নগরায়ণ

স্যাটেলাইট টাউন নিয়ে ভাবনা ও আশঙ্কা

.

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় এলজিইডি গৃহীত সিটি রিজিয়ন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় রিজিয়নাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান প্রকল্প হাতে নিয়েছে রাজউক। এই প্রকল্পের তিনটি উদ্দেশ্যের অন্যতম হলো ঢাকার জন্য স্যাটেলাইট টাউনের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং একটি স্যাটেলাইট টাউনের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা। প্রকল্পের উল্লিখিত উদ্দেশ্য সামনে রেখেই আজকের এই লেখা।
‘স্যাটেলাইট টাউন’ ধারণাটির সূত্রপাত ঘটেছিল ১৯৪৬ সালের ‘ইউকে নিউ টাউনস অ্যাক্ট’-এর মাধ্যমে। নগরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জনসংখ্যার সঙ্গে সমানতালে বাড়তে না পারা নাগরিক সুযোগ-সুবিধার অভাব ইত্যাদি বিষয় সামনে রেখে বড় শহরের বিবর্ধন ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে স্যাটেলাইট টাউন গড়ে তোলার ধারণাটি আবির্ভূত হয়। আভিধানিক সংজ্ঞায় আমরা পাই, স্যাটেলাইট টাউন হলো ছোট বা মাঝারি আকারের শহর, যা একটি বড় শহর থেকে এমন দূরত্বে থাকবে, যাতে বড় শহরটির বিবর্ধন তাকে গ্রাস করতে না পারে। শহর দুটির মধ্যে অবস্থিত নদী, বিস্তৃত সবুজ ভূখণ্ড, কৃষিজমি অথবা গ্রামীণ বসতি শহর দুটির অবস্থানগত পৃথক্করণের কাজটি সহজ করে। স্যাটেলাইট টাউন ধারণাটির সূত্রপাত যে শহরে, সেই লন্ডন শহরের বিবর্ধন ব্যবস্থাপনায় ২০ থেকে ৩০ মাইল (৩০ থেকে ৪৮ কিলোমিটার) দূরত্বে যে ছোট শহরগুলোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোকে মূল শহর থেকে পৃথক করা হয়েছিল সবুজ বেষ্টনীর মাধ্যমে। এ ছাড়া স্যাটেলাইট শহরগুলো সাধারণত নিজস্ব অর্থনৈতিক কাঠামো এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনার সুবাদে অনেকটাই স্বনির্ভর হয়ে গড়ে ওঠে। শুধু বৃহৎ পরিসরের সুবিধার (বিশেষায়িত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ, ব্যবসা ইত্যাদি) জন্য মূল শহরের ওপর তার নির্ভরতা থাকে।
এসব বৈশিষ্ট্য সামনে রেখে বড় শহর ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে স্যাটেলাইট টাউন তৈরির নজির পৃথিবীর উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশেই রয়েছে। এশিয়ার মধ্যে বোধ করি জাপানই প্রথম স্যাটেলাইট টাউন ধারণাটির প্রয়োগ করেছিল এর সর্ববৃহৎ শহর টোকিওর অনিয়ন্ত্রিত ও অপ্রয়োজনীয় বৃদ্ধি ঠেকাতে। এ ছাড়া হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারতসহ আরও অনেক দেশেও এমনটা করা হয়েছে।
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে স্যাটেলাইট টাউনের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা থেকে উঠে এসেছে বিভিন্ন বিষয়। যেমন হংকং ও সিঙ্গাপুরে প্রধানত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য নির্মিত নতুন শহর সফল হয়েছিল সরকার কর্তৃক মূল শহরটির সঙ্গে এসব স্যাটেলাইট টাউনের গণপরিবহনভিত্তিক কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে। অন্যদিকে, ষাটের দশকের শেষ ভাগে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্যে এর ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে যে স্যাটেলাইট টাউন চিন্তা করা হয়েছিল, তা সফলতার মুখ দেখেনি। কারণ, অধিবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না থাকায় জনগণ আবার মূল শহরেই ফিরে এসেছিল।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও বেশ কয়েকটি বড় শহরের বিবর্ধন ব্যবস্থাপনার জন্য স্যাটেলাইট টাউন তৈরি করে। কলকাতায় এ ধারণার প্রয়োগ আংশিকভাবে সফল হলেও মেট্রোপলিটন মুম্বাইয়ের ক্ষেত্রে তার স্থানিক নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠীর (যেমন: শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী এবং সর্বোপরি সমাজের শিক্ষিত-সংগঠিত মধ্যবিত্ত অংশ) পরস্পরবিরোধী অবস্থান এবং স্থানীয় নীতিনির্ধারকদের প্রতিবন্ধকতার কারণে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।
বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টাউন তৈরির চিন্তা বোধ করি প্রথম করা হয় ১৯৬০-এর দশকে, ঢাকা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে উত্তরায় টাউনশিপ গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নেওয়ার মাধ্যমে। শুরুতে এই প্রকল্পের নাম ছিল ‘নর্থ স্যাটেলাইট টাউন’। ১৯৮০ সালে তৎকালীন ডিআইটির (বর্তমান রাজউক) বোর্ড সভায় এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘উত্তরা রেসিডেনসিয়াল মডেল টাউন’। ডিআইটির তত্ত্বাবধানে ১৯৬৬ সালে শুরু হওয়া এই আবাসন প্রকল্প পূর্ণতা পেতে সময় লেগে গেছে ৩০ থেকে ৪০ বছর। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উত্তরার সঙ্গে মূল ঢাকার অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি বা কর্মসংস্থানসহ দৈনন্দিন সুযোগ-সুবিধা তৈরি না করেই কেবল আবাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টার কারণে এর বাস্তবায়নে এতটা সময় লেগেছে। ফলে, ‘উত্তরা মডেল টাউন’ আবাসনসমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখলেও ঢাকার বিবর্ধন ব্যবস্থাপনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং একসময় ঢাকা থেকে দূরে অবস্থিত উত্তরা নিজেই এখন ঢাকার, তথা সিটি করপোরেশনের অংশে পরিণত হয়েছে, যা সর্বতোভাবে স্যাটেলাইট শহরের মূল উদ্দেশ্য ও কার্যকর নগর পরিকল্পনার পরিপন্থী।
এসব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও রাজউক নতুন করে রিজিয়নাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান প্রকল্পের আওতায় স্যাটেলাইট টাউন নির্মাণের কথা ভাবছে। উল্লেখ্য, ১৯৯৫-২০১৫ সময়সীমার জন্য প্রণীত ঢাকার স্ট্রাকচার প্ল্যানে ঢাকার বিবর্ধন ব্যবস্থাপনার জন্য স্যাটেলাইট টাউনকে অপ্রয়োজনীয় ও অকার্যকর আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তার পরও নতুন প্রকল্পের মধ্যে স্যাটেলাইট টাউন ধারণাকে যেভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা লক্ষণীয়। বলা হচ্ছে, প্রকল্পের একটি উদ্দেশ্য: ‘ঢাকার জন্য স্যাটেলাইট শহরের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং একটি স্যাটেলাইট শহরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা’। একই প্রকল্পে একদিকে স্যাটেলাইট শহরের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা বলা হচ্ছে এবং অন্যদিকে তার মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কথাও বলা হচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, যেকোনো মূল্যে স্যাটেলাইট টাউন তৈরি করতে হবে এমনটি ভেবেই প্রকল্পের কর্তাব্যক্তিরা অগ্রসর হচ্ছেন। বিষয়টির কারিগরি বৈধতা দেওয়ার জন্যই সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রসঙ্গ এসেছে। আগেভাগে স্যাটেলাইট টাউন তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে তাতে পরবর্তী সময়ে কারিগরি বৈধতা দেওয়ার সংস্কৃতি কেবল রাজউকের প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলবে না, বরং নগর পরিকল্পনা পেশার সুস্থ বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করবে।
আমাদের আশঙ্কা বাস্তব ভিত্তি পায়, যখন আমরা দেখি, স্যাটেলাইট টাউন তৈরির উদ্দেশ্য সামনে রেখে রাজউক তিনটি অঞ্চলের (সাভার, গাজীপুর ও ইস্টার্ন ফ্রিঞ্জ) মধ্য থেকে সিটি করপোরেশন-সংলগ্ন ইস্টার্ন ফ্রিঞ্জকে সম্ভাব্য স্থান হিসেবে নির্বাচন করে। বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর আয়তন ও জনসংখ্যা ঘনত্বের তুলনামূলক বিবেচনায় রাজধানী ঢাকার যে অবস্থান, তাতে এর বিবর্ধন ব্যবস্থাপনায় স্যাটেলাইট টাউন যদি মেট্রোপলিটন ঢাকার সীমার মধ্যে তৈরি করা হয়, তা আত্মঘাতী হবে বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়। কারণ, এ ক্ষেত্রে শহরের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগব্যবস্থা, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের অবকাঠামো, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে শহর ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে। এমতাবস্থায় যখন দেখি রাজউক পরিকল্পনা প্রণয়নের নামে দুর্যোগপ্রবণ (বন্যা ও ভূমিকম্প) অঞ্চল বলে চিহ্নিত বালু নদের পশ্চিম পার্শ্বে উত্তরে পূর্বাচল রোড থেকে দক্ষিণে ঢাকা-ডেমরা রোড পর্যন্ত বিস্তৃত ইস্টার্ন ফ্রিঞ্জের ডুমনি, বেরাইদ, কায়েতপাড়া ও আমুলিয়ার পাঁচ হাজার ৩৪৫ একর জায়গাকেই স্যাটেলাইট টাউন তৈরির সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলছে (সূত্র: ২৮ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স মিলনায়তনে উপস্থাপিত আরডিপি প্রকল্পের কার্যপরিধি), তখন আমরা ভবিষ্যৎ ঢাকার বসবাসযোগ্যতা নিয়ে আতঙ্কিত হই। স্পষ্টতই মনে হয়, শুধু গোঁজামিল দিয়েই এ ধরনের জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্তের বৈধতা দেওয়া সম্ভব।
এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো ইস্টার্ন ফ্রিঞ্জ এলাকায় ভূমির মালিকানা এবং ব্যবহারের ধরন। একটু কষ্ট করে গুগল ম্যাপের মাধ্যমে হিসাব করলে দেখা যায়, প্রস্তাবিত স্যাটেলাইট শহর ও এর আশপাশের এলাকার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ নিচু জমি ইতিমধ্যেই বালু দিয়ে ভরাট করা হয়ে গেছে। বুঝতে কষ্ট হয় না, এসব জমি কার আয়ত্তে রয়েছে। রাজউক কি তবে আবাসনসমস্যার সমাধানকল্পে প্রস্তাবিত স্যাটেলাইট টাউন তৈরির জন্য ক্ষমতাবান ভূমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করবে? নাকি গ্যাস, পানি, রাস্তাঘাটের মতো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাজউক আসলে কতিপয় ভূমি ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষা করবে? এই আচরণ দেখে ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, যেখানে বিদ্যমান নগরের মূল অংশে সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা অপ্রতুল, সেখানে সংকট তীব্রতর হতে দিয়ে নতুন শহর তৈরি করার মাধ্যমে জমির মুনাফাসর্বস্ব ব্যবসায় জনগণের অর্থে ভর্তুকি দিতে রাজউকের এত উৎসাহ কেন?
ঢাকার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ কমানোর লক্ষ্যে স্যাটেলাইট টাউন নির্মাণই একমাত্র উপায় কি না, এ প্রশ্ন যেমন বিবেচনাসাপেক্ষ, তেমনি এমন ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হলে এর পরিকল্পনা হতে হবে বৃহৎ কলেবরের গবেষণা ও পর্যালোচনানির্ভর। এ ক্ষেত্রে ভুল হলে তা কেবল ঢাকা নয়, সারা বাংলাদেশের নগরায়ণের জন্য নেতিবাচক ও আত্মঘাতী হবে। পরিকল্পনার বাতাবরণে নগরের বাসযোগ্যতার অবনতির বৈধতা দেওয়া সুস্থ প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার নজির নয়। আমাদের আশঙ্কা অতীতেও রাজউকের (উত্তরা) স্যাটেলাইট শহর যেভাবে তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, চলমান প্রকল্পের আলোকে নির্মিতব্য শহর একই ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে ঢাকাবাসী ও ঢাকার বর্তমান অতিব্যবহৃত অবকাঠামোর ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকার ভেতরে এ ধরনের নগরায়ণ কৃষিজমি ও জলাশয় হ্রাসসহ ভূমির উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতেও ব্যর্থ হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও গবেষক হিসেবে আমাদের পেশাগত জ্ঞানের আলোকে স্যাটেলাইট টাউন তৈরির প্রস্তাবিত স্থান নির্বাচনে রাজউক কর্তৃক গৃহীত পরিকল্পনার গুরুতর ত্রুটিগুলো তুলে ধরলাম। রাজউক আমাদের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে দ্রুতই এ তৎপরতা থেকে সরে আসবে; সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদেশি ঋণের টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে—এটাই প্রত্যাশা।
সারওয়ার জাহান, মোহাম্মদ শাকিল আখতার আফসানা হক, অনিন্দ্য কিশোর দেবনাথ দীপিতা হোসেন, তানজীব আহমেদ, লেখকেরা নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েটের শিক্ষক।