জাতীয় সংসদের সাম্প্রতিক অধিবেশন শুরুর দিনটিতে রেওয়াজ হিসেবে বর্তমান বা আগের কোনো সাংসদ, দেশ-বিদেশের কৃতী ব্যক্তি যাঁরা অবকাশকালে মারা গেছেন, তাঁদের স্মরণে কিছু আলোচনা হয়। প্রণীত হয় শোক প্রস্তাব। চলমান সংসদের কোনো সদস্য মারা গেলে শোক প্রস্তাব গ্রহণের পর প্রথম দিনের অধিবেশনটি মুলতবি হওয়ার বিধানও রয়েছে কার্যপ্রণালি বিধিমালায়। এই অধিবেশনেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে চলমান সংসদের বিরোধী দলের প্রয়াত নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রসঙ্গে আলোচনার ধারা আর শোক প্রস্তাব কিছুটা বিস্ময় সামনে নিয়ে এসেছে।
উচ্চ আদালত এক রায়ে জিয়াউর রহমান ও এরশাদকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। সে বিবেচনায় তাঁদের রাষ্ট্রপতি বলা যায় না বলেও জোর দাবি রয়েছে। তবে আদালতের এ পর্যবেক্ষণ দ্বারা সংসদের কার্যবিবরণী পরিচালিত হওয়ার কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু নৈতিক একটি দিক সামনে আসে। সংসদ নেতা থেকে শুরু করে সরকারি দলের অনেক সদস্য বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁদের কথায় এসেছে উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণের বিষয়টি। এরশাদের কিছু প্রশস্তির সঙ্গে সমালোচনাও ছিল সেসব বক্তব্যে। মৃত্যু যেকোনো ক্ষেত্রে একটি শোকাবহ অধ্যায়। আর সে মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে ভালো কথা বলাও একটি সামাজিক প্রথা। তবে বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে সে ধরনের ভালো কথা বলতেও কুশলী হতে হয়। কেননা এগুলো ইতিহাস চর্চার অংশ হবে। এমনকি জাতীয় সংসদের শোক প্রস্তাবটিও সে উপাত্তের অংশ হবে। সে প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে এরশাদ ছিলেন ‘একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, সফল রাষ্ট্রনায়ক এবং নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক’। অথচ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর চরম গণ-আন্দোলনের মুখে তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল একজন স্বৈরশাসকের আখ্যা নিয়ে। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আজকের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলসহ জাতীয় পার্টি ব্যতীত অন্য প্রায় সব দলই আন্দোলনে ছিল।
এরশাদ দণ্ডিত হয়েছিলেন দুর্নীতির দায়ে। আর সে দণ্ড বহাল ছিল সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত। তাঁকে ভোগ করতে হয়েছে সে দণ্ড। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রথমে তিনি ঢাকার সেনানিবাসের বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার ব্যাপক দাবি ছিল তাঁকে গ্রেপ্তারের। অপ্রতিরোধ্য সেই দাবির মুখে তখনকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি গুলশানের একটি বাড়িকে সাবজেল ঘোষণা করে তাঁকে অন্তরীণ করেন। এরপর সংসদ নির্বাচন হলে অধিবেশনে এটা নিয়ে তুমুল বিতণ্ডা হয়। এরশাদকে পাঠানো হয় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে। সে বিতর্কের বিবরণী নিশ্চয়ই সংসদে রক্ষিত আছে। তখন কারা কী বলেছিলেন, তা লেখা আছে। তবে এটা ঠিক, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরপর এক রকম বৈরী পরিবেশে নির্বাচন করে তাঁর দল সংসদে ৩০টির অধিক আসন লাভ করে। তিনি নির্বাচিত হন ৫টি থেকে। আর পরবর্তী সময়ে এরশাদ সংসদের কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি।
এ ছাড়া এরশাদ আমাদের প্রধান দুটি দলের পারস্পরিক সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানের সুযোগে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতার নির্ণায়ক বনে যান। ১৯৯৬-এর জুনে নির্বাচনের পরপর তিনি সরকার গঠন করতে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেন। বিনিময়ে লাভ করেন কারামুক্তি। আবার ২০০১-এ তাঁর অবস্থান থাকে আওয়ামী লীগের বিপরীতে। আবার ২০০৮ সাল থেকে অনেকটা একাত্ম হয়েই আছেন বর্তমান সরকারি দলের সঙ্গে। তাঁর দলের কেউ কেউ পাঁচ বছর মন্ত্রিত্বের স্বাদ নেওয়ার সুযোগও পেয়েছেন। তিনিও মন্ত্রী মর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদে ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর দাফন হয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। দল গঠন ও পরিচালনার জন্য অনেক ক্ষেত্রে তিনিও তাঁর পূর্বসূরির মতোই সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। মূলত ১৯৯০ সালে সামরিক বাহিনী জনগণের বিপরীতে অবস্থান নিতে অস্বীকৃতি জানানোয় এরশাদকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
এরশাদ ক্ষমতা গ্রহণের আগে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। জিয়ার হত্যাকারী বলে কথিত জেনারেল মঞ্জুরকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়। এতে এরশাদের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হয় ব্যাপকভাবে। এ–সংক্রান্ত একটি হত্যা মামলা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো সরকারই উৎসাহ নিয়ে চালায়নি। তাঁর মৃত্যুতে মামলাটিরও অপমৃত্যু ঘটল। জিয়াউর রহমানের পর স্বল্পকালের জন্য রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সাত্তার। তিনি বিএনপির পুরো অংশের সমর্থন পাননি। পক্ষান্তরে তদানীন্তন সেনাপ্রধান এরশাদ একপর্যায়ে প্রকাশ্যে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকেন। শেষাবধি দখল করে নেন রাষ্ট্রক্ষমতা। জারি করেন সামরিক আইন। কিছুদিন পরেই নিজেকে আসীন করেন রাষ্ট্রপতি পদে। তবে ক্ষমতা দখলের অল্প সময়ের ব্যবধানে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতার মুখে পড়েন তিনি। তখন বিক্ষোভ দমনের যে প্রক্রিয়া আমরা দেখেছি, সেগুলো ভুলে যাওয়ার নয়।
‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’, শরীরে লিখে মিছিলে গিয়ে নিহত কিশোরের স্মৃতি এখনো অনেকেই মনে রেখেছেন। বলা যেতে পারে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে সব শাসক যে প্রক্রিয়া নেন, এরশাদও তা-ই করেছেন। তবে তাঁর সেই ক্ষমতা গ্রহণের প্রক্রিয়া ছিল অসাংবিধানিক ও অগণতান্ত্রিক। যদিও অঞ্চলবিশেষে তিনি কিছুটা জনপ্রিয়তার জোরে সংসদের কিছু আসন নিজ দলের আওতায় রাখতে পেরেছেন, তবে গোটা দেশে তিনি কখনোই জনপ্রিয় ছিলেন না। তিনি ও তাঁর পূর্বসূরি জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া কিছুটা ভিন্ন হলেও গণভোট, রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনের ধারা ছিল অনেকটা এক। কোনো ক্ষেত্রেই সংবিধান কার্যকর ছিল না।
শোক প্রস্তাবে এরশাদ সম্পর্কে তিনটি বিশেষণ এসেছে। এর মধ্যে ‘তিনি প্রবীণ রাজনীতিবিদ’ বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের সুযোগ নেই।
গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়েও রাষ্ট্রক্ষমতার কাঠি নাড়াচাড়ায় তাঁর ভূমিকাও নজরে আসার মতো। তবে তাঁকে নিবেদিতপ্রাণ সমাজসেবক কীভাবে বলা যাবে। এত বছর ক্ষমতায় থাকলে কিছু সমাজসেবামূলক কাজ তো অনেকেই করেছেন ও করছেন। এ বিশেষণ কেন শোক প্রস্তাবে জুড়ে দেওয়া হলো, তা বোধগম্য নয়। সর্বোপরি তাঁকে সফল রাষ্ট্রনায়ক কীভাবে বলা যায়? যিনি ক্ষমতায় এসেছেন রাতের অন্ধকারে অস্ত্রের জোরে। তাঁর প্রস্থান ঘটেছে গণধিক্কৃত হয়ে আন্দোলনের মুখে। তাঁকে সৌজন্যমূলকভাবেও এভাবে লেখা হলে ইতিহাসের বিকৃতি হবে।
এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছেন প্রায় ৯ বছর। কানায় কানায় নিয়েছেন এর সুবিধাদি। বরং বিশ্লেষকেরা দ্বিমত করবেন না, প্রশাসনের উঁচু স্তরে দুর্নীতির বীজ বপন হয় অনেকটা তাঁর সময়ে। উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তিনি স্থানীয় সরকারকাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
তবে ভিন্নভাবে বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা দরকার। থানা পরিষদ নামক অনেকটা একই ধরনের কাঠামো নিয়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চলছিল পাকিস্তান সময়কাল থেকেই। তবে এর শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন সরকারি চাকুরেরা। এ ব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন তিনি করেছেন। কিন্তু এর পেছনে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের মতো একটি বেসামরিক ক্ষমতার বলয় তৈরি করা ছিল এর একটি উদ্দেশ্য। সেটা প্রাথমিকভাবে সফল হওয়ার পর উপজেলা পরিষদের ক্ষমতার আওতা তাঁর সময়েই ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়াসহ বেশ কিছু ক্ষমতা তিনি আবার কেন্দ্রীভূত করেন।
ইতিহাস চর্চা করতে হলে মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা আসবে। তাঁর জীবনের সে অধ্যায়টি কদর্য ছিল। আলোচিত ছিল দেশে-বিদেশে। এগুলো করে শুধু নিজেকে নয়, তিনি ছোট করেছেন রাষ্ট্রপতির পদকে। অর্থনৈতিক সূচক বলবে, তাঁর সময়কালে অর্থনীতির গতি ছিল নিম্নমুখী। উন্নয়ন বাজেট তো বটেই, রাজস্ব বাজেটের কিছু অংশও মেটাতে হতো বৈদেশিক ঋণের অনুদান থেকে। সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ যুক্ত করে তিনি যে ক্ষতি করে গেছেন, তা একটি স্থায়ী ক্ষত। এমন একজন প্রয়াত শাসকের মৃত্যুতেও সংসদে শোক প্রস্তাব আসবে। তবে শব্দচয়নে পরিমিতিবোধের অভাব লক্ষ করছি আমরা সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রস্তাবটিতে। অন্তত সেদিন সংসদে যে ধাঁচে আলোচনা হয়েছে, শোক প্রস্তাবটি অনেকাংশে এর সঙ্গে সংগতিহীন।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali1950@gmail.com