বাঘা তেঁতুল

হাতি-সমাচার

.

বন্য হাতিটি যদি মানুষের মতো কথা বলতে পারত, তাহলে বাংলার মাটিতে পা রেখেই তার দেশের শ্রেষ্ঠ কবির একটি গান গাইত, ‘আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি...’। তা শুনে আমাদের দেশের উৎসুক জনতা বলত, ওই কবির ওপর আমাদেরও দাবি আছে এবং প্রত্যুত্তরে গেয়ে উঠত, ‘পথহারা তুমি পথিক যেন গো—ওগো যাও, কোথা যাও।’ উজানের ঢল ও বন্যার পানির স্রোতে প্রায় ৪০ দিন আগে বন্য হাতিটি ভারত থেকে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে।
বাংলাদেশের জঙ্গিদের মতো হাতিটিও গণমাধ্যমে ভালো প্রচার পাচ্ছে কয়েক সপ্তাহ যাবৎ। হাতিটি উদ্ধারে বাংলাদেশ ও ভারতের বন বিভাগের বিশেষজ্ঞ দল যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছে। পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, বিপন্ন হাতিটি আতঙ্কিত লোকজনের ধাওয়ার মুখে বারবার স্থান পরিবর্তন করায় কয়েক দিনের অভিযানেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। শুক্রবার সরিষাবাড়ী পৌরসভার চত্বরে জরুরি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় উদ্ধার টিমের প্রধানসহ বহুসংখ্যক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তি হাতি সম্পর্কে বক্তব্য দেন।
গত ২৮ জুন বন্যার পানির স্রোতে ভারতের বুনো হাতিটি বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে। পরে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সিরাজগঞ্জের কাজীপুর ঘুরে ২৮ জুলাই মধ্যরাতে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার চরাঞ্চলে এসে বন্যার পানিতে অবস্থান নেয়। হাতি উদ্ধারে ৩০ জুলাই ঢাকা বিভাগীয় বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থলে যায়। হাতি উদ্ধার তাঁদের সাধ্যের বাইরে হওয়ায় যাদের হাতি, তাদের সহযোগিতা চাওয়া হয়। আসাম বন বিভাগের একটি তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে আসে।
গত রোববারের প্রথম আলো থেকে জানা গেল, ‘হাতি উদ্ধারে অভিযান ব্যর্থ’। প্রতিবেদনে বলা হয়, হাতিটি উদ্ধারের জন্য শনিবার দুপুর ১২টায় নলকা গ্রামে উদ্ধারকারী হাতি পৌঁছায়। সেই হাতির পিঠে সওয়ার ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের তিনজন ভেটেরিনারি সার্জন। তাঁরা হাতির পিঠে বসে ট্রাঙ্কুলাইজার গানের (লম্বা বন্দুকবিশেষ) মাধ্যমে চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগ করে হাতিটি উদ্ধারের চেষ্টা চালান। তখন বন্য হাতিটি উদ্ধারকারী হাতিটিকে ধাওয়া করলে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ওই সময় পাটখেতে লুকিয়ে থাকা এক ব্যক্তিকে বন্য হাতিটি শুঁড় দিয়ে ধরে ওপরে উঠিয়ে মাটিতে আছাড় মারে। তিনি আহত হলেও স্রষ্টার অশেষ কৃপায় বেঁচে আছেন। উদ্ধারকারী দলের অভিযান চলাকালে আশপাশের কয়েক গ্রামের হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। পত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলে সে দৃশ্য দেখা গেছে। হাতিটি তার সারা জীবনে অত মানুষ কখনো দেখেনি।
ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা তাঁর দেশের হাতিটির প্রশংসা করে বলেছেন, এটি পুরুষ হাতি। এটি এখন পর্যন্ত যথেষ্ট ভালো আচরণ করছে। জনবসতির দিকে তেড়ে যায়নি। উদ্ধারের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এটিকে ভারতে নেওয়া হবে, নাকি বাংলাদেশের হাতির কোনো পালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে।
উদ্ধার করার পর হাতিটির পায়ে শিকল দিলে কোনো সমস্যা থাকবে না। কিন্তু তা না হওয়া পর্যন্ত উদ্বেগের কারণ। ভারতীয় হাতিটি এক বাঙালিকে উঁচুতে তুলে আছাড় মেরেছে। হাজার হাজার বাংলাদেশি তা দেখেছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর তত দিনের ক্ষুধার্ত জংলি জন্তুটি লোকালয়ে ঢুকে যদি গেরস্থের বাড়িঘর লন্ডভন্ড করে এবং মানুষ পিষে মারে, তার দায় কে নেবে?
টিভি চ্যানেলে হাতিটি দেখে করুণা হয়। প্রাণী হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার ওরও আছে। আর মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য ওকে বাঁচতে সাহায্য করা। সে কাজটি আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা করতে পারেননি। প্রশ্ন জাগে, এ রকম একটি বন্য হাতি যদি অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডে, কোরিয়া বা ভিয়েতনামের লোকালয়ে অনধিকার প্রবেশ করত, সেসব দেশের কর্মকর্তারা ৪০ দিনে কী করতেন? তাঁরা আর কিছু করতে পারুন বা না পারুন, মতবিনিময় সভা করে বিপুলসংখ্যক বক্তা দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে শ্রোতাদের মাত করতেন না।
রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিয়ে পুষতে খরচ মন্দ না। তাঁরা যে খুব দক্ষ, তার পরিচয় প্রতিদিন তাঁদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। সে পরিচয় দেওয়া সম্ভব বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে। পঁয়তাল্লিশ বছরে আমাদের কর্মকর্তারা যে সে দক্ষতা ও সক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি, তার প্রমাণ ভূরি ভূরি। ঢাকনাবিহীন কূপে জিহাদ নামের একটি শিশু পড়ে গিয়ে কান্নাকাটি করলেও দুই দিনে তাকে জীবিত উদ্ধার করতে পারি না। নালা, নর্দমা ও ম্যানহোলে পড়ে দুই-তিন বছরে রাজধানীতে মারা গেছে ২৫টি শিশু। কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আমরা ফ্রিগেট কিনতে বা বানাতে চাই, কিন্তু নদীতে লঞ্চ ডুবে গেলে লাশসমেত নৌযানটি উদ্ধার তো দূরের কথা, সেটি ডুবে কোথায় রয়েছে, সেই স্থানও শনাক্ত করতে পারি না। একটি রাষ্ট্র সফল হয় তখনই, যখন তার রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকে প্রজ্ঞা ও পরিণামদর্শিতা এবং কর্মকর্তাদের থাকে নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতা।
হাতি–সমাচারের মূল কারণ হাতি নিজে নয়—বন্যা। ভয়াবহ বন্যা না হলে সে বাংলার মাটিতে আসত না। এখানে এসে সে তার নিজের দুঃখ ও কষ্ট ভুলে গেছে। আমরা টিভিতে দেখছি গবাদিপশুর কষ্ট ও বন্যার্ত মানুষের হাহাকার; আর হাতি তা দেখছে নিজের চোখে ঘুরে ঘুরে। হাতির সঙ্গে আমাদের তফাত হলো, পানির মধ্যে হাতির সামনে টিভি সেট না থাকায় সে দেখতে পাচ্ছে না সারা বাংলাদেশ ভাসছে বক্তৃতার বন্যায়। বন্যার্তরা পানিতে ডুবে মরছে, ত্রাণ না পেয়ে হা–হুতাশ করছে। আমরা চাই পানি নেমে গেলে ক্ষুব্ধ হাতির তাণ্ডবে কারও প্রাণহানি না ঘটুক।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।