৬ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়, ‘প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তি কর্তৃক বাসাবাড়িসহ সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করতে হলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ছাড়াও সিটি করপোরেশন থেকে অনুমতি নিতে হবে। আর শুধু অনুমোদন দিলেই হবে না; অনুমোদনকৃত স্থাপনা নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থাও রাখতে হবে।’ এ-সম্পর্কিত চারটি বিষয়ে খতিয়ে দেখতে হবে—এক. কেন রাজউকের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের কাছ থেকেও স্থাপনা নির্মাণের অনুমোদনের বিষয়টি প্রয়োজন মনে হলো; দুই. এতে স্থাপনা নির্মাণে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ভোগান্তি বাড়বে কি না; তিন. এই সিদ্ধান্তে শহরের কী লাভ হবে এবং চার. এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রস্তুত আছে কি না।
১৯৫২ সালের টাউন ইম্প্রুভমেন্ট আইনের অনুচ্ছেদ ৭৫ অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় যেকোনো স্থাপনা নির্মাণের জন্য রাজউক থেকে নকশা ও নির্মাণ অনুমোদন নিতে হয়। দুটি কারণে এই অনুমোদন নেওয়া প্রয়োজন হয়। প্রথমত, প্রস্তাবিত স্থাপনার ভূমি ব্যবহার রাজউকের প্রণীত ঢাকার মাস্টারপ্ল্যান বা ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না; দ্বিতীয়ত, স্থাপনার নকশা ‘ইমারত নির্মাণ আইন’-এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কি না। ঢাকা শহরের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রাজউকের। কিন্তু বাস্তবে হরহামেশাই ভূমি ব্যবহারের অসংগতি এবং ইমারত নির্মাণের ব্যত্যয় দেখা যায়। জলাভূমি, নদী-খাল ভরাট এবং ভবনের নকশা অনুমোদনের পরও সেটি ব্যত্যয় করে স্থাপনা তৈরি হয়। ইমারত নির্মাণের পর বসবাস শুরুর আগে বসবাসযোগ্য সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অধিকাংশ নির্মাণকারী তা নেন না।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ অনুসারে, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মোটা দাগে মোট ২৮টি কাজ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে খাল, ড্রেন পরিষ্কার ও পানিনিষ্কাশনের কাজ যোগ হয়েছে। সিটি করপোরেশনের অনেক কাজ আছে, যা স্থাপনা অনুমোদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। কোন এলাকায় কত মানুষ বসবাস করছে, তার বিপরীতে কোথায় এবং কতটি বাজার-হাট, সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, খেলার মাঠ, পার্ক বা উন্মুক্তস্থান থাকবে—এ সবকিছুর জন্য সিটি করপোরেশন সরাসরি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। অপরিষ্কার ড্রেন, খালের বেদখল, রাস্তার ওপর কাঁচাবাজার, ফুটপাত দখল, রাস্তার পাশে ময়লার স্তূপ, মাঠ ও পার্ক না থাকা—এসব বিষয়ে নাগরিক হিসেবে আমরা সারাক্ষণ অভিযোগ করি। এ কথাও সত্যি, এসব ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের অনেক ব্যর্থতাও আছে। কিন্তু নাগরিক সেবার এসব পরিসর কেন অক্ষুণ্ন রাখা গেল না, সে প্রশ্নও করতে হবে।
সিটি করপোরেশন ভূমি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ কিংবা স্থাপনা অনুমোদনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট নয়। আবার এ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান রাজউক এ ধরনের সেবামূলক কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। রাজউকের পরিকল্পিত আবাসিক এলাকায় এখনো কিছু পার্ক, খেলার মাঠ টিকে থাকলেও অনেক সরকারি-বেসরকারি আবাসিক এলাকায় খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, পার্কের জায়গা, বাজারের জায়গা প্লট করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দিন শেষে আমরা মেয়রের কাছে জানতে চাই, ‘আমার এলাকায় গণপরিসর ও নাগরিক সেবার স্থান কোথায়?’ যে প্রতিষ্ঠান এতগুলো নাগরিকসেবা প্রদানের জন্য নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধ, সেই শহরে স্থাপনা নির্মাণে সেই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন অথবা মতামত অবশ্যই নিতে হবে। এটা রাজউকের জন্যও ভালো হবে। তারা জলাভূমি, পার্ক, খেলার মাঠ, খালের মতো গুরুত্বপূর্ণ এজমালি সম্পত্তি রক্ষায় জনপ্রতিনিধিকে পাশে পাবে। পাশাপাশি তঁাদেরও দায়বদ্ধ করা যাবে।
রাজধানীতে ৯০ শতাংশের বেশি ইমারতেই নকশা অনুমোদনের পরেও নির্মাণের সময় কোনো না কোনো ব্যত্যয় করা হয়। নকশাবহির্ভূত নির্মাণ বন্ধে দুই সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়কে যুক্ত করা উচিত। রাজউক ভোগান্তি ও দীর্ঘসূত্রতা কমাতে নকশা অনুমোদনের বিষয়টি পুরোপুরি অনলাইনে করার পদক্ষেপ নিয়েছে। দ্রুত এ প্রক্রিয়া সহজ ও ব্যবহারকারীবান্ধব করা উচিত।
পৃথকভাবে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা করে অনুমোদন নিতে গেলে দীর্ঘসূত্রতা ও জনভোগান্তির সৃষ্টি হতে পারে। তাই রাজউকের ‘ইমারত নির্মাণ কমিটি’তে সিটি করপোরেশনের মতামত দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এ জন্য সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি হিসেবে একজন নগর–পরিকল্পনাবিদকে সেখানে যুক্ত করতে হবে। এখানে বলে রাখা ভালো, রাজউকের ‘বৃহদায়তন প্রকল্প ছাড়পত্র’-এর কমিটিতেও সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি থাকতে হবে।
রাজধানীতে ৯০ শতাংশের বেশি ইমারতেই নকশা অনুমোদনের পরেও নির্মাণের সময় কোনো না কোনো ব্যত্যয় করা হয়। নকশাবহির্ভূত নির্মাণ বন্ধে দুই সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়কে যুক্ত করা উচিত। রাজউক ভোগান্তি ও দীর্ঘসূত্রতা কমাতে নকশা অনুমোদনের বিষয়টি পুরোপুরি অনলাইনে করার পদক্ষেপ নিয়েছে। দ্রুত এ প্রক্রিয়া সহজ ও ব্যবহারকারীবান্ধব করা উচিত। সিটি করপোরেশনও যেন এই প্রক্রিয়ায় হয়রানি না করে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে মতামত দেয়।
স্থাপনা অনুমোদন প্রক্রিয়ায় মতামত দেওয়ার মতো উপযুক্ত নগর–পরিকল্পনাবিদ উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নেই। দুই সিটি করপোরেশনে যে অল্প কয়েকজন নগর–পরিকল্পনাবিদ আছেন, তাঁরা তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ সামাল দিতে হিমশিম খান। দুই সিটি করপোরেশনের এখন মোট ২০টি জোনের প্রতিটিতে একজন করে নগর–পরিকল্পনাবিদ নিয়োগ দিতে হবে, যাঁদের ঢাকার ভূমি ব্যবহারসংক্রান্ত মাস্টারপ্ল্যান, ড্রেনেজ পরিকল্পনা ও পরিবহন পরিকল্পনা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আছে।
● আকতার মাহমুদ নগর-পরিকল্পনাবিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল–পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাবেক সভাপতি