ক্ষুধার রাজ্যে মানুষ এখনো গোলাকার চাঁদকে রুটি মনে করে না, ঘোড়ার ডিম মনে করে। ঘোড়ারা ডিম না পাড়লেও তা নিয়ে ব্যস্ত থাকার লোকের সংখ্যা বিস্তর। নিত্যনতুন ঘোড়ার ডিম খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোর আগুন তখনো নেভেনি, অথচ ফেসবুকবাসী ব্যস্ত হয়ে পড়ল হিরো আলমের গান নিয়ে। জিনিসপত্রের দাম যখন চাঙে উঠে পড়ছে, তখন অনেকে মেতে রইলেন ব্যঙ্গ গায়ক রোদ্দুর রায়ের গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে। যখন কিনা পাচার হওয়া টাকা বৈধ করার তেলেসমাতি নিয়ে কথা বলার দরকার ছিল, দরকার ছিল এ ধারকা মাল ওধার করার বাজেটের দিকে খেয়াল রাখার, তখন ফেসবুক মহল্লায় ঝনঝন করে বাজছে একটা প্রশ্ন: স্বামীকে কেন ভাই বললেন নায়িকা মৌসুমী?
গরিবেরা হাহুতাশ করছে, মধ্যবিত্ত আছে ফেসবুকের চটুল আলাপে, ধনীরা ব্যবসার সুযোগ খোঁজায় ব্যস্ত। ওদিকে ক্ষমতাসীনরা এই তিন পক্ষকে মাতিয়ে রাখার ফন্দিফিকিরে মত্ত। এ খেলাই চলছে হরদম। খেলারামরা খেলে দিচ্ছেন। এ কায়দাতেই হারিয়ে গেল সীতাকুণ্ডে ৫০ জনের মতো মানুষের আগুনে পুড়ে কয়লা হওয়ার দায় কার, সেই প্রশ্ন। সীতাকুণ্ডের পর সিলেটগামী পারাবত ট্রেনেও আগুন! এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছিলেন, এসব নাশকতার আলামত কি না। যিনি প্রশ্নটা করেছেন, উত্তর দেওয়ার পদাধিকারীও তিনিই। কিন্তু কেউ তাঁকে এ নিয়ে আর প্রশ্ন করে বিব্রত করল না! সিলেটে ভয়াবহ বন্যা হয়ে গেল। অথচ জাতীয় চালচিত্রে দুর্গত মানুষের আহাজারির ছবি জায়গা করতে পারল না। ফেসবুকীয় হাওয়াই মিঠাই সব ভুলিয়ে দেয় গো!
যে মানুষটি মিরপুরে বা উত্তরা-গাজিপুর বা নারায়ণগঞ্জে নিত্যদিন বেতন বাড়ানোর দাবিতে নামা হাজারো শ্রমিকের মিছিল দেখছেন, তিনি তো বাস্তবতার আঁচ পেলেন, অভিজ্ঞতা পেলেন। যিনি বাজারে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম দেখে বাধ্য হলে চাহিদার চাইতে কম জিনিস সওদা করলেন, অর্থনীতির উত্তাপটা তাঁর পরিবারে গিয়ে লাগল। যিনি যানজট, লোডশেডিং, জলাবদ্ধতা কিংবা দফায় দফায় বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির দাম বাড়ায় পেরেশান, তাঁর চাইতে সরকারি সেবার হালহকিকত আর কে বেশি জানে? এসব হলো বাস্তব অভিজ্ঞতা। অথচ তাঁর ফেসবুকে গেলে দেখা যাবে, তাঁর আলাপ ইলন মাস্ক কিংবা কোরীয় ব্যান্ড বিটিএস নিয়ে, তর্ক জুড়ে দিচ্ছেন ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার ফুটবল টিমের পক্ষে, রসাল গুলতানি করছেন মৌসুমি-ওমর সানি-জায়েদ খানের ত্রিভুজ সম্পর্কের গুজব নিয়ে। দেখেশুনে মনে পড়ছে ছোটবেলায় পড়া সেই মালয় দ্বীপের বোকা শিয়ালের ছড়াটার কথা—‘ইল্যুশন অ্যান্ড রিয়্যালিটি’ তথা বিভ্রম ও বাস্তবতার কথা: ‘মালয় দ্বীপে এক যে বোকা শেয়ালে/ লাগলে খিদে মুরগি এঁকে দেয়ালে/ আপন মনে চাটতে থাকে খেয়ালে।’
আগে জনগণ সরকারকে জবাবদিহি করত, এখন সরকারই জনগণের জবাবদিহি নিচ্ছে। প্রত্যেককে যখন হরদম আনুগত্যের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে, তখন সময়ের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলোতে হাত দেওয়া ভীতিকর। এভাবেই বদলে যাচ্ছে রাজনীতির ব্যাকরণ। আগে জনগণ সরকার বদলাত, এখন দীর্ঘস্থায়ী সরকার জনগণকেই বদলে দেয়।
