স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে

১৯৭১ সালের আগুনঝরা দিনগুলোতে যে চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মানুষ এককাট্টা হয়েছিল আর তরুণেরা সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ওটাই ছিল স্বাধীনতার চেতনা
১৯৭১ সালের আগুনঝরা দিনগুলোতে যে চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মানুষ এককাট্টা হয়েছিল আর তরুণেরা সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ওটাই ছিল স্বাধীনতার চেতনা

‘স্বাধীনতা’ বস্তুটি আসলে কী? এ নিয়ে যুগ যুগ ধরে আছে মানুষের আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, লড়াই আর আত্মত্যাগ। আছে অনেক তত্ত্ব, প্রয়োগ ও উপলব্ধি। প্রশ্ন হলো, এটি কি শুধুই একটি ভূখণ্ডের সার্বভৌম সত্তা, নৃপতির ইচ্ছেমতো শাসন করার ক্ষমতা, নাকি জীবনচর্চার অনুষঙ্গ? কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের সাহিত্যের শিক্ষক ও পরে প্রশাসনের ডেপুটি কালেক্টর রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮২৭-৮৭) পদ্মিনী উপাখ্যান কাহিনি-কাব্যের কয়েকটি পঙ্‌ক্তি তুলে ধরছি:

স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,

কে বাঁচিতে চায়?

দাসত্বশৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,

কে পরিবে পায়।

কোটিকল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে,

নরকের প্রায়।

দিনেকের স্বাধীনতা স্বর্গ-সুখ তায় হে,

স্বর্গ-সুখ তায়।

সার্থক জীবন আর বাহু-বল তার হে,

বাহু-বল তার।

আত্মনাশে যেই করে দেশের উদ্ধার হে,

দেশের উদ্ধার।

অতএব রণভূমে চল ত্বরা যাই হে,

চল ত্বরা যাই।

দেশহিতে মরে যেই তুল্য তার নাই হে,

তুল্য তার নাই।

এই কবিতার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে পরাধীনতার গ্লানি, স্বাধীনতার জন্য লড়াই এবং আত্মত্যাগের মহিমা। এসব হুবহু মিলে যায় ১৯৭১ সালে আমাদের অনুভূতির সঙ্গে। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আসলে একধরনের অনুভূতি। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং তা অনেক ত্যাগের বিনিময়ে। আমরা আগেও স্বাধীন ছিলাম। তারপর একে একে তুর্কি, মোগল, পাঠান, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্রের অধীনে থাকতে হয়েছে। দীর্ঘদিন আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছে দিল্লি, লন্ডন আর করাচি-ইসলামাবাদ থেকে। এখন আমরা স্বাধীন। তবে স্বাধীনতার আকার ও প্রকার নিয়ে তর্কবিতর্ক আছে।

২৬ মার্চ আমাদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা দিবস। আমরা প্রতীকী অর্থেই দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্‌যাপন করি। আমরা যদি সর্বশেষ স্বাধীনতার পর্বটি নিয়ে কথা বলি, তাহলে বলতে হয়, দেশটি হুট করে স্বাধীন হয়নি। এর একটি বিস্তৃত পটভূমি আছে। তবে চূড়ান্ত সময়টি উপস্থিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে।

পয়লা মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের নামে প্রচারিত একটি ভাষণ প্রেক্ষাপট আমূল পাল্টে দেয়। জনতা রাজপথে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এটা ছিল জনরোষ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি ছিল ইঙ্গিতবহ। যাঁর যা বোঝার তা তাঁরা বুঝে নিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র জনতার ওপর সামরিক জান্তার নৃশংস হামলার ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে শেষ সুতাটিও ছিঁড়ে যায়। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হন। আওয়ামী লীগের অন্যান্য শীর্ষ নেতা ভারতে সংগঠিত হয়ে একটি সরকার গঠন করেন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা গ্রামে ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। পাঠ করা হয় আগেই তৈরি করা স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্র।

৯ মাস যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের একটি পর্বের সমাপ্তি ঘটে। ১৬ ডিসেম্বরকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে কেউ কেউ বিবেচনা করেছিলেন। পরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য ২৬ মার্চকেই চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। আজ তার ৫১তম বার্ষিকী। আমরা কতটুকু এগোলাম?

