এই বছরের স্কুল পাঠ্যবইয়ে বাক্য বিকৃতি, বানান ভুল, লেখা পরিবর্তন, পরিমার্জনা ইত্যাদি নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় রিপোর্টাররা বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিয়ে সংবাদপত্রে এই ভুল ও বিকৃতির বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারদের অভিনন্দন জানাই। তাঁরা এই কষ্টসাধ্য প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ না করলে দেশের মানুষ জানতেই পারতেন না জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর মাধ্যমে কী ধরনের ভুলে ভরা পাঠ্যবই প্রকাশিত হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, স্কুল পাঠ্যবইতে ভুলের ছড়াছড়ি কোনো নতুন বিষয় নয়। বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে স্কুল পাঠ্যবইয়ের ভুল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কোনো জোরালো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে ২০১৭ সালের স্কুল পাঠ্যবইতে ভুল ও বাক্য বিকৃতি প্রকটভাবে ধরা পড়েছে।
এবারের ভুল বা বাক্য বিকৃতি তুলনামূলকভাবে ছোট অপরাধ। বড় অপরাধ হচ্ছে হেফাজতে ইসলামের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে কিছু ভালো লেখা বাদ দিয়ে হেফাজতের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন লেখার অন্তর্ভুক্তি। বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর প্রতিবাদ করেনি। এতে মনে হয় অভিযোগের সত্যতা আছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ রকম কাণ্ড হতে পারে, এটা বিস্ময়কর। এটা বিএনপি সরকারের আমলে ঘটলে দেশে তুলকালাম হয়ে যেত। এখন সমালোচনা শুধু সংবাদপত্রের পাতাতেই সীমাবদ্ধ। ছাত্রলীগ, সাংস্কৃতিক জোট বা এ ধরনের সংগঠনগুলো বিবৃতি দিয়ে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে।
পাঠ্যবইয়ে বানান ভুল বা বাক্য বিকৃতি অনুসন্ধানের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। হেফাজতের সুপারিশের বিষয়টা খতিয়ে দেখার জন্যও একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার। এ বিষয়টা রাজনৈতিক, এটা রাজনৈতিকভাবেই বিবেচনা করতে হবে। সরকারের কোন পর্যায় থেকে এনসিটিবিতে এই ‘নির্দেশ’ এসেছে, তা অনুসন্ধান করে জাতিকে জানাতে হবে। এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন যে, বর্তমান সরকারের উচ্চপর্যায় বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে হেফাজতের সুপারিশ পাঠ্যবই সংকলনে বাস্তবায়ন হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হয়তো হেফাজতের কোনো ছদ্মবেশী এজেন্ট এই কাজ করেছে। নিঃসন্দেহে তিনি অত্যন্ত ক্ষমতাবান। নইলে পাঠ্যবইয়ের লেখা পাল্টে ফেলা সম্ভব হতো না। আমরা আশা করব উপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হেফাজতি এজেন্টদের খুঁজে বের করে বিচারের মাধ্যমে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। পাঠ্যবইতে হেফাজত ইস্যুর ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য যত দ্রুত সম্ভব জাতিকে জানানো দরকার। তা না হলে আরও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়বে।
>আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ রকম কাণ্ড হতে পারে, এটা বিস্ময়কর। এটা বিএনপি সরকারের আমলে ঘটলে দেশে তুলকালাম হয়ে যেত। এখন সমালোচনা শুধু সংবাদপত্রের পাতাতেই সীমাবদ্ধ
পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন রচনা, বানান ভুল, বাক্য বিকৃতি, দুর্বল অলংকরণ, দুর্বল প্রডাকশন, দুর্বল প্রচ্ছদ ইত্যাদি নিয়ে বহু বছর ধরে নানা অভিযোগ ও সমালোচনা হচ্ছে। এ বছর হয়তো একটু বেশি সমালোচনা হয়েছে। সংবাদপত্রে লেখালেখি করে বা দু-চারজন কর্মকর্তাকে ওএসডি করলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। সরকার যদি এই সমস্যার সমাধান চায় তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটি ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে একটি কমিশন গঠনের প্রস্তাব করছি। কমিশন এ জন্য প্রয়োজন যে, এটা ছোটখাটো বিষয় নয়। এর সমাধানও সহজ নয়। পাঠ্যবই রচনা, সংকলন, পরিমার্জনা, সম্পাদনা, চূড়ান্ত সম্পাদনা, অলংকরণ, প্রডাকশন ইত্যাদি বহু দিক রয়েছে। এ ছাড়া কিছু পাঠ্যবইয়ের লেখা বাছাইয়ের জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের একটা রাজনৈতিক নির্দেশনাও থাকে। সে জন্যই সরকার বদলের সঙ্গে কিছু পাঠ্যবইয়ের লেখারও পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ ও সংস্কৃতি উন্নত না হলে বড় দুই দল কখনো পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসমূলক লেখার ব্যাপারে একমত হয় না। এটা জাতির জন্য ভালো নয়।
বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই রচনা, সংকলন, সম্পাদনা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে নীতি প্রণয়নের জন্য একটি কমিশন গঠন করা খুবই প্রয়োজন। কমিশনের সদস্যরা নিজেরা যেমন আলাপ-আলোচনা করে বিভিন্ন বিষয়ে নীতি প্রণয়ন করবেন, তেমনি দেশের শিক্ষাজগৎ ও শিক্ষা অনুরাগী মহল থেকে নানা পরামর্শ নেবেন। যাতে বিভিন্ন মহলের মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে পাঠ্যবই রচনার একটা ব্যাপক নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়।
বর্তমান এনসিটিবি অনেকটা এলোমেলোভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এখানকার কর্মকর্তা বা তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের পাঠ্যবই রচনা-সংক্রান্ত কোনো বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নেই। (ব্যতিক্রম থাকতে পারে।) প্রস্তাবিত এই নীতিমালায় বিশেষজ্ঞের একটি সংজ্ঞা প্রণয়ন করা দরকার। এনসিটিবিতে চাকরি করলেই তাঁরা বিশেষজ্ঞ হতে পারেন না। তাঁরা কর্মকর্তা। তবে কয়েকটি বিশেষজ্ঞ পদে বিজ্ঞাপন দিয়ে উচ্চ বেতনে চুক্তিভিত্তিক চাকরি দেওয়া যেতে পারে। যেমন: ১. অলংকরণ বিশেষজ্ঞ, ২. বুক প্রডাকশন বিশেষজ্ঞ, ৩. বাংলা ভাষা বিশেষজ্ঞ, ৪. ইংরেজি ভাষা বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি। প্রতিটি পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে এঁদের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
বর্তমান এনসিটিবিতে পাঠ্যবইয়ের সম্পাদক বা সংকলকের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কোনো চুক্তি হয় না। চুক্তি না থাকার ফলে সম্পাদকেরা বই জমা দেওয়ার পরও সম্পাদকের অজ্ঞাতে বইয়ের লেখা পরিবর্তন হয়ে যায়। (সংকলক-সম্পাদকদের বিবৃতি দ্রষ্টব্য।) যা কোনো সম্পাদক কল্পনাই করতে পারবেন না। সম্পাদক ও এনসিটিবির মধ্যে প্রতিটি বইয়ের জন্য চুক্তি হতে হবে। চুক্তির একটা শর্ত হতে পারে এ রকম: প্রধান সম্পাদক বই চূড়ান্ত করে জমা দেওয়ার পর বইটিতে আর কোনো সংযোজন-বিয়োজন করা যাবে না। যদি কর্তৃপক্ষ কিছু পরিবর্তন করতে চায় তাহলে সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রধান সম্পাদকসহ সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে আলোচনা হতে হবে। তাঁদের সম্মতি সাপেক্ষে বইতে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এখন চুক্তি না থাকার ফলে কর্তৃপক্ষ যখন যা খুশি তা করতে পারে। পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে এনসিটিবির এই অধিকার থাকা উচিত নয়। এনসিটিবি হবে পাঠ্যবই রচনা, সম্পাদনা ও প্রডাকশন কাজের প্রধান সমন্বয়কারী। পাঠ্যবই রচনা বা সম্পাদনার কাজে এনসিটিবির কোনো সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। এটা বিশেষজ্ঞদের কাজ।
বর্তমানে দেশে শিক্ষা-সংক্রান্ত দুটি মন্ত্রণালয় থাকলেও পাঠ্যবই প্রকাশ করে একট সংস্থা। পাঠ্যবই সম্পর্কে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো ভূমিকা নেই। পাঠ্যবই-সংক্রান্ত সব কাজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারে। এটা সমর্থনযোগ্য নয়। পাঠ্যবই রচনা-সংক্রান্ত কোনো নীতি না থাকার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। কমিশন এমন নীতি প্রণয়ন করতে পারে যে, এনসিটিবির দুটি শাখা হবে। দুটি শাখা দুই মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পাঠ্যবই রচনা ও প্রকাশ করবে।
প্রস্তাবিত কমিশন আরও কিছু বিষয় দেখতে পারে। যেমন, বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের সম্মানী। পাঠ্যবই রচনা বা সম্পাদনা করা অনেক বড় ও কঠিন কাজ। পাঠ্যবইয়ের রচনাগুলো দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীকে বছরের পর বছর অনুপ্রাণিত করে। কোন ধরনের লেখা পাঠ্যবইতে দিতে হবে, তা এ কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা এই কাজে নিয়োজিত হবেন তাঁদের ন্যূনতম ছয় মাস থেকে এক বছর সময় দেওয়া উচিত। তাঁদের প্রত্যেকের সম্মানী ন্যূনতম এক লাখ টাকা হতে হবে। বইবিশেষে তা কয়েক লাখ টাকাও হতে পারে। এক লাখ টাকার কমে কোনো সম্মানী হওয়া উচিত নয়। পাঠক জানেন, আমাদের সরকারি বহু কাজে ব্যাপক দুর্নীতি ও অপচয় হয়ে থাকে। সেখানে পাঠ্যবইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে টাকার অভাব হওয়া উচিত হবে না। পাঠ্যবইয়ের কাগজ ক্রয় ও মুদ্রণ কাজেও ব্যাপক দুর্নীতির কথা শোনা যায়। সেই দুর্নীতি একটু কমিয়েও সম্মানীর টাকার ব্যবস্থা করা যায়।
এখানে আমরা কয়েকটা দিক উল্লেখ করেছি মাত্র। পাঠ্যবই-সংক্রান্ত কমিশন গঠিত হলে কমিশনের সদস্যরা নিজেরাই আলোচনা করে ঠিক করতে পারবেন কী কী বিষয়ে নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন।
এবার স্কুল পাঠ্যবইয়ের ভুল নিয়ে এত সমালোচনা হওয়াতে একটা উপকার হয়েছে। তা হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয় এনসিটিবিকে ঢেলে সাজাতে পারবে ও পাঠ্যবই রচনার বিভিন্ন ধাপের জন্য নানা নীতিমালা তৈরি করতে পারবে। আশা করি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।