মতামত

সড়কে নৈরাজ্য, ওয়াসার ছলনা, বিমানবন্দরে হয়রানি: ‘ছোট ছোট দুঃখ কথা’

২০১৮ সালের জুলাই মাসে বেপরোয়া বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর কিছুদিন ঢাকার রাস্তার দখল নিয়েছিল স্কুল–কলেজের ছাত্ররা। ন্যায়বিচারের পাশাপাশি তারা সার্বিক পরিবর্তনের দাবিও করেছিল। কিছু আশ্বাস আর কিছু সরকারি–বেসরকারি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এ আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ আবরার নামের এক বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র নিহত হন দুই বাসের প্রতিযোগিতায়। ছাত্ররা আবার রাস্তায় নামে। দুদিন পর ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া স্বপ্রণোদিত হয়ে চারটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন: এক. লক্কড়ঝক্কড় বাস চলতে দেবেন না। দুই. নির্ধারিত স্টপেজের বাইরে বাস দাঁড়াতে পারবে না। তিন. এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজ পর্যন্ত বাসের দরজা বন্ধ থাকবে। চার. প্রতিযোগিতা করে বাস চালালে বা রাস্তা বন্ধ করে দাঁড় করালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সেই ভদ্রলোক মানে ডিএমপি কমিশনার অবসরে গেছেন। আমরা জানি যে তাঁর সময়ে বা অদ্যাবধি চার প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। চালু বাসগুলোর একটা বড় অংশ ভাগাড়ে যাওয়ার উপযুক্ত, কিন্তু তারা ফিটনেস সনদ পেয়ে যায় বা সনদ না থাকলেও চলতে অসুবিধা হয় না। বাসচালকদের অরাজকতা বহাল আগের মতোই। ঢাকার যানজটের অন্যতম অনুঘটক তাঁদের দুর্বিনীত আচরণ।

অনেক বিশেষজ্ঞ বাসের সংখ্যার অপ্রতুলতার কথা বলেন। মিনিবাসসহ যে হাজার বিশেক বাস ঢাকায় চলে, তা হয়তো যথেষ্ট নয়। তবে কোভিড শুরুর আগে আমি নিয়মিতই বাসে চড়তাম। অফিস শুরু এবং অফিস ভাঙার সময় বেশ ভিড় হতো, যা পৃথিবীর সব শহরেই হয়। অন্য সময় বাসে উঠলে সব সময়ই বসার আসন পেতাম। আমার এই উপলব্ধি হয়েছে যে বাসের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম নয়, আর শুধু এর সংখ্যা বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। সমাধান নিহিত আছে শৃঙ্খলাবিধানের লক্ষ্যে ওই চার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের মধ্যে। তা করতে পারলে শহরে যানবাহনের নিট গতিবেগ বাড়ত। ফলে একই সংখ্যক বাস বেশি ট্রিপ দিয়ে বেশি যাত্রীকে সেবা দিতে পারত। তবে প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন যে কঠিন, তা অনেকটাই প্রমাণিত। বাসের মালিক-শ্রমিকনেতারা ক্ষমতার বলয়ের অংশ। শোনা যায়, রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি পুলিশের লোকজনও নাকি অনেক বাসের মালিক।

২.

বেশ কয় বছর আগে থেকেই দেখছিলাম পথঘাট কেটে বা অনুভূমিক ড্রিল মেশিন দিয়ে ছিদ্র করে কালো রঙের কৃত্রিম রবারের পাইপ বসানো হচ্ছে সারা ঢাকা শহরে। শুনেছিলাম, এই পাইপে পানি সঞ্চালনে নাকি জীবাণু বিস্তার লাভ করবে না। পানি হবে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ এবং ফিল্টার না করে ট্যাপ থেকে সরাসরি পান করতে পারবে ঢাকাবাসী। আশ্বস্ত হয়েছিলাম, যদিও সন্দেহ পুরো দূর হয়নি। বিষয়টি যে অসম্ভব, তা তো নয়। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একটি উন্নয়নশীল ও বৈষম্যপূর্ণ দেশেও ট্যাপের পানি পানযোগ্য এবং নিরাপদ সর্বত্রই।

উল্টো কিছুদিন যাবৎ বরং ওয়াসার সরবরাহকৃত পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ নিয়ে প্রচুর অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, আর এর পরিপ্রেক্ষিতে চমকপ্রদ এক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন ওয়াসার এমডি। ওয়াসার বর্তমান এমডি একজন অপরিহার্য ব্যক্তি। বিভিন্ন মেয়াদে পাঁচবার চুক্তি দিয়ে তাঁকে ১২ বছর ধরে এ পদে রাখা হয়েছে, তা–ও রেকর্ড বেতনে। তিনি বলেছেন, তাঁর বাসার পানিতেও নাকি দুর্গন্ধ আছে। দেখা যাচ্ছে, এই দীর্ঘ সময়ে তিনি তাঁর নিজের বাড়িতেও মানসম্মত পানি পৌঁছাতে পারেননি। এমডিরই যেহেতু এ অবস্থা, তাহলে পানি নিয়ে আমজনতার এরূপ অভিযোগ তো নিতান্তই বেমানান।

এর মধ্যে কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। পত্রিকায় একটি সিদ্ধান্ত দেখলাম, শহরের অধিক আক্রান্ত এলাকাগুলোয় ২৬ লাখ কলেরার টিকা দেওয়া হবে। কলেরা একটি পানিবাহিত রোগ। পানি ঠিক না করে টিকা দিয়ে কলেরা আটকানো ঘোড়ার আগে গাড়ি জোতার মতো। ওয়াসার বর্তমান এমডি যদি নিতান্তই অপারগ হন, অন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে দেখা যাক না। এর চেয়ে আর খারাপ কী হবে!

