স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘নিখোঁজ’ গণতন্ত্র

আর কদিন পরেই ২৬ মার্চ, আমরা উদ্‌যাপন করব স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। গত ৫০ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে, যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। এত ছোট্ট একটি দেশ, ১৭ কোটি মানুষ—তারপরও আমাদের কৃষকেরা তাঁদের খাদ্যের জোগান দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের ক্রিকেটাররা বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। আমাদের এক কোটি প্রবাসী শ্রমিক তাঁদের কষ্টার্জিত উপার্জনে দেশের অর্থনীতিকে চাঙা রেখেছেন। এই করোনাকালেও তাঁরা রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হচ্ছে। ভারতের চেয়ে আমাদের গড় আয়ু বেশি। গড় আয়ও তাদের কাছাকাছি। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও মানব উন্নয়নের সূচক বহির্বিশ্বে প্রশংসিত। সম্প্রতি জাতিসংঘের উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত কমিটি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে বিশ্বব্যাংক নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসবই আনন্দের খবর। গৌরবের খবর।

এর পাশাপাশি যখন আমরা পদে পদে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হতে দেখি, যখন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়, বিরোধী দলের ও মতের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে সরকার নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেয়, যখন নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়, তখন আমরা যারপরনাই হতাশ ও ব্যথিত হই।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২১ ডেমোক্রেসি আন্ডার সিজ’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার কোনো উন্নতি হয়নি। ২০২০ সালে এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতা যেমন ছিল, ২০২১ সালে এসেও সেই অবস্থায় আছে। ১০০ পয়েন্টের মধ্যে চলতি বছর বাংলাদেশের স্কোর ৩৯। আগের বছরও ছিল ৩৯। অথচ একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখি, ২০১৯ সালে স্কোর ছিল দুই ধাপ ওপরে, ৪১। ২০১৮ ও ২০১৭ সালে ছিল যথাক্রমে ৪৫ ও ৪৭। এর অর্থ, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার সূচক কমেছে ৮ পয়েন্ট।

ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে চলতি বছর ১৯৫টি দেশ ও ১৫টি অঞ্চলের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার, এ দুই বিষয় বিবেচনায় নিয়ে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার স্কোর বা মান নির্ণয় করা হয়। সারা বিশ্বের দেশ ও অঞ্চলগুলোকে তারা তিন ভাগে ভাগ করেছে—মুক্ত, আংশিক মুক্ত, মুক্ত নয়। এর মধ্যে মুক্ত বিভাগে ৮২টি দেশ ও একটি অঞ্চল আছে, যেখানে বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশ আছে আংশিক মুক্ত ৫৯টি দেশের কাতারে। এর বাইরে ৫৪টি দেশ ও ১০টি অঞ্চল ‘মুক্ত নয়’। পুরো কর্তৃত্ববাদী।

ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া দেশগুলোর যে তালিকা তৈরি করেছে, তার ৭ নম্বরে আছে বাংলাদেশ। এর আগে আছে মালি, তুরস্ক, তানজানিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, ভেনেজুয়েলা ও নিকারাগুয়া। অনেকে যুক্তি দেখাতে পারেন, সারা বিশ্বেই যখন গণতন্ত্রের অবনমন ঘটছে, বাংলাদেশে ঘটতে দোষ কী। বিশ্বের অন্য যেসব দেশে গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে, সেসব দেশে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য মানুষ এত প্রাণ দেয়নি। পাকিস্তানি শাসকদের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি; নব্বইয়ে যে স্বৈরাচারী শাসককে হটিয়েছি, তা–ও গণতন্ত্রের জন্য। স্বৈরাচার পতনের তিন দশক পর সেই গণতন্ত্রের অবস্থা কী?

ফ্রিডম হাউসের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়, বিরোধী দল, তাদের জোটের শরিক, সমালোচক মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বরকে ধারাবাহিকভাবে হয়রানির মাধ্যমে রাজনৈতিক শক্তি সুসংহত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে একাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে এবং দায়মুক্তির নজিরও আছে।

এ দায়মুক্তি বিএনপির আমলে ছিল। ছিল তার আগে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, তঁাদের আমলেও। এখন আওয়ামী লীগ বিরোধীদের ওপর একই অস্ত্র ব্যবহার করছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা ‘নিখোঁজ’ গণতন্ত্রকে খুঁজছি। গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতার সূচকে আমাদের অবস্থান এতটাই নাজুক যে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকেও পিছিয়ে আছি। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ৬৭, ভুটান ৬১, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল ৫৬ ও মালদ্বীপ ৪০ স্কোর পেয়ে আংশিক মুক্ত তালিকায় আছে। অন্যদিকে আফগানিস্তান ২৭ নম্বর পেয়ে ‘মুক্ত নয়’ দেশের তালিকায়। এর আগে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) তালিকায়ও দেখা গেছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে আমাদের অবস্থান সবার নিচে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল হয়েছে (যদিও সরকারি হিসাবেই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা লোকের সংখ্যা এক–পঞ্চমাংশ) আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা জোরগলায় প্রচার করেন। কিন্তু তাঁরা একবারও বলেন না গণতন্ত্রের উন্নয়নে বাংলাদেশ রোল মডেল হয়েছে। তাঁরা এ কথাও বলেন না যে নাগরিকের অধিকার রক্ষায় কিংবা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে তাঁরা নজির স্থাপন করেছেন।

জেলখানা থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর তাঁর গ্রেপ্তারের যে কাহিনি বর্ণনা করেছেন, তা পড়লে গা শিউরে ওঠে (প্রথম আলো, ৫ মার্চ ২০২১)। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা নামের বিতর্কিত আইনে। একই মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন লেখক মুশতাক আহমেদ। কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। কার্টুনিস্ট কিশোর ১০ মাস পর কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন শরীরে ক্ষত ও যন্ত্রণা নিয়ে।

একাত্তরে বঙ্গবন্ধু আমাদের শৃঙ্খলমুক্তির ডাক দিয়েছিলেন এবং সেই ডাকে ৩০ লাখ মানুষ আত্মাহুতি দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। দেশ শৃঙ্খলমুক্ত হলেও মানুষ শৃঙ্খলমুক্ত হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী মানুষের বাক্‌স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়নি। যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের কিছু মানুষের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, শিক্ষাঙ্গন—সব তাদের দখলে থাকে। সেই দলের স্থলে আরেক দল বা দলের মানুষ ক্ষমতায় এলে তাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। কিন্তু সব মানুষের বা সাধারণ মানুষের স্বাধীনতার জন্য আমাদের আর কত কাল অপেক্ষা করতে হবে?

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com