সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের লক্ষ্যে ২০১২ সালে প্রণীত ২০ বছর মেয়াদি স্বাস্থ্যসেবায় অর্থায়ন কৌশলপত্র: ২০১২-৩২ অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট টাঙ্গাইলের তিনটি উপজেলায় ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি’ বা এসএসকে নামে একটি পাইলট প্রকল্প ২০১৬ থেকে বাস্তবায়ন করছে। দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষদের বর্তমানে এ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। এ প্রকল্পের অধীন নিবন্ধনকৃত প্রতিটি পরিবার বছরে ৫০ হাজার টাকার চিকিৎসাসুবিধা পায়, যা বর্তমানে শুধু ইনপেশেন্ট (হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যে সেবা নিতে হয়) সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
এ প্রকল্পের সুবিধাভোগীদের স্বাস্থ্যসেবা মূলত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে দেওয়া হয়। তবে জেলা হাসপাতাল রেফারেল সেবা প্রদান করে। রোগের ধরন অনুযায়ী সেবার বিনিময় হিসেবে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে রোগীপ্রতি ৯২৪ থেকে ১৮ হাজার ৬৭৫ টাকা প্রদান করা হয়। এ অর্থ মূলত সুবিধাভোগীর ওষুধ ও রোগনির্ণয়ের সেবা বাবদ ব্যয় করা হয়। তা ছাড়া রেফার্ড রোগীর অ্যাম্বুলেন্সের ব্যয়, রেফার্ড হাসপাতালের সেবার মূল্য, হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও ব্যয় করা হয়। উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে হাসপাতালের অভ্যন্তরে এসএসকে ফার্মেসি পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়ে থাকে। যেখান থেকে প্রকল্পের রোগীরা ওষুধ পেয়ে থাকেন।
এসএসকে থেকে প্রাপ্ত অর্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়। এ ছাড়া ডায়াগনস্টিক ল্যাবের সেবা সচল রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যয় এখান থেকে বহন করা হয়। আবার বেসরকারি ল্যাব থেকে সেবা নেওয়ার প্রয়োজন পড়লে তার ব্যয়ও এ তহবিল থেকে মেটানো হয়। তবে এসএসকের মূল মডেলে হাসপাতালে কর্মরত জনবলের জন্য প্রণোদনা প্রদানের বিধান থাকলেও তার প্রচলন এখনো হয়নি। ফলে কর্মরত জনবলের মধ্যে মোটিভেশনের যথেষ্ট অভাব রয়েছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে। একদিকে যেমন কাজের চাপ বেশি, অন্যদিকে তাঁদের ওপর নজরদারিও বেশি। ফলে এ হাসপাতালে কেউ পদায়িত হলে তিনি অন্যত্র বদলির চেষ্টা করেন। তাই এ হাসপাতালগুলোতে জনবলেরও অনেক ঘাটতি রয়েছে। তাই বিকল্প হিসেবে সরকারি হাসপাতালকেও এ প্রকল্পে তালিকাভুক্ত করার কথা ভাবা হচ্ছে।
এসএসকে মডেলে কিছু নতুন দিক আছে, যেমন সরকারি হাসপাতালকে সরকারের অন্য একটি সংস্থা থেকে সেবামূল্য গ্রহণের সুযোগ দেওয়া; প্রাপ্ত অর্থ থেকে সরকারের মূল্যতালিকা অনুযায়ী ডায়াগনস্টিক সেবার মূল্য ও অ্যাম্বুলেন্স চার্জ সরকারি কোষাগারে জমাদান এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ওষুধ ও ডায়াগনস্টিক সেবা প্রদানের সঙ্গে যুক্ত করা। তবে উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে হাসপাতালের জনবলকে প্রণোদনা দেওয়া ও প্রয়োজনে বেসরকারি হাসপাতালকে যুক্ত করা ছাড়া বাকি সব উপাদান বর্তমানে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত অর্থের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কর্মরত জনবলকে প্রণোদনা এবং বাকি ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যয়ের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। উপাদানের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এসএসকের মতো একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প বড় পরিসরে বাস্তবায়ন করা উচিত কি না, তা ভাবা প্রয়োজন। তা ছাড়া এ স্কিম বড় পরিসরে চালুর আগে এটির ব্যবস্থাপনার জন্য একটি শক্তিশালী ‘স্বাধীন ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান’ প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। পরবর্তীতেও এ ব্যবস্থাপনা কোনোভাবেই স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট কিংবা স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের ওপর বর্তানো উচিত নয়।
আবার সরকারি হাসপাতালের জনবলকে প্রণোদনা না দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালকে যুক্ত করলে ফলাফল কী হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। বর্তমানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে রেফারেল পদ্ধতিতে সেবা নেওয়ার যে বিধান চালু আছে, সেখানে রেফার করার প্রবণতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আর বেসরকারি হাসপাতালকে অন্তর্ভুক্ত করলে সরকারি হাসপাতাল যতটুকু সেবা বর্তমানে দেয় তা–ও দেবে কি না, তা সময় বলে দেবে। তাই বেসরকারি হাসপাতালকে অন্তর্ভুক্তির আগে সরকারি হাসপাতালের জনবলের প্রণোদনার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর প্রণোদনার বিষয়টি স্বাস্থ্য খাতে নতুন নয়। আর স্বাস্থ্য খাতের বাইরেও যেমন ট্রাফিক পুলিশ গাড়ির অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য কেস ফাইল করলে প্রণোদনা পায়। আয়কর ও কাস্টমস কর্মকর্তারা কর বা শুল্ক ফাঁকি উদ্ঘাটনের জন্য প্রণোদনা পান। তাই এ ক্ষেত্রে প্রণোদনার বিষয়টি পরীক্ষামূলক অনুশীলন করে দেখা যেতেই পারে। এর মাধ্যমে আশা করা যায়, এসএসকে প্রকল্প থেকে বর্তমানের তুলনায় ভালো ফল আসতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি যদি চলমান রাখা হয় এবং অন্যত্র বিস্তৃত করা হয়, তাহলে কেন তা সর্বজনীন হবে না? সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, সাধারণত যঁারা উপযুক্ত নন, তাঁদের অনেকে এতে অন্তর্ভুক্ত হন এবং যঁারা উপযুক্ত, তাঁদের অনেকে বাদ পড়েন। আর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এটি আরও সত্য। বাংলাদেশের বাস্তবতায় তো এ সমস্যা আরও ভয়াবহ। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সর্বজনীন হওয়াই সমীচীন। আর এসএসকে স্কিমের ব্যতিক্রম নয়। ধরুন একটি পরিবার আর্থিকভাবে মোটামুটি সচ্ছল, কিন্তু ওই পরিবারের কোনো এক সদস্য দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তা সহজেই আর্থিকভাবে ভেঙে পড়ে। তা ছাড়া সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি আর্থিক সংকটের কারণে চিকিৎসাসেবা গ্রহণে বিরত থাকলে তাঁর পরিবার, সমাজ তথা সব মানুষই হুমকির মুখে পড়ে। কোভিড-১৯ তার একটি বড় প্রমাণ। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অন্যান্য সামাজিক কর্মসূচি থেকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ভাবতে হবে।
হাসপাতালে সব রোগীই একই রকম সেবাপ্রাপ্তির দাবিদার। একই হাসপাতাল বিশেষ ও সাধারণ কর্মসূচির মাধ্যমে সেবা প্রদানে পার্থক্য থাকলে একধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এটার প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাও বেশ দুরূহ। আর সর্বজনীন না হলে কোনো কর্মসূচির গুণগত মানও বজায় রাখা যায় না। এ কথা সত্য যে এ ধরনের কর্মসূচি সর্বজনীন করতে গেলে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন। তবে এমন কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রশাসনিক ব্যয়ও কিন্তু কম নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য অবৈধ চাঁদা আদায়সহ সামাজিক ব্যয় অনেক বেশি। তা ছাড়া কোনো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সর্বজনীন করলেই সব মানুষ তাতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। ৩০-৪০ শতাংশ মানুষ যাঁদের আয় বেশি, তাঁরা সেখানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকেন। তা ছাড়া কর্মসূচি সর্বজনীন হলে প্রশাসনিক ব্যয়ও অনেকাংশে কমে যায়, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে এমএসআরের জন্য কম বরাদ্দের প্রয়োজন হয়। এতে খরচ সাশ্রয় হবে। ফলে এ ধরনের স্কিম সর্বজনীন হলেই বেশি ‘কস্ট–ইফেক্টিভ’ হয়। গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, স্বাস্থ্য খাতের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় সংশোধিত বাজেট প্রায় ১৫ শতাংশ কম। আবার সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রকৃত খরচ ১০-১৫ শতাংশ কম হয়। তাই এসএসকে প্রকল্প সর্বজনীন হলে চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার যে বাড়তি খরচের প্রয়োজন হবে, তার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের পরিমাণ বাড়ানোর তেমন প্রয়োজন হবে না।
২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও এখন পর্যন্ত এটার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো প্যাকেজ নির্ধারণ করতে পারিনি। ইএসপির কথা বলা হলেও তা অনেক বিস্তৃত। তাই প্রাথমিক সেবার সঙ্গে এসএসকে স্কিমের ১১০টি রোগের প্যাকেজকে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের প্যাকেজ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এটা সর্বজনীন করা হলে মানুষ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ইনপেশেন্ট স্বাস্থ্যসেবা নিতে উদ্বুদ্ধ হবেন। ফল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে শয্যা ব্যবহারের হার বাড়বে। এতে জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীর চাপ কমবে এবং সেসব হাসপাতালে মানসম্মত সেবা প্রদানের পথ সুগম হবে। হাসপাতালগুলোকেও এসএসকের রেফারেল হাসপাতাল হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করলে উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সঙ্গে এসব হাসপাতালের কার্যকর রেফারেল পদ্ধতি গড়ে উঠবে। অন্যদিকে সরকারিভাবে জনগণকে যে পরিমাণ স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়, তার প্রকৃত মূল্যও সহজে জানা সম্ভব হবে। স্বাস্থ্য খাতে সরকার যে পরিমাণ ব্যয় করে, কেবল তা হিসাবে আনা হয়। কিন্তু এ ব্যয় থেকে যে স্বাস্থ্যসেবা উৎপাদিত হয়, তার মূল্য হিসাবে আনা হয় না। সার্বিক অর্থে এসএসকে সর্বজনীন হলে সরকারের রাজনৈতিক সাফল্যের পাল্লাও ভারী হবে।
● ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়