মতামত

সড়কের কোনো দায়ই নেবেন না পরিবহনমালিকেরা?

শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে চালকদের কর্মঘণ্টা ৬ ঘণ্টা করার দাবিও উঠেছে
ছবি : প্রথম আলো

গত ২৩ নভেম্বর গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ি পিষে দেয় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানকে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই পান্থপথে উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ময়লার গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারান প্রথম আলোর সাবেক কর্মী আহসান কবীর খান। দক্ষিণ সিটির গাড়িটি চালাচ্ছিলেন একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী। উত্তর সিটির গাড়ির স্টিয়ারিং ছিল এক মেকানিকের হাতে। কয়েক দিনের মধ্যেই রামপুরায় দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয় নিহত হন।

ঢাকার দুই শিক্ষার্থী নাঈম ও দুর্জয় নিহত হওয়ার ঘটনায় সড়কে সবার জীবনের নিরাপত্তার দাবিতে ফের রাস্তায় নামে কিশোর শিক্ষার্থীরা। তিন বছর আগে একই দাবিতে কিশোর শিক্ষার্থীদের অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব আন্দোলন বড় ঝাঁকুনি দিয়েছিল সারা দেশে। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দুই বাসের পাল্লাপাল্লিতে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয়। এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা।

দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিরাপদ সড়কের জন্য সে সময় যে সাত দফা দাবি তুলেছিল, তা সর্বমহলেই গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। তারা শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে সড়কে নেমে দেখিয়ে দিয়েছিল শৃঙ্খলা কীভাবে ফেরাতে হয়। সাংসদ থেকে বিচারপতি, পুলিশ থেকে সচিব—নিবন্ধনহীন কারও গাড়িই তারা চলতে দেয়নি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের হামলায় অনেক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার পরও একটা সুশৃঙ্খল সড়কব্যবস্থা গড়ে তুলতে তারা অকল্পনীয় দৃঢ়তা দেখিয়েছিল। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের রাজপথে যেন কিশোর কবি সুকান্তের সেই আঠারো-ই নেমে এসেছিল। তাদের আন্দোলনে দেশের মানুষের মধ্যে একটা স্বপ্ন, একটা আশার সঞ্চার হয়েছিল। সবাই ভেবেছিল মৃত্যুকূপে পরিণত হওয়া সড়কে এবার শৃঙ্খলা ফিরবেই।

আন্দোলনের পর কিছুদিন সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর তোড়জোড় চলে। ঢাকঢোল পিটিয়ে বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করা হয়েছিল। শাস্তি বাড়িয়ে সংশোধিত সড়ক পরিবহন আইন পাস হয়েছিল। অনেকে আশা করেছিলেন, এ আইন পাস হলে সড়কে অনেকখানি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। কিন্তু পাস হওয়া আইন যেন ট্রাফিক পুলিশের দৈনিক মামলার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের অলিখিত রেওয়াজে আবদ্ধ হয়ে গেছে। সড়কে আইন অমান্য মামলায় জরিমানার হার বাড়ানোর ফল হয়েছে উল্টো। ঘুষ, দুর্নীতি আরও ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ পেয়েছে।

শিক্ষার্থীদের সাত দফা যৌক্তিক বলে সরকার সেগুলো মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। সেই আলোকেই সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৩০ দফা সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল। ওই আন্দোলনের পর কিছুদিন সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর তোড়জোড় চলে। ঢাকঢোল পিটিয়ে বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করা হয়েছিল। শাস্তি বাড়িয়ে সংশোধিত সড়ক পরিবহন আইন পাস হয়েছিল। অনেকে আশা করেছিলেন, এ আইন পাস হলে সড়কে অনেকখানি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। কিন্তু পাস হওয়া আইন যেন ট্রাফিক পুলিশের দৈনিক মামলার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের অলিখিত রেওয়াজে আবদ্ধ হয়ে গেছে। সড়কে আইন অমান্য মামলায় জরিমানার হার বাড়ানোর ফল হয়েছে উল্টো। ঘুষ, দুর্নীতি আরও ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ পেয়েছে।

সড়ক আন্দোলনের পর দুর্ঘটনা ও মৃত্যু বেড়েছে
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর গত তিন বছরে সড়কে নৈরাজ্য ও দুর্ঘটনা বেড়েছে। এর মধ্যে করোনা মহামারির বিধিনিষেধের কারণে কয়েক মাস রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ কিংবা সীমিত ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনা কমেনি। সড়ক দুর্ঘটনার সরকারি হিসাব সংরক্ষণ করে হাইওয়ে পুলিশ। তাদের হিসাবে ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২ হাজার ৬২৯টি। এতে মারা গেছেন ২ হাজার ৬৩৫ জন।

২০১৯ সালে দুর্ঘটনা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ১৪৭টি। মৃত্যু বেড়ে হয় ৪ হাজার ১৩৮ জনের। গত বছরের বড় একটা সময়জুড়ে দেশে করোনার বিধিনিষেধ ছিল। যানবাহন চলাচল কমেছে। কিন্তু সড়কে প্রাণহানি কমেনি। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৪ হাজার ১৯৮টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় ৩ হাজার ৯১৮ জনের। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩ হাজার ৭০১। প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজার ৫০২ জন। (সড়কে মৃত্যু বাড়ছে আর আইন শিথিল হচ্ছে! সমকাল, ২৭ নভেম্বর ২০২১)

পরিবহনমালিকেরা কোনো দায়ই নেননি
নতুন প্রজন্ম পথ দেখালেও কথা রাখেননি বড়রা। এ কারণে তিন বছর পর শিক্ষার্থীরা আবার নেমেছে সড়কে। এবারের আন্দোলন ২০১৮-এর মতো অত ব্যাপকতা পায়নি সত্যি, কিন্তু সেটা যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ না হওয়ারও কোনো কারণ নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে কথা দিয়ে সেটা রক্ষা না করার এমন বিরল দৃষ্টান্ত অভাবনীয়। বারবার কেন শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নেমে আসতে হয়?

পরিবহন খাত বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি গোষ্ঠীর অবৈধ আয়ের একটা বড় উৎস। রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতা-কর্মী, পরিবহনমালিক এবং ট্রাফিক পুলিশ ও বিআরটিএর অসাধু কর্মকর্তাদের স্বার্থ এখানে জড়িত। বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, অঘোষিতভাবে সেই দলের নেতা-কর্মীদের বড় একটা অংশের আইনবহির্ভূত আয়ের একটা বড় উৎস পরিবহন খাত। এ কারণে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো অসম্ভব। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিআরটিও ও ট্রাফিক পুলিশের অসাধু সদস্যরা ঘুষ ও দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে নিয়েছেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা বাসমালিকদের জন্য এটা একটা অতিমুনাফাদায়ী খাত। এর বড় দৃষ্টান্ত পরিবহন ও আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার এনায়েতুল্লাহ। একটি বাস থেকে এখন আড়াই শ বাসের মালিক তিনি। গত সাত বছরে তাঁর ব্যবসা বেড়েছে পাঁচ গুণ (আড়াই শ বাসের মালিক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ, বণিক বার্তা, ১ ডিসেম্বর ২০২১)।

পরিবহননেতারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট হয়ে উঠতে উঠতে এখন অতিকায় অজগরে পরিণত হয়েছেন। তাঁদের প্রতিপত্তি এখন এতটাই বেশি যে নিজেদের যেকোনো সিদ্ধান্ত সরকারকে চাপ দিয়ে করিয়ে নিতে পারেন। অন্যদিকে, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের সিদ্ধান্তগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো চলতেও পারেন। ঢাকার গণপরিবহন-ব্যবস্থায় রুট র‌্যাশনালাইজেশনের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সেটা পরিবহনমালিকদের অসহযোগিতায় বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নিজেরা কোনো দায় না নিয়ে দৈনিক জমার ভিত্তিতে বাসচালক ও সহকারীর হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন। দিনের শুরুতে কিংবা শেষে জমার টাকাটাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। সড়কে তাঁদের বাস নিয়ে চালক ও সহকারী কী করলেন, কী করলেন না, সে দায় তাঁরা নিতে রাজি নন।

হাফ পাসের বোঝাও চালকদের ওপর চাপিয়ে দিলেন মালিকেরা
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি সংস্থা বিআরটিসি এবং ঢাকার পরিবহন মালিক সমিতি বাসে হাফ ভাড়া মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, এমনকি বিআরটিসির বাসেও ৭০ শতাংশ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সঙ্গে গণপরিবহনে হাফ ভাড়ার দাবির সম্পর্ক সামান্য। সহপাঠীর থেঁতলানো লাশের তাড়িয়ে বেড়ানো স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামলে তড়িঘড়ি করে হাফ পাস দাবি মেনে নেওয়ার কৌশলী এ ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রেও পরিবহনমালিকেরা কোনো দায় না নিয়ে কৌশলে বোঝাটা বাসচালক ও সহকারীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু বেশির ভাগ বাস চলে দৈনিক জমার ভিত্তিতে, এ কারণে হাফ ভাড়ার চাপ পরিবহনশ্রমিকদের ওপরেই বর্তাবে।

পরিবহন সিন্ডিকেটের সবচেয়ে নিচের স্তর চালক ও সহকারীরা। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকার গণপরিবহনের চালক ও সহকারীদের বেশির ভাগকেই দৈনিক ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা রাস্তায় থাকতে হয়। এতটা পরিশ্রম করার পরও একজন চালক দিনে ১ হাজার টাকা ও সহকারী ৬০০ টাকার বেশি আয় করতে পারেন না। রাস্তার সমস্ত চাঁদাবাজি ও ঘুষের বোঝা তাঁদেরই বহন করতে হয়। নতুন করে হাফ পাসের বোঝা মালিকেরা যখন তাঁদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন, তখন বাড়তি এ টাকা তুলতে তাঁরা যে সড়কে আরও প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হবেন। পরিবহনমালিকেরা দায় না নিলে, কিংবা তাঁদের দায় নিতে বাধ্য না করা গেলে সড়কে শৃঙ্খলা আসবে না। সড়কে শৃঙ্খলা শেষ অবধি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক