হঠাৎ তুফানের এক সকালে ঢাকার মানুষেরা

চারদিক দেখে মুখ থেকে বেরিয়ে এল ‘কী আন্ধার!’ শুনে মেয়ে খুব মজা পেল।

গত মঙ্গলবার ভোরে আকাশ অন্ধকার করে ঢাকায় তখন অকালের কালবৈশাখী এসেছে। উথাল-পাতাল হাওয়া আর বৃষ্টির মধ্যে উবার ডেকে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি।

সাতমসজিদ রোডে গাড়ি আর রিকশার ভিড়টা আবছা আন্ধারে হালকা ঠেকে। ফুটপাতে দেখি, সাদা পাঞ্জাবি পরা দুই কিশোর হাতে একেকটা লাউ নিয়ে বৃষ্টি মাথায় করে ছুট লাগিয়েছে। ফলের দোকানগুলোয় উজ্জ্বল সাদা বাতির নিচে রঙের বাহার।

একটা প্লটের টিনের দেয়ালে লেখা ‘খেলাঘর’। মনে হলো যেন প্লটটা ফাঁকা, শিগগিরই হয়তো মাথা তুলবে বহুতল দৈত্য। রাস্তার ধারে ময়লার স্তূপে কে আগুন দিয়েছিল, ক্ষীণ ধোঁয়ার রেখা।

ঝড়বাদলের আবছায়ায় এসব দেখতে দেখতে চেনা মোড় হারিয়ে ফেলে ঘুরপথে মেয়েকে লালমাটিয়ায় স্কুলে নামালাম। রিকশা করে এলাম ধানমন্ডি সাতাশে মীনা বাজারের গলিতে।

ততক্ষণে বৃষ্টি ঝিমিয়ে পড়েছে। রাস্তার পাশে সবজিবিক্রেতার নীল লুঙ্গি হাওয়ায় ফুলে উঠছে। সাদা-খয়েরি মাফলারে মাথা ঢেকে লোকটি দ্রুত হাতে পলিব্যাগ থেকে লাউ বের করে ভ্যানে সাজাচ্ছেন।

অনেক দেরি হয়েছে, ব্যতিব্যস্ত সাদ্দাম।

নাম তাঁর সাদ্দাম। কথা বলতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘সময় নাই।’ রায়ের বাজারের সাদেক খান কৃষি মার্কেট থেকে মাল এনে সাতটা নাগাদ পসরা সাজান তিনি। বৃষ্টিতে দেরি হয়ে গেছে। আজ বেচাবিক্রি হবে? ‘হেইডা কি কারও বলার কায়দা আছে? আল্লাহ বলতে পারে!’

রিকশা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন যেজন, তাঁর নাম সাইফুল। গোলাপি আর নীল পলিথিনে শরীর মোড়া। মাথায় সাদা পলিথিনের ঠোঙার ওপর বৃষ্টির ফোঁটা। বললেন, সকাল ছয়টায় আদাবর থেকে রিকশা বের করেছেন।

এত সকালেও সওয়ারি পেয়েছেন সাইফুল—‘মানুষ ইশকুল যায়, অফিস যায়, বাজার করে...।’ আজকে বৃষ্টি হলো হঠাৎ। তাঁর আনন্দ লাগে, তবে ঠান্ডাও লাগে। বৃষ্টিতে খুব কষ্ট।

সাইফুল বেরিয়েছিলেন ভোর ছয়টায়।

দোতলায় একটা কফিশপে কাচের দেওয়ালের পাশে বসি রাস্তা দেখতে। গাড়ি, রিকশা, মোটরসাইকেলের জট বাঁধছে। ফুটপাতে স্কুলব্যাগ কাঁধে মা-বাবার হাত ধরে বাচ্চারা চলেছে, রাস্তা পার হচ্ছে। ঘোড়ানিম আর দেবদারুগাছগুলোর পাতারা দুলছে, ঝরে পড়ছে।

আমার গরম কাপুচিনোর কাপটা নিয়ে এলেন সজীব। বললেন, ছয়টা চল্লিশে এসে সাতটায় দোকান খুলেছেন। এখানে বসে বৃষ্টি দেখতে দেখতে গাজীপুরে গ্রামের বাড়ির কথা মনে পড়েছে। সেখানে বাদলদিনে তাঁরা ফুটবল খেলতেন, বৃষ্টিতে ভিজতেন।

বাদলদিনে গ্রামের কথা মনে পড়ে সজীবের।

নিচে নেমে আপন জুয়েলার্সের বিজ্ঞাপনে মোড়া পুলিশ বক্সটার দিকে যাই। জানালায় এএসআই মনির। বললেন, ছয়টায় পুলিশ লাইন থেকে বেরিয়েছেন। মোহাম্মদপুর থানার এই চেকপোস্টে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত তাঁর ডিউটি।

মনির হেসে বলেন, মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হলে ভালোই লাগে। ধুলাবালু থাকে না। ধুলাবালুতে রাস্তায় ডিউটি করতে খুব কষ্ট হয়।

