স্মার্টফোনের নেশা ছেড়ে শিশুদের সময় দিন

মা-বাবার প্রযুক্তি আসক্তির প্রভাব সন্তানের ওপরও পড়ে। মডেল: আফসান, মনিরুল
 ছবি: কবির হোসেন

আমাদের স্বাভাবিক দৈনন্দিন যাপিত জীবনযাপনের মধ্যে হঠাৎ করেই করোনা নামের এক মহামারির আগমন ঘটে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে উল্টেপাল্টে দেয়। করোনা পরিস্থিতিতে দেহ ও মনের যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন হয়ে গেছে, সেটা আমরা বুঝতে পারলেও শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়টি কঠিন। ফলে করোনা-পরবর্তী শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের আলাদা করে ভাবতে হচ্ছে।

দেড় বছরের বেশি সময় শিশুরা ঘরবন্দী ছিল। পড়াশোনার স্পর্শের বাইরে ছিল। একজন শিশুর মানসিক বিকাশের পেছনে পরিবারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে পরিবার কখনোই শিশুর মানসিক বিকাশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তার বিকাশ সাধনের পরিপূর্ণ আশ্রয়স্থল। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই একজন শিশু শিখতে পারে কীভাবে মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করা যায়, কারা সম্মানিত গুরুজন, কীভাবে বিনয়ী হতে হয়, কীভাবে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। অন্যদিকে নিয়মিত খেলাধুলা শরীরকে সতেজ এবং রোগমুক্ত করে তোলে। কিন্তু দীর্ঘ করোনা সময়ের স্থবির পরিস্থিতি সবকিছুর মতো শিশুদের প্রাত্যহিক জীবনকেও এলোমেলো করে দেয়। পারিপার্শ্বিকতার বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন তাদের মনোজগতে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করেছে।

করোনার বিধিনিষেধ এখন তুলে ফেলা হয়েছে। আর সবকিছুর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো পুরোপুরি ক্লাস চালু হয়নি। গত আঠারো মাসের শিক্ষার ক্ষতিও শিশুদের বইতে হচ্ছে এখন। সবকিছু মিলিয়ে শিশুদের মধ্যে মানসিকভাবে বড় পরিবর্তন আসছে। তাদের মধ্যে একঘেয়েমি, হতাশা, বিরক্তির বিষয়গুলো দেখা যাচ্ছে বেশি। এসব বিষয়ে কারণে তারা স্মার্টফোন, কম্পিউটার ও টেলিভিশনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। দিনভর ডিভাইসের অতল সমুদ্রে মোহাচ্ছন্ন হয়ে ডুবে থাকছে তারা। এতে তাদের চিন্তাভাবনার পরিসরটা খুবই সীমিত হয়ে যাচ্ছে। ডিভাইস নামের নেশা তাদের ভেতর এবং বাইরের জগৎকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করে নিচ্ছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের শঙ্কায় ফেলে দিচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গুত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠা নতুন এক প্রজন্মকে।

এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের করণীয় কী হতে পারে? প্রথম এবং সর্বোত্তম গুরুত্বের বিষয় হচ্ছে, সময়। কারণ, অর্থের চেয়ে সময় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। মা-বাবাসহ পরিবারের সবার উচিত শিশুদের বেশি সময় দেওয়া। কারণ, শিশুরা যখন উদ্বিগ্ন থাকে, তারা প্রিয়জনদের কাছাকাছি থাকতে চায়। তাই তাদের সঙ্গে গল্প করা, খেলাধুলা করা, অধিকাংশ সময় তাদের পাশে পাশে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাতে শিশুরা কখনো একাকিত্ব বোধ করতে না পারে। তাদের সাহস দিতে হবে। সরাসরি জোরপূর্বক ডিভাইস কেড়ে নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বরং ডিভাইসের বিকল্প হিসেবে শিশুদের কার্টুন, কমিকস, শিক্ষণীয় গল্প এবং জ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন বই কিনে দিয়ে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

শিশুদের সঙ্গে যথাসম্ভব কোমলতার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তা ছাড়া পারিবারিকভাবে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বিনোদনের আয়োজন করা যেতে পারে। ঘরে বাগান কিংবা বিভিন্ন শখের পাখি পালন করলে শিশুরা সেখানে সময় অতিবাহিত করতে পারবে।

সর্বোপরি, এমন অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার নিমিত্তে শিশুদের পেছনে সর্বোচ্চ সময় দেওয়ার বিকল্প অন্য কিছুই হতে পারে না। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় বিন্দুমাত্র অবহেলা নিয়ে আসতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। তাই শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে সব অভিভাবকের সচেতন থাকা অতি জরুরি। শিশুর জীবন বিকাশের পূর্বশর্ত, তার পরিপূর্ণ মননশীলতার বিকাশসাধন।

আনোয়ার হোসেন
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়