আবরারকে যখন জীবন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তখন তাঁর খুনিদের কাউকে বাঁচানোর চেষ্টার কথা শুনছি। তখন আমরা আবরারের মায়ের মাতম শুনতে পাই, ‘আমার ছেলেকে পিটায়ে পিটায়ে মেরে ফেলছে, আমার ছেলের না জানি কত কষ্ট লাগছে!’
যার যায় সে বোঝে। সব মায়েরই এমন কষ্ট হয় যখন বুকের ধন অকালে হিংস্র খুনের শিকার হয়—যখন নাকি তার ফুটে ওঠার সময়। আবরার জীবন পেল না, কিন্তু তার খুনিরা কি আরও আরও খুনের জন্য দায়মুক্তির লাইসেন্স পেয়ে যাবে? আমরা ঘরপোড়া গরু, আমরা ঠেকে শিখি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু বকরের খুনিরা পার পেয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জের ত্বকীর খুনিরা যেভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে নতুন জীবন পেয়েছে, সেভাবেই আবরারের খুনিরাও পাবে নতুন জীবন? খুনিরা বেঁচেবর্তে থাকে যে দেশে, অথবা পালিয়ে যায় বিদেশে, তখন সেটা কেমন দেশ? এ কেমন দেশ হলো আমাদের?
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্ররা গণরুমে জেলখানার কয়েদিদের মতো গাদাগাদি করে ঘুমায়। বুয়েট প্রশাসন কি জানত না, হলে হলে টর্চার সেল বসানো হয়েছে? সরকার কি জানত না, ক্যাসিনো সম্রাটেরা যুবলীগের ব্যানারে নির্যাতনকেন্দ্র চালায়, ক্যাসিনো মেশিনের সঙ্গে তারা আমদানি করে ইলেকট্রিক শক যন্ত্রসহ পাশবিক নির্যাতনের সরঞ্জাম? সেসব কেন্দ্র নিয়মিতভাবে ব্যবহৃত হয়। আবরারের মতো উজ্জ্বল জীবনবাদী তরুণেরা সুস্থ-সবল অবস্থায় সেখানে প্রবেশ করে আর বের হয় রক্তাক্ত লাশ হয়ে। আমরা দেখি, দেখতে থাকি, দেখে দেখে দার্শনিক হয়ে যাই। বলি: মরার দেশে জীবন জীয়ে না।
একজন খুনির পতনে বেঁচে যায় সম্ভাব্য খুনের শিকাররা—অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা মানুষেরা। একজন খুনির বেঁচে যাওয়া জীবিতদের বাঁচার ঝুঁকি বাড়ায়। আমার, আপনার, আমাদের সন্তানদের জীবনের ওপর কালো ছায়া ফেলে রাখে তারা। তারা ও তাদের রক্ষকেরা তখন ‘রিএনফোর্সড’ শক্তিতে সমাজটাকে ছাদখোলা খাঁচা, বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্যাতনের খামার আর জীবনটাকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে ফেলে।
আবরারের পড়ার টেবিলে একটা অসমাপ্ত অঙ্ক পৃষ্ঠা ছিল। সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত আবু বকরের রক্তভেজা নোট খাতার অনেক পৃষ্ঠাই ফাঁকা ছিল। তার বৃদ্ধা মা বেঁচে আছেন কি না, তা–ও জানি না। কিশোর ত্বকীর গভীর ভাবুক আবেপ্রবণ মনটাকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চোখ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এহসানের? কখনো কি ভোলা যাবে চাপাতির কোপে ফালা ফালা বিশ্বজিতের বাঁচার আকুতি? তার রক্তভেজা শার্টের ছবি? উনসত্তরের অভ্যুত্থানের শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে ঢাকা শহরে বানের জলের মতো মানুষ নেমেছিল। তারা তাদের দায় মিটিয়েছিল। এদিকে রক্তের ঋণ আমাদের কেবল বেড়েই চলেছে। অঙ্কটা তাই মেলাতেই হবে, জীবনখাতায় আর কত খরচের সংখ্যা লিখব, আর কত মৃত্যুর নামতা মুখস্থ করব?
আবরারের লাশের ওজন কি আমরা বইতে পারব? এ দেশে মানুষ হওয়া বলতে মধ্যবিত্ত হওয়া বোঝায়। আবরারের মতো একটা ছেলে তৈরি করতে, তার ও তার বাবা–মায়ের কত শ্রম, কত রাত জাগা, কত সাধনা করতে হয়েছিল—তার কোনো পরিমাপ কেউ করতে পারবে না। এর পেছনে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বিন্দু বিন্দু ঘাম, অশ্রু, রক্ত, সঞ্চয় ও স্বপ্নের বিনিয়োগ ছিল। তার মতো ছেলেদের, তনুর মতো মেয়েদের ওপর নির্যাতনের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ, ওজন, উচ্চতা, গভীরতা ও নিষ্ঠুরতা তাই মানুষের বোঝার কথা। আবরারের জন্য প্রতিবাদের মিছিলে তাই সবাই শামিল। সেখানে আছে কিশোর আন্দোলনের ফরিয়াদ, সেখানে আছে কোটা সংস্কার আন্দোলনে আহতদের কান্না, সেখানে আছে বিশ্বজিৎ, জুবায়েরসহ অপঘাতে নিহত সবার হাহাকার।
কিন্তু তরুণের রক্ত ছাড়া কি আমরা জেগে উঠতে জানি না? যদি শিক্ষাঙ্গন ও সমাজটাকে দুর্বৃত্তদের খপ্পর থেকে বাঁচানোর জন্য একযোগে কাজে নামতাম, তাহলে হয়তো আবরারদের মরতে হয় না। মানুষ হিসেবে আবরারের বাড়তি কিন্তু জরুরি গুণটা ছিল। সেটাই তার মৃত্যুর কারণ। দেশকে ভালোবাসত খুব। মাকে ভালোবাসত খুব। মাতৃমুখী বাচ্চাটা ছিল মায়ের বাধ্য। আবরারেরা ভালোবাসার বাধ্য হয় খুব। তাই দেশের প্রতি ভালোবাসায় বাধ্য হয়েছিল দেশকে ঠকানোর বিরুদ্ধে কথা বলতে।
আবরারের মতো তরুণদের প্রাণ যাচ্ছে, কেউ হতাশায় আত্মহত্যা করছে, বন্দী অথবা দেশান্তরি হচ্ছে। আবার আবরারের সঙ্গীদের মধ্যে থেকেই তৈরি করা হচ্ছে দখলদারি ও লুটপাটের পদাতিক প্রহরীদের। শুধু আবরারের পরিণতিই আমাদের ব্যথিত করে না, ব্যথিত করে আরও আরও মায়ের আদরের সন্তানদের খুনি হয়ে যেতে দেখা। কোন কারিগর পরিবারের দেওয়া গড়ন ভেঙেচুরে তাদের নিষ্ঠুর খুনি করে তুলল? গ্রেপ্তারের পরেও তাদের মুখে কোনো অনুশোচনার ছাপ না-ফোটা আরও ভয়াবহ।
আবরারের পরিচয় নিরপরাধ নাগরিকের, কোনো নাগরিককেই বিনা বিচারে হত্যা তো দূরের কথা, অপরাধী বলে গালিও দেওয়া যায় না। তার চেয়ে বড় কথা, ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাসগুলোর বিচারক ও শাস্তি তামিলকারী জল্লাদ বানাল কে? জীবন সবারই একটা। সে জীবন কেন এভাবে যন্ত্রণা পেয়ে শেষ হবে? শুধু বিচার চাইলে আবরারের খুনিদের শাস্তি হতে পারে, কিন্তু এই রাজনীতি ও ব্যবস্থা না বদলালে আবরারের খুনি তৈরির কারখানা বন্ধ হবে না। আমরা চাই না কেউ আবরার হোক আর কেউ খুন করে ঘৃণিত হোক। সবাই আমাদেরই সন্তান, সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। দেশটাকে মানবিক করা ছাড়া আমরা আপন-পর কাউকেই বাঁচাতে পারব না। হত্যার লটারিতে কাল যে আপনার নাম উঠবে না, তা কীভাবে নিশ্চিত করবেন?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.com