে, তবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে সব নেতাকে অতিক্রম করেই। আশা করি হামিদ মির বার্তাটির মর্ম বুঝতে সমর্থ হবেন।
মনজুরুল আহসান বুলবুল: সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন—বিএফইউজে।