বরগুনার কলেজ সড়কে গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দুজন যুবক উপস্থিত পথচারীদের সামনেই আরেকজন তরুণ রিফাত শরীফকে দা দিয়ে কুপিয়েছেন। পরে তিনি হাসপাতালে মারা গেছেন। রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা আক্তার শত চেষ্টা করেও তাঁর স্বামীকে হত্যাকারীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারেননি। বিভিন্ন মাধ্যমে এই আক্রমণকারীদের নাম প্রকাশিত হয়েছে, নিহত তরুণের বন্ধুরা নয়ন ও রিফাত ফরাজীর কথা বলেছেন। নিহত তরুণের বাবার ভাষ্য হচ্ছে, ‘নয়ন ও তার বন্ধু রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী, রাব্বি আকন ফরাজীসহ কয়েকজন মিলে তাঁর ছেলে রিফাত শরীফকে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে ফেলে রেখে যায়।’ এই ঘটনার সময় উপস্থিত পথচারীরা দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। ভাগ্যক্রমে দূর থেকে একজন এই নির্মম আক্রমণের ভিডিও ধারণ করেছিলেন বলে এখন এই ঘটনা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, সামাজিক মাধ্যমে ঝড় উঠেছে, গণমাধ্যমে খবর হয়েছে, পুলিশ এ নিয়ে ‘তৎপর’ হয়েছে। এই ঘটনা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপরে হামলা নয়, একই দলের কর্মীদের অভ্যন্তরীণ কলহের ফলও নয়।
এই ঘটনার পরে এই ভিডিও দেখে সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে, উপস্থিত মানুষ কেন রিফাতকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন না? কেন মাত্র দুজনকে মোকাবিলা করার সাহস কেউ দেখালেন না? আয়েশা যখন একাই হন্তারকদের মোকাবিলা করেছেন, কেন কেউ তাঁর পাশে এসে দাঁড়াননি? এই প্রশ্নগুলো যথার্থ। কিন্তু স্মরণ করা দরকার, এই ধরনের ঘটনা এই প্রথম ঘটেছে তা নয়; প্রায়ই আমরা সামাজিক মাধ্যমে এই ধরনের ভিডিও দেখে অভ্যস্ত যে অনেকের উপস্থিতিতেই একজন বা কয়েকজন কাউকে নির্যাতন করছে, অন্যরা তা প্রত্যক্ষ করছেন নির্বিবাদে। আমরা দেখতে পাই, কোনো একজন নারী লাঞ্ছিত হচ্ছেন, কিন্তু অন্যদের এই নিয়ে বিকার নেই। এই ঘটনা তো নতুন নয় যে কেউ কাউকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করছে দেখে উপস্থিত লোকজন হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন বলে কিছু করতে পারেননি। কেননা, এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। তারপরও এই প্রশ্ন যথার্থ যে কেন কেউ এগিয়ে আসেননি, কেন কেউ এগিয়ে আসেন না। এই প্রশ্ন প্রধানত মানবিক, কিন্তু কেবল মানবিক বিবেচনায় এই প্রশ্ন তুলে বেদনা প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়। এ ধরনের আচরণের জন্য নাম–গোত্রহীন পথচারীদের দোষারোপ করে আমরা সবাই হয়তো সাময়িকভাবে ‘কিছু একটা করার’ সান্ত্বনা পেতে পারব, কিন্তু তাতে এই অবস্থা বোঝা বা তার প্রতিকারের পথ পাওয়া যাবে না। হয়তো এতে করে আমরা আমাদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটাতে পারব, কিন্তু তাতে করে আমাদের দায়িত্ব পালন হবে—এমন মনে করার কারণ নেই।
কেন মানুষ এগিয়ে আসে না, তা বুঝতে হলে আমাদের প্রথমেই নিজেদের এই প্রশ্ন করতে হবে যে এ ঘটনা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে সংঘটিত হলে একটি দলের কর্মী যদি এভাবে আক্রান্ত হতেন, বিশেষ করে বিরোধী দলের কর্মী হলে আমরা এভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতাম কি না। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ যে নিরাপদ, সেটা জেনেই কি আমরা সবাই সরব হয়ে উঠেছি? সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই এই আক্রমণের সঙ্গে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে বিশ্বজিৎ দাস হত্যার ঘটনার তুলনা করছেন। সেই হত্যার সুবিচার হয়নি—এই ধারণা কেবল তাঁর পরিবারের নয়, সাধারণ মানুষেরও। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ এই বিবেচনায় বিশ্বজিৎই একমাত্র নিহত হয়েছেন, তা নয়; বিরোধী দলের কর্মীদের ওপরে হামলা, নির্যাতন, গুম, হত্যা—প্রকাশ্যে, পুলিশি হেফাজতে এবং অপ্রকাশ্যেও ঘটেছে, ঘটছে। সেই বিষয়ে ‘সতর্ক প্রতিক্রিয়া’, আসলে যা প্রতিক্রিয়াহীনতা বা পরোক্ষ সমর্থন, তা–ই কি এই অবস্থার পটভূমি তৈরি করেনি?