ভ্যানের নিচে কুঁকড়ে গোল হয়ে ঘুমাচ্ছে কালো কুকুর। বৃষ্টি থামছে, মানুষ ছুটছে। সাতমসজিদ রোড দিয়ে ধানমন্ডি লেকের দিকে যেতে দেখি, ফুটপাতে ভ্রাম্যমাণ চাওয়ালার কাছে বসে জমিয়ে চা খাচ্ছেন বুড়ো একজন মানুষ।

বৃষ্টি হলে ধুলাবালি থাকে না—এএসআই মনির।

আমার সঙ্গেই লেকপাড়ের হাঁটাপথে উঠলেন কয়েকজন নানাবয়সী মেয়ে। তাঁরা ধানমন্ডির বাসাবাড়িগুলোয় ঠিকা কাজ করেন। নিমেষে আমাকে পেরিয়ে হনহনিয়ে তাঁরা চলে গেলেন। দাঁড়ানোর ফুরসত নেই।

পার্কের একধারে চৌকি পেতে পত্রিকা সাজাচ্ছিলেন মো. জসিমউদ্দিন। বৃষ্টিতে হাঁটুরে লোকজন কম। তাঁরও আসতে দেরি হয়েছে।

১৮ বছর ধরে পত্রিকা বিক্রি করছেন জসিমউদ্দিন। তিনি ব্যাপক হতাশ। বললেন, ‘পত্রিকা কি এখন মানুষ পড়ে? সবাই এখন ফেসবুক, অনলাইন নিয়া ব্যস্ত। মোবাইলে টিপ দিলে পাইতেছে সারা বিশ্বের খবর।’ কাগজের বাসি খবর কে পড়বে?

পাঁচটা বেছে কেউ হয়তো কালেভদ্রে কম দামের একটা কাগজ কেনেন। একটা সময় ছিল, জসিমউদ্দিন এখানে ২০-৩০-৪০টা প্রথম আলোও বিক্রি করেছেন। এখন আটটা আনেন, পাঁচটা হয়তো ফেরত যায়।

ইদানীং একটা খুচরো চাকরি জুটিয়েছেন। কাগজওয়ালাদের ওপর জসিমউদ্দিনের খুব রাগ। তারা কেন সব খবর অনলাইনে তুলে দেয়?

অনলাইনের ওপর মহা বিরক্ত জসিমউদ্দিন।

বৃষ্টিতে বেচাবিক্রির আশা প্রায় নেই। তবু বৃষ্টি হলে মন কি খুশি হয়? জসিম বলেন, বৃষ্টি তো আল্লাহর রহমত। তবে কেউ খুশি, কেউ না। ফসলের জন্য ভালো। সকালে মোবাইলে গ্রামে খোঁজ নিয়েছেন। সেখানে বৃষ্টি হয়নি।

কাছেই দ্বীপের রেস্তোরাঁয় খানেওয়ালা নিতান্তই কম। তন্দুরের পেছনে কিশোর কর্মচারীরা মশগুল হয়ে সস্তা দরের স্মার্টফোন পেতে লুডু খেলছে।

বৃষ্টি হলে মন চায় ঘুমাতে।

সবচেয়ে ছোটটি কিন্তু লম্বা ঝাড়ু দিয়ে ঝরা পাতা সরানোয় ব্যস্ত। কাজে এসেছে সে খুব ভোরে, ঝড়ের আগে। এমন দিনে তার মন কী চায়? বালক অন্তরখোলা হাসি দিয়ে বলে, ‘মনে চায় তো অনেক কিছুই। ঘুমে ধরে। আবার খাইতে ইচ্ছা করে...।’

লেকপাড়ে অল্প দূরে দূরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনেকগুলো ত্রিকোণ সাইনবোর্ড—‘ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকা’। নিচে বাণী, ‘ভিক্ষুকমুক্তকরণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে মহৎ কাজে সম্পৃক্ত হোন।’

দ্বীপের সেতুর গোড়ায় শুকনো পাতা পেতে বিরস মুখে বসে ছিলেন এক বৃদ্ধা। আমাকে দেখে টাকা চাইলেন। আমি ছবি তুলতে চাইলে তিনি ছিটকে উঠে গেলেন। বিশাল রেগে হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘তুমি যাও তো! মরলে মাটির তলে যামু না?’ ছবি তুলে কি পরকাল খোয়াবেন?

ভিক্ষুক যাক, ময়লা থাক!

বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ার সেই সকালে লেকের পানিতে শুকনো পাতা, প্লাস্টিকের ঠোঙা আর হাজারো আবর্জনার বান ডেকেছিল। পাড়ের ঢালজুড়ে ভাঙা কমোড থেকে শুরু করে বিচিত্র জঞ্জালের গাদা।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের ঝান্ডা তুলে সিটি করপোরেশন ভিক্ষুক খেদাচ্ছে, কিন্তু আশপাশের বিত্তবান বাসিন্দা আর পদচারীদের বলেকয়ে লেক তো ময়লামুক্ত করতে পারছে না?

কুররাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা: সাংবাদিক
qurratul.tahmina@prothomalo.com

আরও পড়ুন:
সরকারি প্রাথমিক স্কুলে, সাম্মিরের বালিশের খোঁজে