যেকোনো অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কী উৎপাদন করা হবে, কতটুকু উৎপাদন করা হবে এবং উৎপাদিত সামগ্রী কাদের মাঝে কীভাবে বণ্টন করা হবে, তা নির্ভর করে ওই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল্যবোধের সমষ্টির ওপর। সব ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধির সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিতকরণকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। অর্থনীতিতে উৎপাদিত সামগ্রীসমূহকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। যথা পণ্য ও সেবা। ভোক্তা তার চাহিদা অনুযায়ী পণ্য এবং সেবা আনুপাতিক হারে ভোগ করে থাকে।
শিক্ষা একটি পণ্য কি না, তা নিয়ে ঢের বিতর্ক আছে। তবে এ–ও ঠিক, শিক্ষাকে পণ্য বা সেবা যেভাবেই দেখি না কেন, শিক্ষা বাস্তবায়নে উৎপাদনের ক্রমপর্যায় দৃশ্যমান। শিক্ষার জন্য পুঁজি এবং শ্রম দুটিই দরকারি। শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। উচ্চশিক্ষা মৌলিক অধিকার কি না, তা নিয়ে বিদগ্ধ মহলে বিতর্ক থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষা যে স্থান–কাল–পাত্রনির্বিশেষে মানুষের মৌলিক অধিকার, তা নিয়ে কারোরই সন্দেহ ও বিতর্ক নেই।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তথা পুঁজি এবং শ্রম কে সরবরাহ করবে? রাষ্ট্রযন্ত্র না ব্যক্তি খাত? না উভয়ই? প্রশ্নটি মৌলিক, তাই কারও পক্ষেই সহজে এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়। বিষয়টির সম্যক আলোচনা কয়েকভাবে হতে পারে। প্রথমত, উচ্চশিক্ষার কথায় আসা যাক। উচ্চশিক্ষা একটি ব্যাপক ধারণা। সাধারণ জ্ঞান ও দর্শনের জন্য যেখানে আমরা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ভাবি, অনুরূপ চিকিৎসাবিজ্ঞান অথবা প্রকৌশলবিজ্ঞানে উচ্চতর জ্ঞানার্জনের জন্য আমরা চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি। জ্ঞান চর্চার অন্যান্য ক্ষেত্রেও অধিকতর জ্ঞানার্জনের নিমিত্তে নিজ নিজ ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা আমরা ভাবি এবং বাস্তবায়ন করে থাকি। উচ্চ শিক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক এবং ব্যক্তি উভয় খাতেই হতে পারে।
পুঁজিবাদের ধ্বজাধারী উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান প্রভৃতি দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও পাবলিক এবং ব্যক্তি উভয় খাতে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় দেখা যায়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যের বহুমু্র্রখিতা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। উন্নত রাষ্ট্রসমূহে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ মূলত গবেষণা ও জ্ঞান সৃষ্টির আধার। ওই সব দেশে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে দেশ-বিদেশের প্রথিতযশা শিক্ষক এবং গবেষকেরা নিয়োজিত থাকেন। শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্প পরিসরে ডিগ্রি কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। সে কারণেই ছাত্রছাত্রী কলেবরে তুলনামূলক ছোট হলেও সেসব বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান–বিজ্ঞান ও গবেষণার কলেবরে ঢের বড়। বাংলাদেশসহ বহু সাবেক উপনিবেশিত ও অনুন্নত দেশসমূহে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ভিন্ন উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়। এসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর মাপা হয় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যার নিরিখে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হন ডিগ্রি অর্জনের উদ্দেশ্যে, সীমিত পরিসরে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা যে হয়–ই না, তা অবশ্য বলা যাবে না।
দ্বিতীয়ত, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার কথা চিন্তা করলে বিশেষত বাংলাদেশে প্রচুর বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় লক্ষণীয়। অতীতে কলোনির শাসনকালের শেষের দিকে এতদ্বঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের ঢেউ লাগে। তৎকালে দেশীয় জমিদার ও বিদ্যোৎসাহী মহলের উদ্যোগে অনেক মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়–মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। লক্ষণীয়, তৎকালে যাঁরা স্কুল প্রতিষ্ঠা করতেন, পরবর্তীকালে স্কুল পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় এবং অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট সম্পদ যেমন নগদ সঞ্চিতি, জমি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দান করে যান। এসব কারণে ওই সময়কালে প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রতিষ্ঠানই এখনো যথেষ্ট সচ্ছল। তুলনামূলক নতুন স্কুল–কলেজগুলো সরকারি অনুদাননির্ভর হলেও অনুদানের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে, সে রকম দৈন্যদশায় হয়তো নয়।
তৃতীয়ত, দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার কথায় আসা যাক। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম বিবেচনায় স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ সরকারি করা হয়। মূলধারার অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ই সরকারি। সময়ের আবর্তে কিছুটা অবিবেচনা এবং কর্মহীনতার চাপে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে প্রচুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তীকালে সরকার কিছু এককালীন অনুদানের মাধ্যমে স্থাপনা সৃষ্টি করে দেয়। অনেক বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কথিত মাসিক পেঅর্ডার পরিকল্পনার আওতায় বেতন–ভাতা পেয়ে সেবাদান করছেন। এ দেশে সরকারি হোক বা বেসরকারি, প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ঢের বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। এসব বিদ্যালয়ের অবস্থান, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষকসংখ্যা এবং শিক্ষকদের জ্ঞান, মান প্রভূত ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্য আছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে এসব বিদ্যালয়ে আসা ছাত্রছাত্রীদের মাঝেও নানামুখী বৈষম্য দেখা যায়।
চতুর্থত, দেশের বড় বড় শহর ও মফস্বলকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা মূলধারা এবং কিছু ভিন্ন মাধ্যমের নার্সারি ও প্রাথমিক স্কুলসমূহ। এসব প্রাথমিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে কিছু মাধ্যমিক স্কুলের সেবা ও পাঠদানপদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন। মূল পাঠ্যসূচির বাইরে অতিরিক্ত পাঠ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানসূচি ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে সারা বছরই ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবক মহলকে ব্যস্ত রাখে। এগুলোর জন্য অবশ্য অভিভাবক মহলকে যথেষ্ট মাশুলও গুনতে হয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছুটা চাকচিক্যর জন্যও এসব স্কুলে অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের পাঠান।
এই ধাপের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠানসমূহ অধিকাংশই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত। প্রয়োজনীয়তার নিরিখে দরকারি হলেও ঠিক কী পরিমাণ দরকার ছিল, তার সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর। দেখা যায়, একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশপাশেই একাধিক ওই ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের অনাড়াম্বর চেহারার বিপরীতে আড়ম্বরপূর্ণ এসব স্কুল আজ টিকে থাকতেই দায়। আর তাই সম্প্রতি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে স্কুল বিক্রির বিজ্ঞাপন অনেকের বিবেকে নাড়া দিয়ে গেছে। প্রকাশিত খবরে দেখা যায় বিশেষত ব্যক্তি–উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কিছু নার্সারি থেকে শুরু করে মাধ্যমিক স্কুলের মালিকপক্ষ তাদের স্কুল স্থাপনা, আসবাব, এমনকি ছাত্রছাত্রীসহ বিক্রয়ের নিমিত্তে বিভিন্ন স্থানে পোস্টার সংবলিত বিজ্ঞাপন সাঁটাচ্ছে। ঘটনাটি করোনা মহামারিকালে ঘটলেও অন্য যেকোনো সময়েও এরূপ ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
কেন এমনটি হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মাঝে খুঁজে দেখতে পারি। প্রাথমিক শিক্ষার মতো অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়ে ব্যক্তি–উদ্যোগ প্রযোজ্য কি না, ভেবে দেখা যেত। বিশেষত বাংলাদেশের মতো আর্থসামাজিক বাস্তবতায় যারা এই সব স্কুলের অনুমোদন চাইতে আসে, তাদের ঝুঁকি বহনের ক্ষমতা ও মাত্রা ইতিপূর্বেই নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল। আজ ছাত্রছাত্রীসমেত বিদ্যালয় বিক্রি হবে, এ ধরনের বিজ্ঞাপন বাজার–ব্যর্থতার চরম বহিঃপ্রকাশ বলেই ধরে নেওয়া যায়।
ড. শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।