বড় বড় সেতু আছে আমাদের দেশে, যেগুলোয় টোল আদায় হচ্ছে। যমুনার ওপর পৃথিবীর ১১তম দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতুর বয়স এরই মধ্যে ২৪ বছর। তারপরও পদ্মা সেতুর টোল আদায় কেন একটি বিদেশি কনসোর্টিয়ামকে দিতে হবে, তা আমার বোধগম্য হয় না। টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ, কী এমন রকেটবিজ্ঞান যে এ কাজেও বাঙালির যোগ্যতা অপ্রতুল!

৩.

শিরোনামটা ছিল ‘পদ্মা সেতুর টোল আদায়ে চীন–কোরিয়ার কোম্পানি’। ভেতরে খবর পড়ে অবশ্য জানা গেল পদ্মা বহুমুখী সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সার্ভিস প্রোভাইডার বা অপারেটর হিসেবে যৌথভাবে কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন এবং চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ বাবদ তারা ৬৯২ কোটি ৯২ লাখ টাকা পাবে।

বড় বড় সেতু আছে আমাদের দেশে, যেগুলোয় টোল আদায় হচ্ছে। যমুনার ওপর পৃথিবীর ১১তম দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতুর বয়স এরই মধ্যে ২৪ বছর। তারপরও পদ্মা সেতুর টোল আদায় কেন একটি বিদেশি কনসোর্টিয়ামকে দিতে হবে, তা আমার বোধগম্য হয় না। টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ, কী এমন রকেটবিজ্ঞান যে এ কাজেও বাঙালির যোগ্যতা অপ্রতুল! যদি সঠিকভাবে নির্মিত হয়ে থাকে সেতু, তাহলে তো পাঁচ বছরে কোনো মেরামতের প্রয়োজন হওয়ার কথা নয়। রুটিন রক্ষণাবেক্ষণ করার যোগ্যতাও কি নেই আমাদের প্রকৌশলীদের? সামান্য আস্থাটুকুও কেন নেই আমাদের প্রকৌশলীদের ওপর? একসময় বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন সিয়ার্স টাওয়ার তো এক বাঙালিই ডিজাইন করেছিলেন।

৪.

মার্চ মাসে ব্যাংকক গিয়েছিলাম কয়েক দিনের জন্য। বাংলাদেশ বিমানের কাউন্টারে ভিড় ছিল না তেমন। বিমানে আসন নিলাম ছাড়ার নির্দিষ্ট সময়ের ৩০ মিনিট আগে। আর কোনো যাত্রীও আসছিলেন না, তবু বিমান ছাড়ার কোনো প্রস্তুতি দেখতে পাচ্ছিলাম না। এরপর আরও কয়েকজন যাত্রী যখন এলেন, তখন বিমান ছাড়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। এরপরও কোনো নড়াচড়া দেখা গেল না। ১৫ মিনিট পর আরও তিনজন যাত্রী এলেন, এরপর ছাড়ার প্রস্তুতি। বিমান উড়ল আধা ঘণ্টা দেরিতে।

২০০৮ সালে বেখেয়ালে একটা ভুল করেছিলাম। দুবাই বিমানবন্দরে নির্দিষ্ট গেটে পৌঁছাতে হয় উড়ানের অন্তত ১০ মিনিট আগে। যখন হাজির হলাম, তখন বিমান ছাড়তে আর মাত্র দুই মিনিট বাকি। গেট বন্ধ হয়ে গেছে, রাষ্ট্রদূতের অনুরোধেও তা আর খুলতে রাজি হলো না। আরও ১৫ মিনিট লাগিয়ে আমার স্যুটকেস অফলোড করে এমিরেটসের বিমান ছাড়ল। আমি ফিরলাম পরদিন সকালে, এটাই নিয়ম। আমাদের যে যাত্রীরা প্লেন ছাড়ার নির্দিষ্ট সময়ে বা তার পরে এসেছিলেন, তাঁদের কারণে ফ্লাইটটিকে আধা ঘণ্টা দেরি করানো শুধু অযৌক্তিক নয়, অন্য যাত্রীদের প্রতি অন্যায়ও বটে।

ব্যাংকক থেকে ফিরে এলাম যেদিন, সেদিন আগমন হল প্রায় খালি। দিল্লি থেকে আসা একটি ফ্লাইটের লাগেজের শেষ কয়টা আসছে; আর আমাদের ব্যাংকক ফ্লাইট। আর কোনো ফ্লাইট নেই। দুটোই ছোট বিমান, একেকটিতে দুই শর কম আসন। এই গুটিকয় যাত্রীর লাগেজ আনতে বিমানের লাগল এক ঘণ্টার বেশি। যাত্রীরা প্রচণ্ড বিরক্ত, কিন্তু তাতে কারও কিছু যায়–আসে না। আমার এক আত্মীয় বিমানবাহিনী থেকে একসময় প্রেষণে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষে (বেবিচক) কাজ করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী করা যায়। তাঁর সাফ জবাব, কিছুই করা যাবে না। কারণ, মন্ত্রণালয় বা বিমান সদর কাউকে অখুশি করতে রাজি নয়। বিমানকর্মীরা তাঁদের ইচ্ছেমতো কাজ করবেন—এটাই ভবিতব্য।

এই যদি হয় মানসিকতা, ২০ হাজার কোটি টাকায় টার্মিনাল বানিয়েও লাভ হবে না কোনো। নিকৃষ্ট সেবাদানের যে খ্যাতি আছে ঢাকা বিমানবন্দরের, তার কোনো হেরফের হবে না। সেবার মান বাড়াতে হলে কেউ কেউ অখুশি হবেন, এমন কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজি আছে কি বাংলাদেশ বিমান ও বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়?

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব