নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)–এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সড়ক আইন বাস্তবায়নবিষয়ক নানা জটিলতা এবং আশু করণীয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো: ২০১৮ সালের সড়ক আইনটির সম্পূর্ণ কার্যকরতা স্বপ্ন হয়েই থাকবে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: করোনার কারণ দেখিয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার সময় নিল। সে কারণে ১ নভেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে আমরা বলেছি, এরপর যেন আর টালবাহানা না হয়। আইন কার্যকর করতে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা আমাদের চোখে এখনো পড়ছে না। চালকদের প্রশিক্ষণ অন্যতম বড় বিষয়। যেমন যাঁদের হালকা গাড়ি চালানোর ছাড়পত্র আছে, তাঁদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারী গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া যায়। কিন্তু এ ধরনের কাজ বাকি থাকার কারণ হলো বিআরটিএর সামর্থ্য বৃদ্ধি না করা। আবার পরিবহন খাতও আইনটি আরও কাটছাঁট করার জন্য দর-কষাকষি করেই যাচ্ছে।
সম্প্রতি মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হলো। কী শুনলেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমাদের তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে না, পরিবহনমালিকেরা আর কিছু করতে পারবেন না। এখন ভয়টা হলো রাজনীতিক হয়ে তিনি অনেক কিছুই বলেন, বলবেন। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আইন কার্যকর করতে পারবেন না। কারণ, এটা কার্যকর করতে হলে যা যা থাকা দরকার, সেটা নেই। আইন কার্যকর করতে হলে বিধিমালা লাগবেই। একজন অতিরিক্ত সচিব বিধিমালা তৈরির জন্য গঠিত কমিটির প্রধান। কিন্তু প্রস্তাবিত বিধিমালার খসড়া পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। ২০ দিন আগে খোঁজ নিলাম। বলি, কী বিধি করলেন দেখান। বিআরটিএ বলে, আমরাই তো দেখতে পাইনি। রাস্তায় তাৎক্ষণিক জরিমানা করার যে যন্ত্র, সেটাও তারা হালনাগাদ করতে পারেনি। তাহলে তো আইন পাসের দুই বছর পরও সরকার অনেকটাই প্রস্তুতিহীন।
প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে। ক্ষতিপূরণ দিতে যে তহবিল ও ট্রাস্ট গঠন, সেটি হচ্ছে না। আপনি কি ভুক্তভোগীদের এই নির্দিষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনে হাইকোর্টে জনস্বার্থে একটি মামলার কথা ভাববেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: ছাত্র আন্দোলনের সময় আমি বলেছিলাম, এখন ঘরে ফিরে যাও। প্রয়োজনে আবার আমরা রাস্তায় নামব। সেখানে যেতে হতে পারে বা আইনের আশ্রয় নিতে হতে পারে।
আইনটি পাস হওয়ার পরও হাইকোর্টের আদেশ লেগেছে এটি কার্যকর করতে। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবটা অত্যন্ত স্পষ্ট। শাজাহান খান মন্ত্রিত্বে নেই, কিন্তু নেতৃত্বে আছেন। আজও কি তাঁরই উত্তরাধিকার বইছে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আপনি ঠিক ধরেছেন। তাঁদের মনোভাব এবং আমরা কী করি, সবটা মিলিয়ে সরকার কালক্ষেপণ করছে। ২২ অক্টোবর নিরাপদ সড়ক দিবস পালনে তাঁরা অংশ নেননি। আমি থাকলে সেখানে নাকি তাঁরা আসবেন না। প্রধানমন্ত্রীর ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান হলো। আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নিলাম। কিন্তু শাজাহান খানদের খুশি করতে আমাকে বক্তব্য দিতে দেওয়া হলো না। অথচ আমাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।
হ্যাঁ। আপনার স্ত্রী ১৯৯৩ সালের এদিনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন, আর আপনি নিসচা গড়ে তোলেন। তো বলার সুযোগ পেলে কী বলতেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমি অবশ্যই ২০১৮ সালের আইনের বাস্তবায়ন বিষয়ে কিছু বলতাম। আর সেটা বললে আয়োজকেরা বা যাঁদের খুশি রাখতে চান, তাঁদের হয়তো বিব্রত করা হতো।
পরিবহনমালিকদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আপনার কী মূল্যায়ন? শাজাহান খানের বাইরে কোনো সমান্তরাল নেতৃত্ব কি আদৌ গড়ে ওঠেনি, যাঁরা গণপরিবহনে নৈতিক বাণিজ্যে বিশ্বাস করেন? যাঁরা আইন মেনেও সফল ব্যবসা করা সম্ভব মনে করেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: একটা এথিক্যাল সমস্যা আছে। যেমন আপনাকে বলি, অক্টোবরে যখন আইনটি পাস হলো, তখন তাঁরা আগ বাড়িয়ে স্বাগত জানালেন। এরপর নভেম্বরেই তাঁরা আইনের প্রতিবাদে হরতাল ডাকলেন। সড়কে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলেন। সেই থেকেই তাঁরা আইন শুধরে সেটি তাঁদের অনুকূলে নেওয়ার তালে আছেন। যাঁরা আইনটির পক্ষে ছিলেন, তাঁরা বিরোধিতা শুরু করলেন। পেছনে থাকলেন। ক্ষমতার দাপট তাঁদের বেশি।
সড়কে মানুষের মৃত্যু ও অঙ্গহানি লোকের তালিকা দীর্ঘ হবে। আর আমরা কি এভাবে এখানেই আটকে থাকব? বেরোনোর পথ কী?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমি তো আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। যতই দিন যাচ্ছে, ততই তাঁরা আমার বিরোধিতাকে তীব্র করছেন, যা প্রকারান্তরে আইনের বাস্তবায়নকে আরও বাধাগ্রস্ত করে তুলছেন। শুরু থেকেই আইনটি করা নিয়ে আমি অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট ছিলাম। তাঁরা মনে করছেন, আমি না থাকলে বুঝি তাঁরা আইনটি তাঁদের মনের মতো করে পেতেন। হয়তো সে কারণে আমার প্রতি তাঁদের প্রতিশোধপরায়ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁরা কিছুদিন আগে আমার কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন। সুতরাং পরিবহন খাতের এই নেতৃত্ব থাকতে পরিবর্তন আসবে কি না, আমি সন্দেহ করি। ২০১০ সালে আমি কৌশল বদলাই। প্রায় ১৫ হাজার চালককে নিজস্ব অর্থায়নে প্রশিক্ষণ দিই। এর সুফল হিসেবে আপনি দেখবেন ২০১৬ পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা কমতির দিকে ছিল।
আপনার এনজিও করার অভিজ্ঞতা কী? দাতারা কি টাকা দিচ্ছে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আমি তখনো এনজিও করিনি। আগ্রহও ছিল না। পরে আমার ছেলে ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করে দেশে ফেরে। আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করতে চায়। এটা আমার জন্য গভীর সন্তুষ্টির। তখন আমি এনজিও করি। অবশ্য এনজিওর টাকায় এখন পর্যন্ত কিছু করিনি। সরকারি সহায়তা পাইনি। আমার তহবিল ছাড়া নিসচার ১২০ শাখার সদস্য চাঁদা দিয়ে আমরা চলছি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্লুমবার্গের সঙ্গে একটা আলোচনা প্রক্রিয়াধীন। উন্নয়ন অংশীদার বা দাতাগোষ্ঠীদের এ বিষয়ে উৎসাহ আমি দেখিনি।
নারীরা এখনো প্রধানত প্রাইভেট কার চালান। মহাসড়কে তাঁদের সম্ভাবনা?
ইলিয়াস কাঞ্চন: নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যেতে পারে। কারণ, তাঁরা ঠান্ডা মাথায় গাড়ি চালান। রেসিং এড়ান। ব্র্যাক-সরকার এ বিষয়ে একটি প্রকল্প নিচ্ছে। বিআরটিসির বাসগুলো নারী চালকদের দিলে এ ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটত। অথচ সরকারি টাকায় বাস আমদানির পর তা ইজারা দেওয়া হচ্ছে। সরকারি গণপরিবহন কীভাবে ব্যক্তিমালিকানায় ভাড়ায় চলতে পারে, তা আমার বোধগম্য নয়।
প্রায় ৩৬ লাখ মোটরযানের ফিটনেস বাবদ বিআরটিএ বছরে ৫০০ কোটি টাকা নেয়। আর মাত্র ১০ কোটি টাকা খরচ করে। ৩৬ হাজার গাড়িপ্রতি একজন পরিদর্শক, কী দেখে?
ইলিয়াস কাঞ্চন: আপনি জেনে অবাক হবেন, ফিটনেসহীন গাড়ির সংখ্যা (প্রায় ৫ লাখ) বিআরটিএ যেটা বলে, সেটা মূলত ফিটনেসের মেয়াদ উত্তীর্ণ বিবেচনায়। ফিটনেস নেই মানে ডেট ঠিক নেই। তারিখ পার হলে বলে, এতগুলো গাড়ির ফিটনেস নেই। বাস্তবে গাড়ির লাইট, ব্রেক, সাসপেনশন ইত্যাদি ঠিক আছে কি না, এসব দেখা হয় না। মানবদেহ দেখার মতো গাড়ির দেহ পরীক্ষায় কোনো সিস্টেম বলে কিছু নেই। ল্যাব বলতে চারটি বড় জেলায় ছিল। তা নষ্ট করে রেখে দিয়েছে। এখন ঢাকায় হয়তো একটি সচল।
তার মানে সড়কের যানগুলোয় করোনার মতো (মানে লক্কড়ঝক্কড় মার্কা) একটা সংক্রমণ চলছে। অথচ সারা দেশের জন্য আরটি–পিসিআর তুল্য গাড়ি স্ক্যানার আছে মাত্র একটি।
ইলিয়াস কাঞ্চন: বাস্তবতাটা ঠিক তাই।
এ মুহূর্তে সবচেয়ে অগ্রাধিকার কী আশা করেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন: সড়ক আইন কার্যকর করতে বিআরটিএ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সক্ষমতা বাড়িয়ে নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে। পথচারীরা যদি আইন ভঙ্গ (ফুটওভার ব্রিজ বা জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার না করা) করেন, তাহলে জরিমানা আছে। কিন্তু পুলিশ আইন পুলিশকে দণ্ডদানে অধিকার দেয়নি। এটা পারবেন ম্যাজিস্ট্রেট। এটা তো সব সময় রাখা অসম্ভব। তাই এখানে পুলিশকে সক্ষম করার দরকার পড়বে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
ইলিয়াস কাঞ্চন: ধন্যবাদ।