ফেসবুক হলো যেমন খুশি তেমন সাজার মেকি মঞ্চ। মনে মনে কলা খাওয়ার সেই দেয়াল, যেখান থেকে সুখ খোঁজা আসলে বোকারই কাজ। শিয়াল তো নিজেকে চালাকই ভাবে, কিন্তু আড়াল থেকে মজা মারে ফজা ভাইয়েরা। মুনিয়া হত্যা ইস্যুটা এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিল। একটা সময় সরকার বা বিরোধী দল কিংবা অভিযুক্ত কোনো রাঘববোয়ালকে তাঁদের কৃতকর্মের জন্য অন্তত জবাবদিহি করতে হতো, সত্য-মিথ্যা ব্যাখ্যা দিতে হতো। এখন সেসবের দরকারই পড়ছে না। মানুষের মনোযোগ ফেসবুক আর ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে ঘুরিয়ে দেওয়া যাচ্ছে।
গেরস্তের প্রিয় মোরগটিকে খাওয়ার খুব সাধ চালাক শিয়ালের। মোরগ তো গাছের ডালে উঠে বসে থাকে। তো, শিয়াল এক বুদ্ধি করল। মোরগের দিকে পেছন ফিরে নিজের লেজটাকে ঘড়ির কাঁটার মতো ঘোরাতে লাগল। লেজ নিয়ে শিয়াল কী করছে, তা দেখতে দেখতে লেজের সঙ্গে সঙ্গে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে মোরগের মাথা ঘুরতে লাগল। আর টুপ করে সে ডাল থেকে নিচে পড়ল। শিয়ালের ইচ্ছা পূর্ণ হলো।
ভানুমতিদের এমনই খেল যে সব সময়ই তাঁরা মওকামতো ইস্যুর ঠুলি দিয়ে হার্ডকোর রিয়্যালিটি বা যাকে বলে কঠিন বাস্তবতা, তা থেকে মানুষের নজর ঢেকে দিতে পারেন। ডিসট্রাকশন বা নজর ঘোরানো রাজনীতি ও যুদ্ধের দারুণ কৌশল। এ কৌশল সফল হওয়ার পেছনে মধ্যবিত্ত খাসলতও জড়িত। নিরেট অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে যেটা যত দূরে, সেটা তত মন কাড়ে। নর-নারীর প্রেম, কেলেঙ্কারি, গোপন কথা ফাঁস ইত্যাদি তো সবচেয়ে মজার।
যে পাহাড় তারা সরাতে পারবে না, যে আগুন তারা নেভাতে পারবে না, যে অন্যায়ের প্রতিকারের সাহসও তাদের কম, তা নিয়ে কথা বলে কী লাভ। এটাই কি আজকের দর্শন? ঢাকার দেয়ালে কিছু লেখা খুব আলোচিত হয়। একটা হলো, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা’। আরেকটা হলো, ‘কায়দা করে বেঁচে থাকো’। পলায়নপর মানুষ কায়দা করে বেঁচে থাকতে চায়। এই মনোভাবকেই জনপ্রিয় করা হচ্ছে মধ্যবিত্ত মহল্লায় আর তাদের ফেসবুকের দেয়ালে। শিশুরা চিপস খেতে ভালোবাসে, মধ্যবিত্ত তরুণেরা ভালোবাসে চটুলতা।
আগে জনগণ সরকারকে জবাবদিহি করত, এখন সরকারই জনগণের জবাবদিহি নিচ্ছে। প্রত্যেককে যখন হরদম আনুগত্যের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে, তখন সময়ের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলোতে হাত দেওয়া ভীতিকর। এভাবেই বদলে যাচ্ছে রাজনীতির ব্যাকরণ। আগে জনগণ সরকার বদলাত, এখন দীর্ঘস্থায়ী সরকার জনগণকেই বদলে দেয়, সেটা ভারতেই হোক বা বাংলাদেশেই হোক। বাংলাদেশ ছিল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দেশ, ভারত ছিল নির্বাচনী গণতন্ত্রের দেশ। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত এখন অনুগত থেকে লাভবান হতে চায়, আর ভারতের মধ্যবিত্ত হয়েছে সম্প্রদায়মুখী। মধ্যবিত্তের এমন কায়দা করে বেঁচে থাকার কৌশল টিকিয়ে রাখছে কর্তৃত্ববাদ, লুটপাট ও ঘৃণার রাজনীতি।
যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নিজেদের সচেতন নাগরিক মনে করতেন, তাঁদের অনেকেই ‘মজা লইতে লইতে’ অচেতন হয়ে পড়ছেন। এভাবে তাঁরা দিনে দিনে সমাজের স্বাভাবিক নেতার আসন হারিয়ে ফেলছেন। উটপাখি ঝড় এলে বালুতে মুখ গোঁজে, আগেকার মধ্যবিত্ত মুখ গুঁজত টেলিভিশনে, এখন আগুনে বসে হাসে পুষ্পের হাসি। কোথায় আর, বোকা শিয়ালের আনন্দের দেয়াল ফেসবুক! ওদিকে জীবন নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা চলতেই থাকে।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও কবি, প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক
faruk.wasif@prothomalo.com