যেকোনো হামলার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানেন না হামলাকারী কারা, কারা হন্তারক; কিন্তু তাঁদের মনে এই আশঙ্কা থাকে যে এদের পেছনে আছে ক্ষমতাশালীরা। ক্ষমতার জোর না থাকলে, রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন, অন্ততপক্ষে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘টার্নিং আ ব্লাইন্ড আই’–এর নিশ্চয়তা না থাকলে আজকের বাংলাদেশে কারও পক্ষেই যে নিজের ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ নেই, এটুকু নাগরিকেরা বোঝেন। সেই বোধবুদ্ধি দিয়েই তাঁরা দর্শক হন, বড়জোর ভিডিও করেন। প্রতিরোধ করার তাগিদও সম্ভবত তাঁরা বোধ করেন, কিন্তু সাহস করেন না। যে সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি সর্বব্যাপ্ত হয়ে উঠেছে, সেখানে এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। ভয়ের সংস্কৃতি, আতঙ্ক ও সন্ত্রাস যার উপাদান, তার ক্রমাগত বিস্তারের দিকে তাকিয়ে ২০১৪ সালে লিখেছিলাম যে ভয়ের সংস্কৃতি মানুষকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করে, তাঁর প্রতিরোধের শক্তিকে চূর্ণ করে দেয় (ভয়ের সংস্কৃতি: বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি, প্রথমা প্রকাশনী, ২০১৪, পৃ. ১৯ এবং ১৩৫)। ২০১৯ সালে আমরা সর্বক্ষেত্রে তার প্রকাশ দেখতে পাই।
গত কয়েক বছরে বিচারহীনতা, দায়মুক্তি, ভুতুড়ে মামলা, হত্যা, গুমের কেবল বিস্তার ঘটেছে তা নয়, একে স্বাভাবিকতা দেওয়া হয়েছে। একেই বলা হচ্ছে শাসন। সংবিধানপ্রদত্ত নাগরিক অধিকারগুলো অপসৃত হয়েছে। আর সেই কাজে রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীনরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রবৃত্ত হয়েছে, রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র ক্ষমতাশালী হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, সেই কাজে অংশ নিয়েছেন সমাজের একশ্রেণির মানুষ, যারা সাংবাদিকতার পেশায় আছেন, বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত, সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় এবং টেলিভিশনের পর্দায় যাঁদের উপস্থিতি নিয়মিত। কোনো কোনো গণমাধ্যম আপাতদৃষ্টে নীতিগতভাবেই এগুলোর সমর্থনে অবস্থান নিয়েছে। ফলে, সাধারণ মানুষের ভেতরে অসহায়ত্বের বোধ তৈরি করা গেছে। অন্যদিকে, সমাজে তৈরি হয়েছে এমন একশ্রেণি, যারা এসব বিষয়ে নির্লিপ্ত, কেননা এই ব্যবস্থার সুফল তাঁরা ভোগ করছে; তারা, তাদের পরিবার, তাদের সন্তানেরা নিরাপত্তার এক বলয়ের ভেতরে জীবন যাপন করে।
অত্যাচার, অনাচার, এমনকি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা যে নিষ্ক্রিয়, তার আরেকটি কারণ হচ্ছে সমাজের অভ্যন্তরের পরিবর্তন। তিনটি প্রবণতা এখন বাংলাদেশের সমাজের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে—অসহিষ্ণুতা, প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনাস্থা এবং হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার মানসিকতা। বাংলাদেশের সমাজে উপস্থিত অসহিষ্ণুতার প্রকৃতি ও পরিসর বুঝতে হলে সামাজিক মাধ্যমের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। জাতীয়তাবাদের নামে, ধর্মের নামে, এমনকি সামান্য ভিন্নমতকে কেন্দ্র করে যে ধরনের মন্তব্য প্রকাশিত হয়, তাতেই বোঝা যায় যে এখন কেবল একমত হওয়াই হচ্ছে ব্যক্তির কাজ; দল ও মতের অন্ধত্ব এখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এই অসহিষ্ণুতা এক দিনে তৈরি হয়নি। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহার করে যখন ভিন্নমতকে দমন করা হয়, রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীনেরা যখন ভিন্নমতকে দেশদ্রোহের মতো করেই বিবেচনা করে, যখন যেকোনো ধরনের ভিন্নমত ‘ষড়যন্ত্র’ বলে চিহ্নিত, তখন নাগরিকদের মধ্যে সহিষ্ণুতার বিকাশ হবে—এমন আশা করা বাতুলতা। উপরন্তু, এই অসহিষ্ণুতা এখন ঘৃণায় রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশে যে কোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, মানুষ যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপরে আর ভরসা রাখে না, তার একটা প্রমাণ হচ্ছে যেকোনো ঘটনার পরে ভুক্তভোগীরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের দাবি করেন। ক্ষমতাসীনদের নিকটজনেরাও এখন আর প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের ওপরে ভরসা না রেখে সাধারণ মানুষের সামনে এসে দাঁড়ান; তার সাম্প্রতিক প্রমাণ হচ্ছে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজের ভাগনে অপহৃত হওয়ার পরে তিনি ফেসবুকে সাধারণ মানুষের সাহায্য চান। বাংলাদেশের নাগরিকেরা জাতীয় সংকটের সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলের শরণাপন্ন হতেন, কিন্তু কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনৈতিক দলের আবেদন সীমিত হয়ে গেছে। এটি হচ্ছে বিরাজনীতিকরণের এক ভয়াবহ ফল। বিরাজনীতিকরণ স্বল্পমেয়াদে ক্ষমতাসীনদের জন্য ইতিবাচক, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তার পরিণতি ভয়াবহ।
রিফাত শরীফকে যখন আক্রমণ করা হয়েছে, হত্যা করার রামদার আক্রমণে রক্তাক্ত করা হয়েছে, তখনো মানুষের মধ্যে এই আস্থা থাকেনি যে এদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেওয়া যায়। রিফাতের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আগামী কয়েক দিন আমরা সবাই আলোচনা করব, আক্রমণকারীদের কেউ কেউ হয়তো গ্রেপ্তারও হবে, কিন্তু আয়েশা আক্তার তাঁর স্বামীর, দুলাল শরীফ তাঁর সন্তানের হত্যাকারীদের বিচার পাবেনই—এমন নিশ্চয়তা দেওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপরে আপনি কি ভরসা করতে পারেন? প্রতিদিন আমরা কেবল বিভিন্ন ধরনের হত্যাকাণ্ড, এমনকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে মৌনতাই পালন করি তা নয়, অনেকেই দ্বিধাহীনভাবেই কাকে কখন ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়া উচিত, এই বিষয়ে পরামর্শ দেন। এটাই হচ্ছে হত্যাকাণ্ডের স্বাভাবিকীকরণ।
হত্যাকাণ্ড আমাদের আর স্পর্শ করে না বলেই রিফাত কিংবা অন্য কেউ যখন আমাদের চোখের সামনে খুন হয়ে যান, তখন ভয়ের সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত নিঃসঙ্গ মানুষ হিসেবে আমরা দর্শকের ভূমিকা পালন করি। কিন্তু এই বৃত্তচক্রই শেষ কথা নয়।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর