বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়কের বিশৃঙ্খলা দেখলে মনে হবে না যে এখানে কোনো আইন আছে। কিন্তু আমরা জানি, দেশে আইন আছে এবং এরপরও কেন এত বিশৃঙ্খলা, সেই কারণটিও জানি। আইন যদি প্রয়োগ না হয়, তবে সেই আইন অর্থহীন। সড়কে বিশৃঙ্খলার মূল কারণ আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা। সময়ের সঙ্গে আইন যুগোপযোগী করতে হয়। সেই পুরোনো আইনের বদলে এখন একটি নতুন সড়ক আইন হয়েছে, যা গত বছরের এক অভাবিত ছাত্র আন্দোলনের সরাসরি ফল হিসেবে আমরা বিবেচনা করতে পারি। সেই আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আট বছর ধরে আটকে থাকা সড়ক পরিবহন আইন দ্রুতই মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়। এর বছরখানেকের বেশি সময় পর ১ নভেম্বর সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর হয়।
নতুন আইন আগেরটির চেয়ে কঠোর হয়েছে, শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ অনেক বাড়ানো হয়েছে। সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে অনেক ক্ষেত্রে আইনটির আধুনিকায়নও হয়েছে। তবে নতুন আইন কার্যকর করার বিষয়টি শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে। আইনটি ১ নভেম্বর কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও করা যায়নি। দুই দফায় দুই সপ্তাহ পেছানো হয়েছে কিন্তু প্রস্তুতিতে সমস্যা ও নতুন আইন নিয়ে নানা বিভ্রান্তি এখনো কাটেনি। তবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী গতকাল সোমবার ঘোষণা করেছেন, আইন কার্যকর হয়ে গেছে।
আইন কঠোর হলে বা শাস্তি-জরিমানা বাড়লে মানুষের মধ্যে আইন ভাঙার ব্যাপারে ভয় বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। ফলে নতুন আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারলে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ারই কথা। কিন্তু আগের আইনে শাস্তি-জরিমানা কম থাকার কারণেই কি পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি, নাকি সেই আইন মানাতে বাধ্য করা যায়নি? নতুন সড়ক পরিবহন আইনটি আগের তুলনায় কঠোর, কিন্তু সেই আইন মানাতে যদি বাধ্য করা না যায়, তবে শুধু আইনের কঠোরতায় ফল মিলবে কি? দরকার আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘কঠোর’ হওয়া, সেটাই এখন আসল চ্যালেঞ্জ।
পুরো প্রস্তুতি ও বিভ্রান্তিগুলো দূর না করে আইন কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়ায় জনগণ হয়রানির মুখে পড়তে পারে। দীর্ঘ সময় পাওয়ার পরও কেন পুরো প্রস্তুতি নেওয়া গেল না বা আইনের মধ্যে বিভ্রান্তি থেকে গেল কেন, তার একটা জবাবদিহি দরকার। নতুন আইনে কিছু ক্ষেত্রে অস্পষ্টতার বিষয়গুলো ধরা পড়েছে। যানবাহন নিবন্ধন, চালকের লাইসেন্স পরীক্ষার পদ্ধতি, যানবাহনের ফিটনেসের মেয়াদ, গণপরিবহনের রুট পারমিট—এই বিষয়গুলো নতুন বিধি তৈরির মাধ্যমে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। সড়ক পরিবহন বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সেই কাজ চলছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
অন্যদিকে, নতুন আইনে যেহেতু শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, তাই ট্রাফিক পুলিশের জরিমানা করার যন্ত্রগুলোর সফটওয়্যারও সে অনুযায়ী আপডেট করতে হবে। তা না হলে নতুন আইনে জরিমানা করা কঠিন। সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে, সেই কাজটি এখনো শেষ হয়নি। এমন একটি অবস্থায় আরও কিছু সময় লাগলেও বিধিমালা তৈরিসহ ট্রাফিক পুলিশের যান্ত্রিক প্রস্তুতি শেষ করে আইনটি কার্যকর করাই হতো বাস্তবসম্মত। কারণ, আইন কার্যকর করে তা থেকে কোনো অজুহাতেই পিছিয়ে আসতে হলে তা এক বাজে নজির হয়ে থাকবে। আইন কার্যকর করার আগে যে কাজটিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল তা হচ্ছে, নতুন আইনের ব্যাপারে যথাযথ প্রচারণা চালানো। কিছু প্রচারণা হচ্ছে, তবে আরও ব্যাপক ভিত্তিতে তা হওয়া উচিত। টিভি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জন্য সহজবোধ্য প্রচারণা উপকরণ বানিয়ে তা প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া যায়। জোরেশোরে ও ব্যাপকভাবে এই প্রচারণার কাজটি চালানো হলে জনগণের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হবে যে আইনটির যথাযথ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বদ্ধপরিকর। জনগণ ও সড়ক-মহাসড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে আইন মেনে চলার ভয় হোক বা সচেতনতা হোক, তা বাড়বে।
আইন অমান্যের শাস্তি বা জরিমানা বেশি হলে তা আইন মেনে চলায় ভূমিকা রাখে ঠিকই, তবে আমাদের মতো দেশে কঠোর আইন অপব্যবহারের আশঙ্কাকেও বাড়িয়ে তোলে। শাস্তি বা জরিমানা যখন কম ছিল, তখনো ট্রাফিক আইনের যথেষ্ট অপব্যবহার হয়েছে। যানবাহনের মালিক ও চালকদের এসব ভোগান্তির অভিজ্ঞতা রয়েছে। ট্রাফিক পুলিশের অনেক সদস্যের চাঁদাবাজি কোনো গোপন বিষয় নয়। নতুন আইনে যেহেতু শাস্তি ও জরিমানার হার অনেক বেশি, তাই এই আইনের অপব্যবহার হলে জনগণের হয়রানির আর সীমা থাকবে না।
আপনার গাড়ি রাস্তায় কোনো আইন ভাঙলে ট্রাফিক পুলিশ এসে কাগজপত্র চাইবে এবং আইন না মানার জন্য জরিমানা করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা কী বলে? ট্রাফিক পুলিশ মাঝরাস্তা থেকে হোক বা পার্কিং অবস্থা থেকে হোক, গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে হাঁটা দেয়। ড্রাইভার বা গাড়ির চালকের এরপর সেই ট্রাফিক পুলিশের খোঁজে বের হতে হয়। রাস্তার নানা জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁরা দেনদরবার করেন, কখনো জরিমানা দিয়ে বা কখনো ঘুষ দিয়ে চালক বা গাড়ির মালিক এ থেকে মুক্তি পান। অনেক ক্ষেত্রে আইন যে আদৌ ভাঙা হয়েছে, তা প্রমাণ করার কোনো ব্যাপার থাকে না। এ নিয়ে কোনো কথা বলতে গেলে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে ‘খারাপ’ ব্যবহার বা ‘কাজে বাধা’ দেওয়ার অভিযোগে বাড়তি জরিমানা গুনতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি খুবই হয়রানিমূলক। আর ট্রাক বা বাসের মতো পরিবহন থেকে কীভাবে চাঁদা নেওয়া হয় এবং তাতে ট্রাফিক পুলিশের যুক্ততা কতটুকু, তা পরিবহনশ্রমিক ও মালিকেরা হাড়ে হাড়ে টের পান।
তবে এগুলো সবই সাধারণ মানুষের জন্য। আপনি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কেউ হলে অবশ্য আপনার জন্য ট্রাফিক আইন বলে কিছু নেই। আপনি উল্টো পথে চলুন, গাড়িতে নিয়ম ভেঙে হর্ন বা সাইরেন লাগান, সেগুলো অহেতুক বাজাতে থাকুন, কোনো ট্রাফিক পুলিশের সাহস নেই আপনার সেই গাড়ি আটকায়। মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে এক যুগ্ম সচিবের জন্য তিন ঘণ্টা ফেরি আটকে রাখা হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সের জন্যও কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। সেই ফেরিঘাটে দীর্ঘ সময় আটকে থেকে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় এক স্কুলছাত্র। এ ঘটনার পর হাইকোর্টে এ নিয়ে একটি রিট হলে আদালত মন্তব্য করেছেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আর কেউ ভিআইপি নন, বাকি সবাই রাষ্ট্রের কর্মচারী। কিন্তু রাস্তায় চলতে গিয়ে আমরা এখন কী দেখি? ‘রাষ্ট্রের কর্মচারী’ বলে তো কেউ নেই। আপনার আগে-পিছে, ডানে-বাঁয়ে সবাই তো ‘ভিআইপি’। গাড়ির হর্ন, গাড়িতে লাগানো পতাকার দণ্ড—এগুলো হচ্ছে ভিআইপি গাড়ির সিম্বল। দেশে এত ভিআইপি!
এসব ‘ভিআইপির’ জন্য নতুন সড়ক আইন ঠিকভাবে কাজ করবে তো? বিআরটিএর যে আটটি ভ্রাম্যমাণ আদালত গতকাল থেকে কাজ করা শুরু করেছেন, তাঁরা ভিআইপি কারও আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে কি? নাকি ট্রাফিক পুলিশ সামনে নিয়মিত এই কাজটি করতে পারবে? আমরা দেখে আসছি, পুলিশের সহায়তায় তথাকথিত ভিআইপিদের গাড়ি উল্টো পথে চলে, আইন ভাঙে। নতুন আইন কি এই সংস্কৃতি বদলাতে পারবে? প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের অনেকেই মনে করছেন, নতুন আইনে নানা ধারা অমান্যের জন্য যে শাস্তির বিধান করা হয়েছে, তা বেশ কঠোর। পুলিশ যদি এমনটা মনে করে, তবে তা বিপদের কথা। একজন চালকের সচেতন সিদ্ধান্তেই ট্রাফিক আইন অমান্যের ঘটনা ঘটে। একজন চালক সিদ্ধান্ত নিয়েই উল্টো পথে গাড়ি চালান, সিগন্যাল অমান্য করেন, নির্দিষ্ট গতির বেশি গতিতে যানবাহন চালান, মোটরসাইকেলের চালক ফুটপাতে ওঠেন বা ফিটনেস না থাকা গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামেন। এসব ঠেকাতে কঠোর আইনের বিকল্প কী? পদচারী–সেতু থাকার পরও যখন একজন পথচারী নিচ দিয়ে রাস্তা পার হন, তখন তাঁকে ঠেকানোর পথই-বা কী? নতুন আইনে ফিটনেস ছাড়া গাড়ির জরিমানা বাড়ানো হয়েছে। জরিমানার ভয় কিন্তু কাজে দিতে শুরু করেছে। ফিটনেস সার্টিফিকেট জোগাড়ের জন্য বিআরটিএতে যানবাহনের ভিড় লেগে গেছে।
কিন্তু নতুন কঠোর আইন যদি আগের মতোই শিথিলভাবে প্রয়োগ করা হয়, কেউ কেউ যদি ছাড় পেয়ে যায়, ট্রাফিক পুলিশের অনিয়ম-দুর্নীতি যদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে নতুন আইন আদৌ কোনো ফল দেবে না। বরং অপব্যবহারের বিপদ বাড়বে এবং জনগণ চরম হয়রানির মধ্যে পড়বে। নতুন আইন কার্যকর করার পাশাপাশি এই দিকগুলোতেও নজর দিতে হবে, এখানেও নতুন সংস্কৃতি চালু করতে হবে। বিআরটিএর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে দক্ষ করতে হবে, লোকবল বাড়াতে হবে। ফিটনেস সনদ ছাড়া গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে হলে যানবাহনের মালিকেরা যাতে সহজে এই সনদ পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। ফুটপাত হাঁটার উপযোগী রাখা বা পথচারী পারাপারের জন্য প্রয়োজনীয় জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবস্থা না করতে পারলে শুধু জরিমানার অঙ্ক বাড়িয়ে পথচারীদের বিশৃঙ্খল চলাফেরা বন্ধ করা যাবে না।
সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে এই আইন বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। তাঁর এই অবস্থানকে স্বাগত জানাই। কিন্তু তিনি প্রয়োজনে এই আইন সংশোধনের কথাও বলেছেন। আইন কার্যকরের প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের বক্তব্য বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। আইনটির যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁদের উৎসাহিত করবে। নতুন আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা রয়েছে এবং এর সঙ্গে অনেক বিষয় পরস্পর সম্পর্কিত। এই অবস্থায় যা বাস্তবসম্মত হতে পারে তা হচ্ছে, কিছু সড়ক ও মহাসড়ক নির্দিষ্ট করে সেখানে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা ও লোকবল নিশ্চিত করে নতুন সড়ক আইন কঠোরভাবে ও শতভাগ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া। পর্যায়ক্রমে তা সারা দেশে কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া যায়। দীর্ঘদিন ধরে যে বিশৃঙ্খলা জেঁকে বসেছে, তা চাইলেও দ্রুত দূর করা যায় না।
এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর উপসম্পাদক
akmzakaria@gmail.com