মতামত

স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়?

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কবিতাটি মনে এল। কবিতার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘দাসত্ব শৃঙ্খল বলো কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়?’ কবি রঙ্গলাল তাঁর কবিতায় মানব জীবনের একটি গভীর আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করেন। সম্ভবত স্বাধীনতার এ আকাঙ্ক্ষা মানুষের সহজাত। প্রভাবশালী দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট তাঁর বিখ্যাত থিওরি অব হিউম্যান নেইচার-এ বলেন, কর্ম সম্পাদনের জন্য দরকার বাইরের সবকিছু থেকে মুক্ত হওয়া।

একটা দেশের জনগণ যখন অন্য দেশ দ্বারা শাসিত হয় অর্থাৎ তাঁদের ভৌগোলিক স্বাধীনতা যখন খর্ব হয়, তখন সেই দেশ তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আক্রমণ করে, দাবিয়ে রাখে। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদে ভৌগোলিক স্বাধীনতা হরণ করার জন্য ভাষা ও সংস্কৃতিকে দাবিয়ে রাখার দরকার হয়। বাংলাদেশ যখন তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনে ছিল, তখন তারা একই কাজ করেছিল। ২২ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম ও ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

স্বাধীনতা তথা ইনডিপেনডেনস আর মুক্তি তথা ফ্রিডম বা লিবার্টি—এ দুইয়ের বিস্তর ব্যবধান মাথায় রেখে আজকে আমাদের সামনে প্রশ্ন: স্বাধীন বাংলাদেশেও আমরা কি মুক্ত হয়েছি আদৌ?

দাসপ্রথা থেকে মুক্ত হতে মানুষকে হাজার হাজার বছর ব্যয় করতে হয়েছে। কোনো বাইরের দেশ নয় বরং স্বদেশের মধ্যেই এক শ্রেণি আরেক শ্রেণিকে দাস করে রেখেছিল। আমেরিকান গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণে তিনি নিছক স্বাধীনতা নয় বরং মানুষের মুক্তির কথা বলেন। ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবও প্রায় একই সুরে বলেন, ‘আমরা এ দেশের মানুষের মুক্তি চাই।’

আব্রাহাম লিংকন তাঁর বক্তৃতায় বলেন, গৃহযুদ্ধে নিহত ব্যক্তিরা জীবন দিয়েছেন দাসত্ব থেকে মুক্তির এক নবজন্মের আকাঙ্ক্ষায়। তিনি তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন গণতন্ত্রের সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ সংজ্ঞাটি দিয়ে: জনগণ দ্বারা গঠিত, জনগণ দ্বারা শাসিত ও জনগণের জন্য নিয়োজিত সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন এভাবে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। উল্লেখ্য, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া নিছকই ভৌগোলিক স্বাধীনতার প্রশ্ন কিন্তু মানুষের মুক্তির কথাটা বলতেও তিনি ভোলেননি। ‘আমরা এ দেশের মানুষের মুক্তি চাই’ বঙ্গবন্ধু যখন এ কথা বলেন, তিনি আসলে এ দেশের শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির কথাই বলেন। কারণ, বঙ্গবন্ধুর ভাবনা জুড়ে ছিল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ তথা কৃষক ও শ্রমিক। তাঁর অসংখ্য বক্তৃতায় এর সাক্ষ্য মেলে।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটি ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘আব্রাহাম লিংকনের গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় মানুষের সার্বিক স্বাধিকারের কথাই বলা হয়েছে, যার মধ্যে আছে ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার, সম্পদের অধিকার—সব। সরকার যদি প্রকৃত অর্থেই জনগণের হয়, তাহলে সে আবশ্যিকভাবেই জনগণের স্বার্থের জন্য কাজ করবে।’ কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু নির্বাচনী ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে, নির্বাচনে জেতার জন্য জনগণের ভোটের ওপর নির্ভর করতে হয় না তাই জনগণের স্বার্থ রক্ষার দিকেও নজর দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এখন মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত এবং বৈষম্যের মাত্রাও পর্বতপ্রমাণ।

রেনেসাঁ, ফরাসি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লব, রুশ বিপ্লব ইত্যাদি ঘটনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ, মানুষের মুক্তি, মানুষের জন্য সবকিছু। রুশ বিপ্লব থেকে অন্য ঘটনাগুলোর আপাত পার্থক্য থাকলেও মানুষের মুক্তি বিষয়ে তা ছিল এক। সামন্তবাদ ও রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আসলে মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করাই ছিল ফরাসি বিপ্লবের লক্ষ্য। এখানে অন্য কোনো দেশ ফরাসি দেশের জনগণকে শাসন করেনি, করেছে এক শ্রেণিকে অন্য শ্রেণি। আমাদের দেশে যেসব কমিউনিস্ট অখণ্ড পাকিস্তান চেয়েছিলেন, তাঁদের যুক্তি ছিল, সর্বহারা শ্রেণির হাতে ক্ষমতা এলেই মানুষের মুক্তি মিলবে। দেশ ভাঙার কোনো দরকার নেই।

কমিউনিস্টরা শ্রেণির মুক্তিতে বিশ্বাস করেন। সর্বহারা শ্রেণির হাতে ক্ষমতা এলে দেশের অভ্যন্তরে এক জাতির ওপর অন্য জাতির শোষণের ঘটনা ঘটবে না বলেই তাঁরা ভাবতেন। শেখ মুজিবের চিন্তা ছিল ভিন্ন। তিনি খুব দ্রুত উপলব্ধি করলেন, শ্রেণির মুক্তি সুদূরপ্রসারী। বাঙালি যদি শ্রেণির মুক্তির জন্য অপেক্ষা করে, তাহলে তত দিনে এ জাতি শেষ হয়ে যাবে। কমিউনিস্টরা যদি জাতির মুক্তির কথা ভাবতেন, তাহলে তাঁদের নেতৃত্বেই স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হতে পারত।

স্বাধীন বাংলাদেশে শুরুতেই একটি সাম্যবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারত এবং শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি ত্বরান্বিত হতে পারত। কিন্তু আজ আমরা যা দেখি তা হলো ‘একই চেয়ারে স্বদেশি মনিব শূন্যে তোলে নতুন চাবুক!’

রুশ বিপ্লব এক ধাপ এগিয়ে, সামন্তবাদ ও রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সরাসরি শ্রমিকের শাসন প্রতিষ্ঠিত করে শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি নিশ্চিত করেছে। কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা মধ্যবিত্ত শ্রেণির হলেও শ্রেণিচ্যুত হয়ে তাঁরা চিন্তা-চেতনায় ও জীবনাচরণে শ্রমিকই ছিলেন। অনেকে শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা দখলকে ইউটোপীয় ধারণা বলে এমন উদ্যোগকে প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু তাঁরা ভেবে দেখেন না যে রুশ বিপ্লব পৃথিবীকে কী উপহার দিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিস্ময়কর অগ্রগতি এবং একটি পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান ছাড়াও উন্নয়নের মৌলিক দুটি উপাদান সাক্ষরতা ও নারীর ক্ষমতায়নে দেশটি যা করেছে, তা অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো।

১৯১৭-এ বলশেভিক সরকার গঠনের পর ১৯৩৯ সাল নাগাদ শহর ও গ্রামে শিক্ষার হার যথাক্রমে ৯৪ ও ৮৬-তে উন্নীত হয়, যা ১৯৫৯ সাল নাগাদ হয় ৯৯ ও ৯৮ যেখানে ১৮৯৭ সালের রাশিয়ার সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী নামমাত্র সাক্ষরতার হার ছিল ২১ শতাংশের নিচে। একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষে সমতা আনতেও পুরোপুরি সক্ষম হয়। ইতিহাসবিদ বেন একলফ মন্তব্য করেন, ‘ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির যা করতে লেগেছে কমপক্ষে ১০০ বছর, সোভিয়েত ইউনিয়ন তা করেছে মাত্র ২২ বছরে।’

নারীর মুক্তি ও শ্রমিকের মুক্তি ছাড়া কোনো সমাজের মানুষের সার্বিক মুক্তি হয় না। নারীর মুক্তি ও শ্রমিকের মুক্তি ছাড়া একটি রাষ্ট্রে সমতাও নিশ্চিত করা যায় না। আর সমতা ছাড়া মানুষের সুখ সর্বাধিক করা যায় না। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে জীবনমানের বিস্তর ব্যবধানই বাঙালিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু নিজ দেশেই আজ নারী, শ্রমিক ও সংখ্যালঘুর অবদমন অব্যাহতভাবে বেড়ে চলছে। যার কারণে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই আজ প্রশ্ন তোলেন, দেশ স্বাধীন করে কী লাভ হলো?

স্বাধীনতার মূল চেতনা হলো মানুষের মুক্তি আর মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করা মানেই পৃথিবীকে আরও একটু সুন্দর রেখে যাওয়ার বাসনা।

ফরাসি বিপ্লবের নায়ক, ভলতেয়ারের প্রভাবে যখন ফরাসি দেশের মানুষ ব্যাপকভাবে জেগে উঠেছে, রাজতন্ত্রের আগল ভাঙার শব্দ যখন শুরু হয়ে গেছে আকাশে-বাতাসে, রাজার সরকার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করল ভলতেয়ারের নামে। তখন তিনি আড়ালে থেকে তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য চলে গেলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে শহর থেকে দূরে সীমান্তের কাছে এক গ্রামে। আত্মগোপনে থাকতে শুরু করলেন ভলতেয়ার। বিপ্লবীও যে আসলে একঅর্থে একজন শিল্পী এবং তিনিও যে অনুভব করেন সৃষ্টির তাড়না, প্রতিমুহূর্তে কিছু একটা করার প্রেষণা যে তাঁকেও তাড়িয়ে ফেরে! অতএব ভলতেয়ারকেও কিছু একটা করতেই হবে! তিনি সেই গ্রামের একখণ্ড জমি নিয়ে, সেখানে ফুলের চাষ শুরু করলেন। একসময় অনেক ফুল ফুটল সেখানে এবং কিছু করতে না পারার বিষণ্নতা দূর হল ভলতেয়ারের মন থেকে। এই ফুলের চাষ, এই ফুল ফোটানো আসলে একটা প্রতীকী ঘটনা। এটা হলো পৃথিবীকে আরও একটু সুন্দর করার একজন শিল্পীর, একজন বিপ্লবীর আকাঙ্ক্ষা রূপায়ণের প্রয়াস।

ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com