অক্টোবর চীনের ইতিহাসে অনন্য মাস। এই অক্টোবরে ৭০ বছর পূর্ণ হলো গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের। এ নিয়ে মাসের প্রথম দিন ব্যাপক উৎসবও হয়ে গেল তিয়েনআনমেন চত্বরে। তবে সেদিনও চীনের চেয়ে বিশ্ব সংবাদমাধ্যম দখল করে রেখেছিল হংকং। সেখানকার প্রত্যর্পণ বিলবিরোধী আন্দোলন নিয়েই দুনিয়াব্যাপী যত আলাপ-আলোচনা এখন। আর এই অভূতপূর্ব ছাত্র আন্দোলনে ক্রমে বিশাল ছায়া বিস্তার করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন এডওয়ার্ড লিয়ুং নামের এক তরুণ, কারাগারে থেকেই যিনি ক্রমে চীনের আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি হয়ে উঠছেন।
এ বছর ইরান বিপ্লবেরও ৪০তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। গত শতাব্দীর বিশ্বে তিনটি বড় রাজনৈতিক ঘটনার দুটি ছিল গণচীন ও ইরানের বিপ্লব। হংকংয়ে এডওয়ার্ড লিয়ুংয়ের উত্থান ইঙ্গিত দিচ্ছে, মাও সে-তুং কিংবা আয়াতুল্লা খোমেনির পরও পরিবর্তনের রাজনীতি দুনিয়াব্যাপী থেমে নেই। পাল্টাচ্ছে কেবল তার ধরন। পাল্টাচ্ছে ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রতিবিপ্লব’-এর মানে। তরুণেরা ক্রমে রাজনীতিতেই আগ্রহ দেখাচ্ছে; আর কর্তৃত্ববাদীরা হুমকি দিয়ে যাচ্ছে; যেভাবে আংকেল শি হংকংয়ের বিক্ষোভকারীদের পরোক্ষভাবে ‘হাড় গুঁড়ো করে দেওয়া’র হুমকি দিলেন নেপাল সফরকালে, ১৩ অক্টোবর।
হংকংয়ের আন্দোলন উপনিবেশবিরোধী চেতনার প্রকাশ
হংকংয়ে বিরতিহীনভাবে নাগরিক অসন্তোষ চলছে চার মাস হলো। এই আন্দোলন মাঝেমধ্যে সহিংস রূপও নিচ্ছে। এই আন্দোলনকে বৈশ্বিক প্রচারমাধ্যম ‘প্রত্যর্পণ বিলবিরোধী আন্দোলন’ বলে উল্লেখ করত শুরুতে। এটা সত্য, হংকং থেকে ‘সন্দেহভাজন’ অপরাধীদের মূল চীনে নেওয়ার আইন ঠেকাতে এই আন্দোলন। ওই আইনকে হংকংবাসী দেখছিল তাদের উপনিবেশ হিসেবে গণ্য করার চীনা চেষ্টা হিসেবে। চীন যে হংকংয়ের জাতীয়তাবাদী এবং ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিকদের তুলে নেওয়ার কাজে এই আইন ব্যবহার করত, তার নজির এডওয়ার্ড লিয়ুংয়ের কারাবাস। চীন এ ধরনের বন্দীদের মূল ভূখণ্ডের কারাগারে রাখতে পারলেই স্বস্তি পেত।
তবে প্রত্যর্পণ বিল প্রত্যাহারের পরও আন্দোলন বন্ধ হয়নি, যা সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই আন্দোলনের দাবিদাওয়া ও গভীরতা বুঝতে পর্যবেক্ষকদের গাফিলতি আছে। এটা কেবল একটা আইনবিরোধী হঠাৎ সৃষ্ট আন্দোলন নয়; এই আন্দোলনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন খোঁজারও চেষ্টা চলছে। কিন্তু যড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে হংকংয়ের এই প্রতিবাদ অধ্যায়কে বুঝতে যাওয়া বড় ধরনের সংকীর্ণতা। এই আন্দোলন কার্যত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্ববাদী শাসনই চ্যালেঞ্জ করছে। এটাও আবার আন্দোলনের একটা দিক মাত্র।
হংকংয়ের বিদ্রোহ স্পষ্টত নতুন এক উপনিবেশবিরোধী চেতনা, যা প্রমাণ করছে বিখ্যাত সব স্বাধীনতা ও বিপ্লবী আন্দোলনের পরও সমাজে উপনিবেশবাদী মনস্তত্ত্ব রয়ে যায় এবং তার বিরোধিতারও জন্ম হয়। লিয়ুং সে রকম এক বিদ্রোহেরই প্রতীক, যিনি হংকং বিদ্রোহের মূল নায়ক নন, কিন্তু সেখানকার তরুণ-তরুণীদের রাস্তায় পড়ে থাকতে তিনি প্রধান এক উদ্দীপনা। তাঁর প্রভাবেই প্রত্যর্পণ বিলবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে হংকংয়ে ক্রমে দানা বাঁধছে স্থানীয় ‘পরিচয়ের রাজনীতি’। ইতিহাসে ‘উন্নয়নের রাজনীতি’র পাশাপাশি এই পরিচয়ের রাজনীতির আবেদনও বড় কম নয়—প্রমাণিত হচ্ছে বারবার।
কারাগারে থেকেও আন্দোলনে আছেন এডওয়ার্ড লিয়ুং
হংকংয়ের চলতি আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছাত্ররা। কিন্তু শুরু থেকে এই আন্দোলনে অন্য পেশাজীবীদের নীতিগত সমর্থন আছে। দু–একবার প্রায় ১০ লাখ মানুষের মিছিলও হয়েছে স্বাধিকার চেতনার সমর্থনে। ৭০ লাখ জনসংখ্যার ভূখণ্ডে এত মানুষ যখন কোনো আন্দোলনে শরিক হয়ে যায়,Ñতখন সেটাকে মনোযোগ দিয়ে না দেখে উপায় থাকে না। প্রত্যর্পণ বিল সাময়িকভাবে প্রত্যাহারের পর, এখনো, সর্বশেষ মাঠে আছে শত শত তরুণ-তরুণী। এরা অধিকাংশই স্থানীয় জাতীয়তাবাদী এডওয়ার্ড লিয়ুংয়ের সমর্থক। এরা বাড়তি কিছু নিয়ে ঘরে ফিরতে চায়।
লিয়ুংয়ের ছয় বছরের জেলজীবনের প্রথম বছর চলছে এ মুহূর্তে। দাঙ্গার অভিযোগে এই সাজা। তাঁর আরও কয়েক সহযোগী একই মামলায় কারাগারে। ‘হংকং ইন্ডিজেনাস’ নামের জাতীয়তাবাদী সংগঠনের স্বঘোষিত মুখপাত্র তাঁরা। ২০১৫ সালে কেবল এই সংগঠনের জন্ম। আর এখন তাঁরা ‘জাতি’র প্রেরণায় পরিণত হয়েছেন।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের ছাত্র থাকাকালে ২০১৬ সালে এক স্থানীয় নির্বাচনে লিয়ুংয়ের ৬০ হাজার ভোটপ্রাপ্তি থেকে বোঝা যাচ্ছিল, চীনবিরোধী স্থানীয় জনমত কত ব্যাপক। সেই নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। হকারবিরোধী পুলিশি অভিযানের বিরুদ্ধে এক দাঙ্গায় যুক্ত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছিল তাঁকে। এমনকি পরবর্তী যেকোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয় এই তরুণকে,তাঁর ‘স্বাধীনতাপন্থী’ বক্তব্যের জন্য। এরপর তাঁকে পুরোপুরি থামিয়ে দিতেই ২০১৮ সালে ছয় বছরের দণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। আদালতে তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করেননি যে রাস্তায় পুলিশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই সততা ও সাহসই বিদ্যুচ্চমকের মতো আলো ছড়িয়েছে হংকংয়ের তরুণদের মধ্যে।
এটা এখন পরিষ্কার, গত জুন থেকে শুরু হওয়া তরুণবিদ্রোহকে লিয়ুং মানসিকভাবে প্রভাবিত করেছেন ব্যাপকভাবে। খামেনি যেভাবে প্রবাস থেকে ইরান বিপ্লবকে প্রস্তুত করে তুলছিলেন ৪০ বছর আগে।
১০ অক্টোবর লিয়ুং কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতির জন্য হংকং হাইকোর্টে এলে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী সেখানে জমা হয়। এরা অনেকে সকাল ছয়টা থেকে অপেক্ষা করছিল এডওয়ার্ড লিয়ুংকে নিয়ে আসা প্রিজন ভ্যানটির জন্য। অপেক্ষাকারীরা কিছুক্ষণ পরপরই গাইছিল ‘এইটিন’ নামের একটা গান। যাকে এখন বলা হচ্ছে হংকংয়ের আন্দোলনকারীদের ‘জাতীয় সংগীত’। অনলাইনেই এই গানের প্রকাশ ও প্রসার। তরুণ-তরুণীদের ভাষায় এই গানের মধ্যে তারা খুঁজে পায় ‘হংকংয়ের গৌরব’। ইতিহাসের পরিহাস, এই ধরনের গৌরব নিয়েই মাও সে–তুংয়ের চীন একদা জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়েছিল।
এডওয়ার্ড লিয়ুংয়ের সমবয়সী ভক্তরা তাঁর মামলার খরচ জোগানোর জন্য অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সাড়ে তিন লাখ হংকং ডলার জোগাড়ের ডাক দিলে ফেসবুকে ১৫ মিনিটে সেই অর্থ জোগাড় হয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে ১ হাজার ২৬৮ জন ৪ লাখ ৫৩ হাজার হংকং ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করে অভূতপূর্ব এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
অদ্ভুত বিষয়, যারা এই অর্থ সংগ্রহ করছে এবং যারা দিচ্ছে, সবাই এডওয়ার্ড লিয়ুংকে মনে করছে তাদের সাম্প্রতিক যাবতীয় তৎপরতার আধ্যাত্মিক উৎস হিসেবে। হংকংয়ের ইতিহাসে এই প্রথম আদালত চত্বরে সম্মিলিত স্লোগান ওঠে, ‘হংকংকে মুক্ত করো, এটাই আমাদের বিপ্লব’। কথাটি লিয়ুংয়েরই। ২০১৬ সালে তিনি এটা বলেছিলেন ব্যক্তিগতভাবে। গত জুলাইয়ে কারাগার থেকে এখনকার আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে লিয়ুং বলেছেন, ‘তোমরা হংকংয়ের নতুন ইতিহাস রচনা করছ।’ রাজপথের জ্বালানি হিসেবে এই বাক্য ভূমিকা রেখেছে এখন। চীনকে বিরক্ত করার জন্য এসব প্রকৃতই অনেক কিছু। তবে হংকংয়ের পরিস্থিতি এখনো রাবার বুলেট আর কাঁদুনে গ্যাসেই সীমাবদ্ধ আছে। যদিও পুলিশ এ খবরও জানাচ্ছে, ১৩ অক্টোবর বিক্ষোভকালে ঘরে তৈরি দূরনিয়ন্ত্রিত বোমার ব্যবহারও নাকি ঘটেছে। লিয়ুং নিজেও বিক্ষোভে জঙ্গিদের পক্ষে।
যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র দেখছে চীন
চীন প্রথম থেকে এই আন্দোলনকে পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে। কড়া ভাষায় নিয়মিত আন্দোলনকারীদের চরিত্রহনন ও সমালোচনা করা হচ্ছে। তবে এখনো পিপলস লিবারেশন আর্মিকে লেলিয়ে দেওয়া হয়নি। সেটা করা হবে না—এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। চীনের প্রচারমাধ্যম প্রতিনিয়ত হংকংয়ে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। এসব হুমকিতে লেগে আছে ৩০ বছর আগে তিয়েনআনমেন ছাত্র আন্দোলন দমনের কুখ্যাত স্মৃতি। ১৯৮৯ সালের জুনেই সেই দমন অভিযান হয়েছিল। এবারও জুনেই ঘটল হংকংয়ের গণঢেউ।
তবে পিপলস আর্মি আবারও ৩০ বছর আগের মতো কিছু ঘটালে চীনের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ঝুঁকি আছে তাতে। হংকংজুড়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে তখন। এডওয়ার্ড লিয়ুংয়ের অনুসারীরা নিশ্চিতভাবেই সরাসরি হংকংয়ের স্বাধীনতার কথাই বলবে তখন। চীনের জন্য হংকং তাই গুরুতর এক রাজনৈতিক দুর্ভাবনা এ মুহূর্তে। একই ঝুঁকির মুখে তিব্বত ও শিনজিয়াংয়ে স্থানীয়দের স্বাধিকার চেতনার বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে বেইজিংকে বহুদিন। চীনের জন্য খারাপ বার্তা হলো, ইতিমধ্যে মূল চীনের বাসিন্দারা হংকংয়ের বিভিন্ন দপ্তরে, রেস্তোরাঁয়, আড্ডায় ঘৃণাসূচক পরিস্থিতির মুখে পড়ছেন। গত জুনে এক জরিপে ৭৫ ভাগ স্থানীয় তরুণ (১৮-২৯) চীনের চেয়ে হংকংয়ীও জাতীয়তায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের কথা জানিয়েছে। একই জরিপে এ রকম তথ্যও ছিল, ৯৯ ভাগ হংকংবাসী চীন থেকে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে বলে মনে করে না। পরিচয়ের রাজনীতি এবং মাঠের বাস্তব শঙ্কার এই যে ব্যবধান সেটাই পূরণ করতে তৎপর লিয়ুং। কিন্তু চীন তাঁকে আর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মাঠে নামতে দেবে বলে মনে হয় না।
আন্দোলনের পেছনে শ্রমিক সংগঠন; আছে ধনীরাও
হংকংয়ের আন্দোলন যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশের জন্য একটা সুখদায়ক অভিজ্ঞতা, তা লুকানো নেই। যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এই আন্দোলনের সমর্থনে সহানুভূতির কমতি নেই। এই দেখে, তৃতীয় বিশ্বের অনেকে এই আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন ইন্ধনও খুঁজছেন। কিন্তু প্রচুর স্থানীয় ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী এই আন্দোলনে যুক্ত। তারা আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী করতে মূল শক্তিভিতের কাজ করছে। আন্দোলনে জঙ্গিত্বও এসেছে সেই সূত্রে। এরা চীনবিরোধিতার চেয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে হংকংয়ের আরও গণতন্ত্রায়ণের প্রতি। হংকংয়ে ধনী-গরিবের ব্যবধান কমানোর দাবিও তুলেছে তারা।
এই আন্দোলনের একটা বড় বৈশিষ্ট্য প্রথাগত নেতৃত্বহীনতা। আমেরিকার অকুপাই আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন পর্যন্ত দুনিয়াজুড়ে এরূপ নেতৃত্বহীন আন্দোলনের যে ঢেউ বইছে, তা আসলে প্রথাগত কাঠামোবাদী রাজনীতির শেষ বয়সের কথাই জানাচ্ছে। তবে প্রতিবাদী ছাত্রদের মূল সংগঠকদের সঙ্গে মেলামেশাকারী সাংবাদিকেরা জানেন, হংকংয়ের নেতৃত্বহীন এই আন্দোলনের নেতৃত্ব রয়েছে কারাবন্দী এডওয়ার্ড লিয়ুংয়ের হাতেই। তাঁর মাধ্যমেই নেতৃত্বহীন প্রত্যর্পণ বিলবিরোধী আন্দোলনের ভেতরে একটা পরিচয়বাদী রাজনৈতিক সত্তা তৈরি হয়ে গেছে। উইঘুর ও তিব্বতিদের ওপর বেইজিংয়ের নিপীড়ন হংকংয়ের ওই পরিচয়বাদী রাজনীতিকে দ্রুত কদম ফেলতে তাগিদ জোগাচ্ছে।
হংকংয়ের ‘শেষ যুদ্ধ’?
চীনের কাছে হস্তান্তরের আগে বহু যুগ হংকং ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ। হংকংয়ের স্থানীয় লোকজন জাতিগতভাবে মূল চীনেরই নিকটজন। ভূখণ্ডটি হাতে পেয়ে চীন ‘এক দেশ-দুই ব্যবস্থা’ নীতিতে প্রশাসন চালাচ্ছে। হংকংয়ের নিজস্ব একটা আইনসভাও আছে। আছে কিছু স্বায়ত্তশাসনও। তবে এখানকার ‘প্রধান নির্বাহী’রা কার্যত চীনের একজন পুতুল মাত্র। তাঁদের দায়বদ্ধতা যতটা হংকংবাসীর কাছে,তার চেয়ে বহুগুণ চীনের নেতৃত্বের কাছে। কারণ, এই পদাধিকারী সর্বজনীন ভোটে নির্বাচিত নন। বর্তমান প্রধান নির্বাহী ক্যারি ল্যামও তার ব্যতিক্রম নন। তবে ছাত্রদের বর্তমান আন্দোলন কেবল প্রধান নির্বাহীর বিরুদ্ধে নয়। হংকংবাসী মূলত বিদ্যমান স্বায়ত্তশাসনের সামান্যতমও হারাতে চাইছে না, বরং বাড়তি স্বাধিকারও চাইছে। স্থানীয় প্রশাসন সম্প্রতি হাউজিং খাতে বড় বড় সব প্রকল্প নিচ্ছে, সেগুলোয় চীনের কোম্পানিগুলোর একচেটিয়াত্বও হংকংবাসীর পুরোনো ক্ষোভে জ্বালানি জুগিয়েছে। ২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে মূল চীনের সঙ্গে হংকংয়ের যে সেতু হচ্ছে, তা নিয়েও আপত্তি আছে শেষোক্তদের। তারা মনে করছে, তাদের অর্থে এভাবে মূল চীনের পুঁজিরই সমৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে কেবল। স্থানীয় বিলিয়নিয়াররাও এসব দেখে ভীত। ছাত্রদের আন্দোলনে তাদের যে নীরব উৎসাহ আছে, সেটা অনেক ঘটনায় বোঝা গেছে। চীনের জন্য এটা একটা উদ্বেগজনক বার্তা। হংকংয়ের এলিটরা এত দিন চীনা ধাঁচের পুঁজিতন্ত্রের বিশেষ মিত্র হিসেবেই ছিল। সেই ‘আস্থা’য় ঘা দিয়েছে খোদ চীনই।
চীনের জাতিগত নিকটজন হয়েও হংকংবাসী পুরোপুরি চীনের কর্তৃত্বে যেতে চাইছে না আর। ভূখণ্ডগত জাতীয়তাবাদ যে জাতিগত জাতীয়তাবাদকে অতিক্রম করে যাচ্ছে, এখানে তার কারণ গণতন্ত্রের জন্য আকুতি। মাওয়ের বিপ্লবোত্তর চীনে আজ নজরদারিভিত্তিক যে সমাজ–রাষ্ট্র গড়ে উঠছে, হংকং তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে অনিচ্ছুক। এতে সম্মতি দেওয়া চীনের জন্য অতি দুরূহ। কারণ, সেটা শিনজিয়াংয়ের উইঘুর এবং তিব্বতের দেশছাড়া বৌদ্ধদের একই দাবিতে নড়েচড়ে উঠতে উৎসাহ জোগাবে। চীনের সামনে তাই বিকল্প একটাই। ছাত্রদের শান্ত করতে এডওয়ার্ড লিয়ুংয়ের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসা। সেই অর্থে হংকংয়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করছে, চীন কত তাড়াতাড়ি এডওয়ার্ড লিয়ুংকে ছাড়ছে এবং তিনিও কতটা ছাড় দিতে প্রস্তুত আছেন, তার ওপর। কিন্তু হংকংয়ের কিশোর-তরুণদের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখে মনে হচ্ছে, তারা স্বাধিকারের শেষ যুদ্ধে নেমেছে যেন।
আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক