আপনি উবারের কোনো গাড়িতে যাচ্ছেন। চালক যদি ৩ সেকেন্ডে ৮০ মিটার, মানে সেকেন্ডে ২৭ মিটারের বেশি গতিতে চলে, তাহলে আপনার মোবাইল অ্যাপে সতর্কবার্তা আসবে। গতি কমিয়ে না আনা পর্যন্ত সেটা থাকবে। আপনি যদি চান, বিপদ মনে করেন, ৯৯৯ নম্বরে ফোন করুন। উবার দুই বছর আগে পুলিশের এই হেল্পলাইন নম্বরটি যুক্ত করেছে। জরুরি অবস্থায় এই নম্বরে ফোন করুন। একটা প্রতিকার পাবেন। কারণ, শহরের ভেতরে গাড়ি চলার যে সর্বোচ্চ গতি, তার চেয়ে জোরে চললে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
উবার এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, যা আইন ভঙ্গ করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওদের মনিটরে ধরা পড়ে, যাত্রীদেরও সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করা হয়। এটা তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একটি পদ্ধতি। কথাটা বলছি এ জন্য যে এবারও ঈদের সময় সড়কে অনেক প্রাণ ঝরেছে। বেশির ভাগ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বাস-ট্রাকের বেপরোয়া গতি। পুলিশ-থানা-আইন সবই আছে, কিন্তু কোনোটাই কাজে আসছে না।
উবার একটি বেসরকারি রাইড শেয়ারিং সংস্থা। সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে সহযোগিতায় এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় জানিয়েছে যে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ওরা মাসব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টিসহ প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কাজ করেছে। ওরা চায় সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক। মানুষও তো এটাই চায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উবার যদি তাদের শত শত গাড়ি কোনটি কোথায় নিয়ম ভাঙছে তা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধরতে পারে, কোন গাড়ি, কোন চালক দায়ী এসব জানতে পারে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, তাহলে আমাদের ট্রাফিক পুলিশব্যবস্থা পারবে না কেন? উবার পুলিশের সহযোগিতা নিচ্ছে। ব্র্যাকের সঙ্গে কাজ করছে। উবার তাদের গাড়ির চালকদের উন্নত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এমনকি ব্র্যাকের এক সমীক্ষায় যখন জানা গেল পরিবহনশ্রমিকদের অর্ধেকই চোখে ভালো দেখেন না, তখন তাদের চালকদের চোখের পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে ইত্যাদি। তাহলে সরকার তাদের এত এত বড় অফিস, কর্মকর্তা–কর্মচারী, এত বড় বড় তহবিল নিয়ে পারছে না কেন?
সেদিন শেষ রাতে নরসিংদীর শিবপুরে বেপরোয়া গতিতে পাশ কাটাতে গিয়ে বাস ও গাড়ির সংঘর্ষে যে কয়েকজন মারা গেলেন, তখন পুলিশ কী করছিল? তাদের অফিসে জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করেই তো গাড়িগুলোর গতিবিধি ধরা যেত। ওয়্যারলেস-ওয়াকিটকিতে হাইওয়ে পুলিশকে আগে থেকেই কি সতর্ক করা যেত না?
মাত্র ৯ বছর আগে, ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে উবারের যাত্রা শুরু। এখন সারা বিশ্বে উবার আধুনিক ও নির্ভরযোগ্য পরিবহনব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর সরকারের পরিবহন সংস্থা বছরের পর বছর কেবল হাবুডুবু খাচ্ছে।
ট্রাফিক সিগন্যালে লাল বাতি জ্বললে পুলিশ হাতের ইশারায় গাড়ি চলতে বলে, সবুজ বাতিতে থামতে বলে! একেকটা মোড়ে অন্তত পাঁচ-ছয়জন পুলিশ কর্মকর্তা, কনস্টেবলকে দিনরাত কাজ করতে হয়। নিয়ম ভাঙলে পুলিশ কর্মকর্তা হাতে একটা হিসাবের যন্ত্র নিয়ে এসে জরিমানার রসিদ ধরিয়ে দেন। অথচ বিশ্বের সব বড় বড় দেশে এই পুরো কাজটা করে আধুনিক প্রযুক্তি। কেউ সিগন্যাল বাতি না মানলে সিসিটিভিতে খবর হয়ে যায়, তার ঠিকানায় জরিমানার রসিদ সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়। প্রত্যেক চালকের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে। যাবে কোথায়? জরিমানা না দিলে আরও বড় শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়। তিনবার জরিমানা হলে তাঁর লাইসেন্স বাতিল।
সবাই পারে, আমরা কেন পারি না? এই তো দিল্লিতে মাঝরাতে রাস্তার মোড়ে লাল বাতিতে গাড়ি থামে। অথচ ত্রিসীমানায় কোনো পুলিশ নেই। আছে সিসিটিভির চোখ। ওটাই যথেষ্ট। তাহলে আমরা কেন সেই পথে যাচ্ছি না? মোড়ে মোড়ে পুলিশের হাতের ইশারায় চলতে হবে কেন?
যেসব রুটে বাস-ট্রাক বেপরোয়া গতিতে চলে আর সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারে, তাদের গাড়িতে বিশেষ ধরনের অ্যাপ রাখা ও ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। এই অ্যাপ হাইওয়ে পুলিশের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় অফিসের অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। জিপিএস সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত থেকে পুলিশ অনায়াসে ওই সব বিপজ্জনক গাড়ির গতি ও চলাচল দিন-রাত চোখে চোখে রাখতে পারবে। কেউ আইনের বাইরে গেলে প্রয়োজনে হাইওয়ে টহল পুলিশ লাগিয়ে তাদের ঠান্ডা করতে পারবে।
শুধু উবার নয়। পাঠাও, সহজ, ওভাই, ওবোনসহ আরও অনেক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পরিবহনসেবা দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে সরকারের পরিবহনব্যবস্থার একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকা দরকার। কাজটা শুরু হয়েছে। এখন এগিয়ে নিতে হবে। সেই সঙ্গে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগও থাকতে হবে। একটি সমন্বিত উদ্যোগ আমাদের সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে।
আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
quayum@gmail.com