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের যৌক্তিকতা, ন্যায্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা পেতে ঘোষণাপত্রের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়: ‘...উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।...’ পরবর্তী এক পরিচ্ছেদে বলা হয়, ‘...পূর্বাহ্ণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি...।’ এই কথাগুলো ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা জরুরি ছিল। কেননা ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে বিপুল ম্যান্ডেট পেয়েছিল, তার প্রধান নেতা হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারে তাঁর নামটি আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ করা অপরিহার্য ছিল। পরে এই ঘোষণার সত্যতা ও যথার্থতা নিয়ে অনেক বিতর্ক-কুতর্ক হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে শেখ মুজিব কী বলেছেন, তা জানা দরকার। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় দেওয়া উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘...স্বাধীনতার ইতিহাস কোনো দিন মিথ্যা করতে নাই। আমার সহকর্মীরা যারা এখানে ছিল তারা সবাই জানত যে ২৫ তারিখ রাতে কী ঘটবে। তাদের বলেছিলাম, আমি মরি আর বাঁচি সংগ্রাম চালিয়ে যেয়ো। বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। ৭ মার্চ কি স্বাধীনতাসংগ্রামের কথা বলা বাকি ছিল? প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চই স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেদিন পরিষ্কার বলা হয়েছিল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

৯ মাস যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের একটি পর্বের সমাপ্তি ঘটে। ১৬ ডিসেম্বরকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে কেউ কেউ বিবেচনা করেছিলেন। পরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য ২৬ মার্চকেই চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। আজ তার ৫১তম বার্ষিকী। আমরা কতটুকু এগোলাম?

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি’—এই কথাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এটা কোনো আইন নয়। এটা হলো রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। তাই কত বছর পার হলে এই অঙ্গীকার বাস্তবায়িত হবে, তা নিশ্চিত করার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। এই নিরিখেই বলা যায়, আমরা এগিয়েছি, তবে আরও এগোতে পারতাম। অথবা এ প্রশ্নও জাগে, সত্যিকার অর্থে আমরা কি স্বাধীনতা পেয়েছি? দেশ স্বাধীন হয়েছে। নাগরিকেরা কি স্বাধীন? রাষ্ট্র সার্বভৌম হলে কি জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়? এখানে আরও একটি বিষয় প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে আসে, ‘স্বাধীনতার চেতনা’ কি বাস্তবায়িত হয়েছে?

স্বাধীনতার চেতনা আসলে কী? এর ব্যাখ্যা একেকজন একেকভাবে দেন। ১৯৭১ সালের আগুনঝরা দিনগুলোতে যে চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মানুষ এককাট্টা হয়েছিল আর তরুণেরা সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ওটাই ছিল স্বাধীনতার চেতনা। তখন আমরা কেউ জানতাম না স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে কী লেখা আছে। আমরা শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলাম। ব্যস, এটুকুই। তবে ৫১ বছর পর নিশ্চয়ই চেতনার অর্থ বদলে গেছে। এখন এই চেতনা একধরনের অনুভূতি। এই অনুভূতিও একেকজনের একেক রকম।

‘অশুভের সমস্যা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমরা যখন লক্ষ করি একটি শিশু হাঁটতে চেষ্টা করছে, তখন আমরা তার অগুনতি সাফল্য দেখি; তার সাফল্য কিন্তু অল্পই থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের পর্যবেক্ষণকে যদি সীমিত করতে হতো, তাহলে দৃশ্যটি নির্মম হতো। কিন্তু আমরা দেখি বারবার অসাফল্য সত্ত্বেও শিশুটির ভেতরে এক খুশির প্রেরণা আছে, আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব কাজ করে যেতে এই প্রেরণা তাকে ধরে রাখে। আমরা দেখি সে তার পড়ে যাওয়া সম্বন্ধে তত ভাবে না, যতটা ভাবে তার এক মুহূর্তের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষমতা সম্বন্ধে।’

প্রশ্ন হলো, আমরা দৌড়াতে শিখব কবে?

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

mohi2005@gmail.com