১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন কম্পিউটার অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি’ শীর্ষক কনফারেন্সের সূচনা হয়। পরের বছর ১৯৯৯ সালে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল কনফারেন্সটি সিলেটে করতে রাজি হয়ে আমাদের উৎকণ্ঠামুক্ত করলেন। কিন্তু ওই বছর যখন কনফারেন্স আয়োজনের সময় হলো, তখন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণকে কেন্দ্র করে তুমুল আন্দোলন শুরু হলো। ফলে কনফারেন্সের আয়োজনও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। তখন জাফর ভাই শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফারেন্স আয়োজনে বাধ্য হলেন। জাফর ইকবাল বললেন, বিভিন্ন সেশনের জন্য সেশন চেয়ার প্রয়োজন। আমাকে জিজ্ঞাসা করাতে বললাম, একজন যোগ্য মানুষ আছেন, তবে আমার মনে হয় না তিনি রাজি হবেন। জাফর ভাই সঙ্গে সঙ্গে তাঁর টেলিফোন নম্বর নিয়ে ফোন করলেন। অন্য প্রান্ত থেকে উত্তর এল, অনুষ্ঠানে পরার মতো জামাকাপড়, প্যান্ট, জুতা কিছুই নেই। সুতরাং সেশন চেয়ার হতে পারবেন না। জাফর ভাই বললেন, তিনি এ রকম প্যান্ট-শার্ট-জুতা-স্যান্ডেলবিহীন একজন মানুষ খুঁজছেন সেশন চেয়ার করার জন্য। জাফর ভাইয়ের প্রত্যয়ী যুক্তিতে তিনি রাজি হয়েছিলেন। এই তিনি হলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। স্রোতের বিপরীতে চলা শক্তিশালী মনোবলের একজন নিবেদিতপ্রাণ, প্রচারবিমুখ শিক্ষাবিদ। উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনি প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রথম ক্লাসের দিন স্পঞ্জ পরা এই ছাত্রকে ক্লাসশিক্ষিকা বলেছিলেন, ‘স্পঞ্জ পরে মেডিকেলে আসা যাবে না।’ উনি স্পঞ্জ ছাড়তে পারলেন না। তাই মেডিকেল ছেড়ে দিয়ে বুয়েটে ভর্তি হলেন স্পঞ্জকে সঙ্গী করে।
অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছি। এর মধ্যে আবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার সুযোগ হলো। পরিশেষে পূর্ণকালীন শিক্ষকতা, যাতে আমার সহকর্মী আলমগীর ভাইয়ের উৎসাহের অবদান অনেক। ইএমই ভবনে এখন যেখানে লিফট হয়েছে, সেখানে মোহাম্মদ আলী ভাইয়ের কক্ষে সকালে অনেক শিক্ষকই বসেন, আলাপ করেন। সমাজ, শিক্ষা, গবেষণা বা ধর্মতত্ত্বসহ নানা বিষয়ে তাঁর বিস্তার। শুধু তা-ই নয়, আলাপচারিতা জমিয়ে তোলার জন্য যে আপ্যায়ন প্রয়োজন, তারও কোনো কমতি নেই। মুড়ি, চানাচুর, ফলমূল, বিস্কুট আর কার্টন-কার্টন কোকা-কোলা। অধিকাংশ সময় দরজা-খোলা কক্ষের খোলা দেরাজে টাকা এমনকি বিদেশি মুদ্রা রেখে দেন; যা দুঃসময়ে আমিসহ নানাজনের কাজে এসেছে। ছোট্ট কক্ষে মেধাবী মানুষদের জন্য রীতিমতো উদ্দীপনাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছেন, যেমনটি করত পুরোনো দিনের বিজ্ঞান একাডেমিগুলো। এর সঙ্গে আমিও একদিন যুক্ত হলাম; যদিও আমার বিদ্যাবুদ্ধির ব্যাপ্তি এসব আলাপের জন্য যথেষ্ট নয়।
মোহাম্মদ আলী কানাডা থেকে পিএইচডি করেছেন। আজ থেকে সিকি শতাব্দী আগে শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্রের জন্য আইইইইর পুরস্কারও পেয়েছেন। অর্থের প্রতি, বিত্তবৈভবের প্রতি কোনো আকর্ষণ তাঁর মধ্যে দেখিনি। যদিও উপার্জিত অর্থের কর পরিশোধে আগ্রহ তাঁর সীমাহীন। শিক্ষকেরা যখন ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ক্লাস বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন একমাত্র অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী ক্ষোভকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করার জন্য বর্জিত ক্লাসের দিনগুলোতে বেতন গ্রহণ না করার প্রস্তাব দেন। আমি যদি কদাচিৎ একটা পেপার কোনো জার্নালে পাঠাতাম, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকের মারফতে পাঠিয়ে নিশ্চিত করতাম যে আমার পকেট যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অন্যপক্ষে তিনি নিজের কেনা খামে নিজের পয়সায় স্ট্যাম্প কিনে পাঠাতেন। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজ-কলমসহ নানা সুযোগ-সুবিধা আমি যখন-তখন গ্রহণ করলেও এ বিষয়ে তিনি ছিলেন রীতিমতো অনাগ্রহী। আমাদের বিভাগে কোনো কম্পিউটার ঠিকমতো কাজ না করলে হাতুড়ি-বাটাল নিয়ে লেগে পড়তেন, নানা সময়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তিনি নিশ্চয়ই নিজের পয়সায় কিনতেন। কারণ, এই পয়সা অনুমোদন করাতে যে ঝামেলা পোহাতে হবে, তা তাঁর চরিত্রের সঙ্গে বেমানান ছিল। আমি তো রীতিমতো অবাক! অন্য বিভাগের কম্পিউটারসহ অন্যান্য কী কী যন্ত্রাংশ কাজ করে না, তা নিয়ে মাথাব্যথা—নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো!!! এটা কেবলমাত্র অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চৌধুরীই করতে পারেন। যেসব কাজে প্রাপ্তি নেই তাতে তাঁর সীমাহীন আগ্রহ, পার্থিব উন্নতির যেকোনো বিষয়ে তাঁর অনাগ্রহও লক্ষণীয়। ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার্থে আবেদনপত্রের সঙ্গে যে প্রত্যয়নপত্র লাগে, তা সব সময় তিনি নিজেই লেখেন এবং নিজেই পোস্ট করেন প্রত্যেক ছাত্রের জন্য আলাদা করে। ছাত্রদের থিসিস সম্পাদনায় সময় দেন প্রচুর—গোটা থিসিস ১৫-২০ বার তো দেখেনই।
তাঁর রোজনামচা অসাধারণ। ফজরের নামাজ পড়েই অফিসে চলে আসেন। দেশি কিংবা অতিথি পাখির খাবারের ব্যবস্থা করা, চারা গাছে পানি দেওয়া, লেখালেখি, কম্পিউটারে কাজ, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নানা বই ডাউনলোড করে লাইব্রেরিতে দেওয়া, ক্লাসে যাওয়ার আগে পুরো বক্তৃতা স্বহস্তে লেখা, সমস্যা সমাধান করা। এর মাঝে বাজার, ভ্রমণ করা এবং দিন শেষে রাত নয়-দশটার দিকে বাসায় ফেরা। সারা দিন, সপ্তাহে সাত দিন, বছরে ৫২ সপ্তাহ। এর মধ্যে ছেদ ঘটেছে কেবলমাত্র নিকটতম পারিবারিক সদস্যদের মৃত্যুর কারণ। এই রোজনামচা চলছে ২৭-২৮ বছর ধরে, এক বছর দুই বছর ধরে নয়। আমি যদি কখনো সকালে অফিসে আসি, ফলের রস থেকে চানাচুর ও অন্যান্য লোভনীয় খাবার স্বহস্তে পরিবেশন করেন। আমার অফিসে শ দু-একের বেশি এককালীন ব্যবহার্য যে গ্লাস, সবই তাঁর দেওয়া, ফলের রসসহ। আমার অফিসে এসে যদি দেখতে পান আরও চার-পাঁচজন ছাত্র বসে আছে, তবে সবার জন্যই কিছু খাবারের ব্যবস্থা করেন। এটা হলো শিক্ষার জন্য প্রণোদনা—শেখার জন্য, শেখানোর জন্যও। তবে কোনোক্রমেই তাঁকে আপ্যায়ন করা সম্ভব নয়। প্রতি ধর্মীয় উৎসবে সুবিধাবঞ্চিত দারিদ্র্যপীড়িত লোকদের রিকশা কিনে দিতেন, যাতে তাঁরা স্বাবলম্বী হয়। অনেকেই এই সুযোগের অপব্যবহার করেছে। তাই এখন অর্ধশতক রিকশাওয়ালাকে ধর্মীয় উৎসবে এককালীন অর্থ প্রদান করেন। আমার যেকোনো আগন্তুক তাঁর সম্মানিত অতিথি এবং সব অতিথিকেই তিনি আপ্যায়ন করেন। এই আতিথেয়তা, বিনয় তাঁর চরিত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা তাঁকে কখনো চিন্তাভাবনা করে করতে হয় না। নানা স্বাস্থ্য-সমস্যায় ভুগেছেন, অনেক ছাত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষী থাকা সত্ত্বেও কারও মুখাপেক্ষী কখনো হননি আজীবন অকৃতদার এই মানুষটি। কোনো বিষয়েই তেমন কোনো অভিযোগ নেই কারও প্রতি। সারা জীবন স্রোতের বিপরীতে চলা এই মানুষটি এভাবেই যেন বাকি জীবন নির্ঝঞ্ঝাট ও সুস্থভাবে কাটাতে পারেন—এই কামনা করি।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।