করোনাকালে পুরোটা সময়জুড়ে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে খিস্তিখেউড় কম হয়নি। চলমান কোভিডসহ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো যে অপরিহার্য, তা নীতিনির্ধারণী ও বিজ্ঞ মহলের অজানা নয়। এ খাতের মূল সমস্যাগুলো এবং তা সমাধানে কী করণীয়, তা-ও অনেকের জানা আছে। তা ছাড়া পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে এ-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ মতামত ছাপা হয়েছে। আর বিভিন্ন ওয়েবিনার ও টেলিভিশন টক শোতেও এ-সংক্রান্ত নানা আলোচনা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে বহুবিধ বাস্তবসম্মত পরামর্শ।
কিন্তু একটি সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়া স্বাস্থ্য খাতের মূল চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আর জনস্বাস্থ্য শুধু স্বাস্থ্য খাতের ওপর নির্ভর করে না। তাই স্বাস্থ্য খাতকে অন্যান্য খাত থেকে ভিন্নভাবে ভাবতেই হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, হাসপাতাল একটি অত্যন্ত জটিল ইন্ডাস্ট্রি, যেখানে বিভিন্ন ইনপুট-মিক্স এবং স্কিল-মিক্সের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা উৎপাদন করতে হয়। অন্যভাবে বলা যায়, স্বাস্থ্যসেবা উৎপাদনে একটি টিম প্রয়োজন হয়, যেখানে ক্লিনার কিংবা আয়াও একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাই অন্যান্য খাতের মতো কমন নিয়মকানুন দিয়ে স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা করা যায় না। এ খাত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, অন্যদিকে প্রয়োজন কিছু বিশেষ নিয়মকানুন।
যুগোপযোগী কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া গতানুগতিকতা কিংবা জোড়াতালি দিয়ে এ খাত থেকে সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এ খাতের মূল সমস্যা বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ১০ থেকে ১৫ বছর মেয়াদি যুগোপযোগী ও প্রয়োগযোগ্য একটি রূপরেখা তৈরি করা। এ রূপরেখা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত বিশ্বের পর্যায়ে উন্নীত করবে যেন দেশবাসী গুণগত মানের সব স্বাস্থ্যসেবা দেশ থেকে নির্বিঘ্নে পেতে পারে।
কিন্তু একটি প্রশ্ন তো রয়ে যায়, স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত পরিবর্তনের রূপরেখা তৈরির সূত্রপাত কীভাবে হবে? কেউ কেউ একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তনে কী করণীয়, তা নির্ধারণের কথা বলেছেন। কিন্তু এ ধরনের কোনো টাস্কফোর্স বা কমিটি গঠনের কোনো উদ্যোগের কথা এখন পর্যন্ত শুনতে পাইনি। তাই স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত পরিবর্তনের রূপরেখা তৈরিতে ‘বিড়ালের গলায় ঘণ্টা কে বাঁধবে’, তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির অল্প সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত দুটো মিটিংয়ে কিছু কার্যকরী দিকনির্দেশনা বেশ আশার সঞ্চার করেছে।
যুগোপযোগী কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া গতানুগতিকতা কিংবা জোড়াতালি দিয়ে এ খাত থেকে সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এ খাতের মূল সমস্যা বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ১০ থেকে ১৫ বছর মেয়াদি যুগোপযোগী ও প্রয়োগযোগ্য একটি রূপরেখা তৈরি করা।
বর্তমান এবং সাবেক তিন স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে গঠিত এটি নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী ও অভিজ্ঞতায় ভরপুর কমিটি। এ কমিটিই নেতৃত্ব দিতে পারে স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তনের একটি রূপরেখা তৈরির। এ কমিটির নেতৃত্বে স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তনের রূপরেখা তৈরি হলে তা সরকারের নিকট অধিক গ্রহণযোগ্য হবে এবং দ্রুত বাস্তবায়িত হবে। প্রয়োজনে তাঁরা কমিটির বাইরের বিশেষজ্ঞদেরও পরামর্শ নিতে পারেন। দেশে অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন, যাঁরা বিনা পারিতোষিকে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের পরামর্শদানে প্রস্তুত আছেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট এবং ‘বাংলাদেশ হেলথ ইকোনমিস্ট ফোরাম’ জাতীয় প্রয়োজনে পাশে থাকতে সর্বদা বদ্ধপরিকর।
কোনো বড় পরিবর্তন বা সংস্কারের জন্য একটি উপযুক্ত মুহূর্ত প্রয়োজন, যখন সংশ্লিষ্ট খাতের গুরুত্বপূর্ণ স্টেক হোল্ডাররা পরিবর্তনের পক্ষে থাকে বা কম বাধা দেয়। আর প্রয়োজন একটি শক্তিশালী সরকার, যারা এ পরিবর্তনের রাজনৈতিক, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনসহ সব পেশাজীবী সংগঠন স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত পরিবর্তনের পক্ষে। বাংলাদেশ হেলথ ইকোনমিস্ট ফোরামের বিভিন্ন ওয়েবিনারে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, বিএমডিসি ও অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ও খোলামেলা আলোচনা থেকেও এটি প্রতীয়মান হয়েছে। আর কোভিড মহামারি থেকে যদি কিছু শিক্ষা পায়, তাহলে রাজনৈতিক মহল, ব্যবসায়ী, আমলা ও আপামর জনসাধারণের কারোরই স্বাস্থ্য খাতের পরিবর্তনের বিপক্ষে দাঁড়ানোর কথা নয়। অন্যদিকে দেশে আছে একটি অভিজ্ঞ ও শক্তিশালী সরকার। তাই সব মিলে স্বাস্থ্য খাতের বড় পরিবর্তনের এমন সুযোগ জাতীয় জীবনে আর আসেনি। প্রয়োজন শুধু এ সুযোগ কাজে লাগানো।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এ দেশের স্বাস্থ্য খাতের যে পরিবর্তনের ধারা শুরু হয়েছিল, তাতে ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি ও ১৯৯৮ সালে কমিউনিটি ক্লিনিকের সংযোজন এবং পরবর্তী সময়ে ২০১০ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক পুনরায় চালুকরণ নতুন মাত্রা যোগ করে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে কাঠামোগত পরিবর্তনের ধারা সূচনার মাধ্যমে এ খাতের উন্নতি অব্যাহত থাকবে, এটাই সবার প্রত্যাশা। আমরা আশা করি, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটি এ ক্ষেত্রে পরিবর্তনের একটি রূপরেখা উপহার দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।