পাহাড়ি মেয়ে লিয়ানা পপি ত্রিপুরা। বান্দরবান সরকারি ডিগ্রি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এক স্বপ্নবান আর সংগ্রামী নারী। বান্দরবানের প্রত্যন্ত থানচি গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন স্বপ্নকে নিজের জীবনে মূর্ত করে তুলতে। চাকরির আয় দিয়ে নিজে চলতেন, পরিবারের খরচ জোগাতেন আর তাঁর ছোট ভাই, যিনি এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন, তাঁর আংশিক খরচও বহন করতেন পপি ত্রিপুরা। কিন্তু গত ১৮ অক্টোবর সকাল ১০টায় সেই স্বপ্নের মৃত্যু হয়ে গেল গুলশানের একটি সড়কে। বাসা থেকে বান্ধবীসহ রিকশা নিয়ে নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার পথে গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে একটি বেপরোয়া প্রাইভেট কার তাঁদের রিকশাকে ধাক্কা দেয়। এ সময় পপি ডান দিকে আর তাঁর বান্ধবী বাঁ দিকে ছিটকে পড়েন। ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষের মাধ্যমে জানা যায়, পপি ত্রিপুরা রাস্তায় পড়ে গেলে গাড়িতে থাকা গাড়ির চালক তখন পপিকে টেনে না তুলে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাইভেট কারটি পপির ওপর চালিয়ে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যান। অকুস্থলের লোকজন তাঁদের উদ্ধার করে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক পপিকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর বান্ধবী হেলেনা ত্রিপুরা ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান।
সাধারণ নিয়ম অনুসারে আসামিকে গ্রেপ্তার করার পর তদন্ত কর্মকর্তা কর্তৃক বাদীপক্ষকে জানিয়ে দেওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক। কিন্তু আমরা দেখেছি পপি ত্রিপুরাকে চাপা দেওয়া গাড়ির চালককে গ্রেপ্তার করার পর দীর্ঘ সময় পার হলেও তদন্ত কর্মকর্তার তরফে বাদীপক্ষকে কোনো কিছুই জানানো হয়নি; এমনকি আসামিকে যে আদালতে নেওয়া হবে, সে বিষয়েও বাদীপক্ষকে জানানো হয়নি। ময়নাতদন্তের দিন আসামিপক্ষের লোকজন পপি ত্রিপুরার পরিবারকে আসামিপক্ষের সঙ্গে মীমাংসায় আসার জন্য নানা ধরনের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন বলে পরিবারের তরফে অভিযোগ করা হয়েছে। মামলা চলাকালে এসব হুমকি লিয়ানা ত্রিপুরা পপির সুষ্ঠু বিচার ও তদন্ত পাওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ তৈরি করছে। পপির মতো এক পরিশ্রমী মেয়ের এ রকম অস্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নেওয়াটা কঠিন। জানি মৃত্যুর কোনো সান্ত্বনা নেই, জীবনের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না, তবু ঘটনার সঠিক তদন্ত, সুষ্ঠু বিচার আর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ কিছুটা হলেও সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হবে। সড়কে সুশাসন ফেরানো খুবই দরকার, এ জন্য প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা খুব জরুরি।
কয়েক দিন আগে সড়কে পপি ত্রিপুরার হত্যার বিচার চেয়ে আমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন সাদেকা হালিম, আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রংসহ আমরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আদিবাসী ছাত্র ও নাগরিক সমাজ আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দিয়েছি। ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ ত্রিপুরা ক্রিশ্চিয়ান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদের সদস্যরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমরা বলেছি, সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রাইভেট কার চাপিয়ে লিয়ানা ত্রিপুরা পপির হত্যাকারীর সর্বোচ্চ ও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে। আমাদের স্পষ্ট দাবি ছিল:
• পপি ত্রিপুরাকে চাপা দেওয়া গাড়ির চালককে বাংলাদেশের আইন মোতাবেক সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করতে হবে;
• অবিলম্বে নিহত পপি ত্রিপুরার পরিবারকে কমপক্ষে এক কোটি টাকা ও আহত হেলেনা ত্রিপুরাকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে;
• দুর্ঘটনার সময় রেকর্ডকৃত সিসি টিভির ফুটেজ আবশ্যিকভাবে বাদীপক্ষকে এক কপি দিতে হবে;
• ঘটনার পর থেকে পপি ত্রিপুরার পরিবারের সদস্যদের ওপর নানা ধরনের হুমকি আসছে। সে জন্য অবিলম্বে হুমকিদাতাদের চিহ্নিতসহ গ্রেপ্তার করে পপি ত্রিপুরার পরিবারের নিরাপত্তা দিতে হবে;
• আমরা জেনেছি প্রাইভেট কারচালক এক বিত্তবান পরিবারের সন্তান এবং মাদকাসক্ত বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে যেন তিনি ছাড়া পেয়ে না যান, তা নিশ্চিত করতে হবে।
• পপি হত্যা তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে পিবিআই বা অন্য কোনো তদন্তকারী সংস্থা কর্তৃক তদন্ত করতে হবে;
• সড়ক দুর্ঘটনা রোধে লাইসেন্সবিহীন চালক ও গাড়ির মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে;
রোবায়েত ফেরদৌস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক
robaet.ferdous@gmail. com