প্রিজন ভ্যানেও এত গাদাগাদি করে আসামিদের নেওয়া হয় না, যেটা হয় গণপরিবহনে। একটি দেশে নাগরিকেরা কেমন আছে, তা প্রবৃদ্ধির রাংতার ঝিলিকে অন্ধ চোখে ধরা পড়বে না। রাংতা কাগজের একদিকে থাকে সোনালি-রুপালি প্রলেপ, অন্যদিকটা মলিন। সেই মলিন দিকটাতেই বসবাস সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। চকচকে দিকটায় থাকেন তাঁরা, যাঁদের কখনো ঢাকা-চট্টগ্রামের বাসের খাঁচায় চড়তে হয় না। যে মা-বাবা সন্তানের এতটুকু কষ্টে বিচলিত হন, তাঁরা বাধ্য হন ওই সব খাঁচায় করে তাদের স্কুল-কলেজে পাঠাতে। আগেকার যুগের ছাত্রছাত্রীরা নদী সাঁতরে, পাঁচ থেকে সাত মাইল হেঁটে স্কুলে যেত। শিক্ষার সেই সংগ্রাম রাজধানীতে এসে আরও কঠিনই হয়েছে।
বছিলা থেকে যাত্রাবাড়ী কিংবা মিরপুর থেকে মতিঝিলের বাসে উঠলেই জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা মালুম হবে। আপনি যে-ই হন, সাধারণ বাসে উঠেছেন মানে ভেড়া হয়েছেন। বাড়ি থেকে মাথা উঁচু করে বের হওয়া যাত্রীরা বাসেও ওঠেন মাথা উঁচু করে। নামার সময় তাঁদের মাথা হেঁট হয়ে থাকে। গণপরিবহন এখন গণদুর্ভোগের শিক্ষাসফর। এই শিক্ষাসফরে তাঁরা শেখেন, রাজধানীতে ভেড়ার সঙ্গে মানুষের তেমন তফাত করা হয় না।
রাজধানী নাকি দেশের প্রচ্ছদ। এখানে আপনাকে খরচ করতে হবে উন্নত দেশের চেয়ে বেশি, পাবেন পাথুরে যুগের নাগরিক জীবন।
ধাক্কাধাক্কি, গরম, জ্যাম, ধুলা, কনডাক্টরের ধমক মানতে হবে। মানতে হবে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়। তরুণী ও কিশোরীরা যে মন নিয়ে বাসে ওঠে, নামার সময় কষ্টে ও যন্ত্রণায় তা মুষড়ে থাকে। কেউ মেনে নেয়, কেউ কাঁদে, কেউবা প্রতিবাদ করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মার খায়। ছাত্রদের সঙ্গে বাসওয়ালাদের মারামারি নিয়মিত ঘটনা। গাড়ির ফিটনেস না থাকুক, চালকের লাইসেন্স না থাকুক, অন্যায়ভাবে ভাড়া বাড়ানোর লাইসেন্স দেওয়া আছে। পরিবহনমালিকদের সিন্ডিকেটের কাছে যাত্রীরা অসহায়। কারণ, সরকার তাঁদের পক্ষে। বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়াকে দোষারোপ করে বলেছিলেন, ‘তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ আমাদের সরকারগুলো জনগণের কথা শোনে না, শোনে মালিকশ্রেণির কথা।
দুঃখের দেশে কষ্টের জীবন কাটানো এক পিতা একবার হাহাকার করে উঠলেন: আর তো সয় না, আর কত? সেই কথা শুনে শিয়াল পণ্ডিত সান্ত্বনা দেয়, ‘আর কয়টা বছর সহ্য করো, তারপর আর করতে হইব না!’ মাঝবয়সী মানুষটা আশা নিয়ে তাকান পণ্ডিতের দিকে। ‘তারপর কী হবে, শান্তি পাব?’ বিজ্ঞ শিয়াল লেজ নাড়াতে নাড়াতে বলে, ‘তারপর তো তুমি মারা যাইবা, তোমার ছুটি। কষ্ট করব তোমার ছেলেমেয়েরা।’ এই বন্দোবস্তেই দেশ চলছে। বড়রা কষ্ট করছে, এখন ছাত্রছাত্রীদের পালা। সড়কে গতি নেই, দুর্গতিতে ভরপুর। আজকের দুনিয়ায় গতিই জীবন, গতিই উন্নতি, গতিই সমৃদ্ধি। দুর্গতিতে ভরা সড়কে অগতির চলাচল মানে জীবনেই পিছিয়ে পড়া। এ রকম ঠেলা-ধাক্কার গণপরিবহন যে দেশে থাকে, তাকে উন্নত তো দূরের কথা, সভ্যও বলা যায় না। আধা ঘণ্টার রাস্তা যদি ‘প্রাগৈতিহাসিক কালের’ পরিবহনে দুই ঘণ্টায় যেতে হয়, তাহলে একবারের জন্য পাওয়া এই ধন্য দেশের ধন্য জীবন থেকে কতগুলো বছর হারিয়ে যায়, কত প্রাণশক্তি নষ্ট হয়, কত যন্ত্রণা নিতে হয়, তার হিসাব করলেই বোঝা যাবে কেন আমরা পিছিয়ে থাকি, কেন আমাদের স্বাস্থ্য ভঙ্গুর, কেন আমাদের মেজাজ অস্থির।
ছাত্রদের ঐতিহাসিক ১১ দফায় শিক্ষার্থীদের জন্য বাসে-ট্রেনে অর্ধেক ভাড়ার দাবি ছিল। শ্রমিকের আন্দোলন হয়েছে, তাতে ন্যূনতম মজুরিসহ মানুষের মতো বাঁচার বন্দোবস্ত করার দাবি ছিল। পূরণ না হওয়া দাবিগুলো জমে জমে বিদ্রোহ হয়, বিদ্রোহ স্বাধীনতাসংগ্রামের জোয়ার আনে। দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার সোপানগুলো তৈরি করে ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ ক্ষণস্থায়ী।
দীর্ঘদিন একই ধরনের নির্যাতন চলতে থাকলে একসময় মানুষ প্রতিবাদ করা বন্ধ করে দেয়। মনে করে, এটাই বাস্তবতা। কিন্তু একেকটা প্রজন্ম আসে, তারা মানতে চায় না। কষ্ট পেতে ভালোবাসে না কেউই। ভালোবাসে না বলেই বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। পাকিস্তানি শাসকেরা শিক্ষার সর্বজনীন সুযোগ দিতে চাননি বলে আন্দোলন হয়েছে। ছাত্রদের ঐতিহাসিক ১১ দফায় শিক্ষার্থীদের জন্য বাসে-ট্রেনে অর্ধেক ভাড়ার দাবি ছিল। শ্রমিকের আন্দোলন হয়েছে, তাতে ন্যূনতম মজুরিসহ মানুষের মতো বাঁচার বন্দোবস্ত করার দাবি ছিল। পূরণ না হওয়া দাবিগুলো জমে জমে বিদ্রোহ হয়, বিদ্রোহ স্বাধীনতাসংগ্রামের জোয়ার আনে। দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার সোপানগুলো তৈরি করে ছাত্রছাত্রীরা। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ ক্ষণস্থায়ী। নতুন নামের রাষ্ট্র নতুন কায়দায় পুরোনো খেলা চালিয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে অর্জিত অধিকারগুলো একে একে যেভাবে কাটা পড়েছে, প্রবীণেরা অনেকে বলতে থাকেন যে আগেই তো ভালো ছিলাম।
পাকিস্তান কোনো অধিকারই আপসে দেয়নি। রক্তপাত হয়েছে, ত্যাগের বন্যা বওয়াতে হয়েছে। এখন আবার আমাদের বলতে হচ্ছে, চাকরি দাও, জিনিসপত্রের দামে আগুন নেভাও, জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বন্ধ করো, ভবিষ্যতের আশা কেড়ে নিয়ো না। কারা আর বলবে, ছাত্রছাত্রীরাই বলছে। অনিশ্চিত জীবিকার ভয়ে তারা কোটা সংস্কারের আন্দোলনে নামে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট বসানোর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সড়কে দুর্ঘটনা নামক কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কিশোর-কিশোরীদের নিষ্কলুষ বিদ্রোহকেও পিটিয়ে ঠান্ডা করা হলো। এত নির্মমতা সয়েও আবার তারা বাসে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন করছে। রাজনীতি তারা হয়তো বোঝে না, কিন্তু তাদের আন্দোলনগুলো একটা সত্য জানাতে চাইছে যে সড়কে গণতন্ত্র চাই। সড়কে জুলুম ও ভাড়ার নামে শোষণ চলতে থাকা মানে সড়ক আসলে খুল্লামখুল্লা স্বৈরতন্ত্রের কবলে।
তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে বাসের ভাড়া বাড়ানো হলো। একে অনেকে বলেছেন ‘নিয়মসংগত’ লুণ্ঠন। সেই অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো ভাড়ার অর্ধেক নিতে বলছে তারা। এতে লোকসান হবে না বাসমালিকদের। বাসে অল্প কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর ভাড়া অর্ধেক নেওয়া হলেও বাকি সবার পকেট কাটার জন্য ‘গেটলকের’ ওপেন পকেট ব্যবস্থা তো থাকছেই।
এ দেশের ছাত্রসমাজকে স্তিমিত করে ফেলা হয়েছে। তাদের ভেতর থেকে তৈরি করা হয়েছে কিংবা সেই পরিবেশ জারি রাখা হয়েছে, যেখান থেকে তৈরি হয় কিশোর গ্যাং। মাফিয়াতন্ত্রের পিপীলিকা বাহিনী এই কিশোর গ্যাংকে দিয়ে অনেক কিছুই করানো হয়। তাদের বাইরে বারবার সারল্যের জেদ আর মর্যাদার রোখ নিয়ে রাজপথে হাজির হয় শিক্ষার্থীরা। জানিয়ে যায়, কেবল হাফ ভাড়ার পাস নয়, ফুল মানুষের জীবনই চায় তারা। অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ভেড়ার জীবনে অর্ধেক ভাড়ার চেয়ে বেশি কোনো দাবি তারা কীভাবে করবে, যখন দেশের শিষ্ট-ভদ্র নাগরিকেরা মানুষের উপার্জনে অন্যায় হাত বসানো মেনে নিয়েছে! যেমন মেনে নেওয়া হয়েছিল কিশোর আন্দোলনের ওপর বলপ্রয়োগের ওপেন কসরত।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
faruk.wasif@prothomalo.com