ইস্কাটনের কোনায় হাতিরঝিলের পাশ ঘেঁষে রোদ তখনই তাতিয়ে ওঠেনি। ছায়া-সুশীতল সুন্দর ফুটপাত। গাড়ি থেকে নেমে সেখানে দুই বন্ধুর দেখা। দুজনেই উল্লাস করে দৌড়ে গেল। খুশিতে মাস্কও নেমে এল মুখের নিচে কিছুটা। দাঁতখোলা হাসি নিয়ে একজন বলছিল, স্কুল খুলে গেছে রে। তারপর কী এক খোশগল্পে মেতে গেল তারা। দুজনের অভিভাবকেরাও সন্তানদের হইহুল্লোড় দেখছিলেন। গত রোববার সকালে অফিসে আসার পথে আচমকা এমন দৃশ্যে একটু থমকে দাঁড়ালাম। তাদের পিছে পিছে অল্প একটু গিয়েই পেলাম বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। ভেতরে স্কুলপোশাকে শিক্ষার্থীদের কোলাহল। প্রাঙ্গণের এক পাশে খেলছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া দুজন। অনেক দিন পর স্কুলে এসে খুব খুশি। জিজ্ঞাসা করলাম, সব বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে? একজন বলল, সবাই আসেনি। কেন এল না? স্কুল খুলছে, তাই কারও কারও মন খারাপ। আরামের দিন শেষ হয়ে গেল! বিষয়টা শুনেই মজা পেলাম।
করোনা মহামারিতে নানা সংকট, উদ্বেগ ও জল্পনাকল্পনা নিয়ে দীর্ঘ প্রায় ১৮ মাস পর খুলল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইউনিসেফ বারবার তাগিদ দিচ্ছিল স্কুল খুলে দিতে। বিশ্বে করোনাকালীন স্কুল বন্ধে তাদের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে আসে দ্বিতীয়তে। কারখানা, গণপরিবহন, পর্যটনকেন্দ্র, সিনেমা হল, মার্কেট, শপিং মল, ব্যাংক, আদালত, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টার—সব খুলল, শুধু বন্ধ রাখা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শুরু থেকে চাইলেই যেসব এলাকায় সংক্রমণ কম ছিল, সেসব এলাকায় স্কুল চালিয়ে নেওয়া, এরপর সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ধাপে ধাপে বন্ধ, আবার সংক্রমণ কমার সময় ধাপে ধাপে খোলা—কত কিছুই করা যেত। সরকারের পরামর্শক কমিটি শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে এলে স্কুল খুলে দিতে বললেও তার আগেই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে, স্কুল বন্ধের তালিকায় বিশ্বে না আবার প্রথম হয়ে যায়!
অনেকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, ঘরের ছোট সদস্যটির স্কুল বা কলেজে যাওয়া নিয়ে নানা উত্তেজনার শেষ ছিল না। যেমন মেয়ে অরুণিত ভোর প্রথম কলেজে যাবে অথচ বাবা কামাল আহমেদের ঘুম ছিল না। নতুন জামা, জুতা, ব্যাগ কেনা হলো আগেই। রাতেই সকালের নাশতা প্রস্তুত, ইস্তারি করা জামাও। মেয়েকে বাইকে চড়িয়ে বাবা কলেজেও নিয়ে গেলেন। অনেক দিন পর এমন উচ্ছ্বসিত এক সকালের অভিজ্ঞতা জানালেন অরুণিতের মা আঁখি সিদ্দিকা, একজন সরকারি চাকরিজীবী তিনি। ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থী অরুণিত দেড় বছর আগে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও এই প্রথম কলেজে গেল। সত্যিই, করোনাতে কর্মচারীদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে গিয়ে রীতিমতো নিঃস্ব হয়ে রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া কামাল আহমেদের জন্য অন্য রকম আনন্দের ছিল দিনটি। তবে মেয়েটা কলেজজীবন বলতে কিছু চিনল না, তারুণ্যের শুরুর আমেজ-উত্তেজনা-উচ্ছ্বাসটা বুঝতেই পারল না—এমন আফসোসও শোনালেন আঁখি সিদ্দিকা। স্কুলে যাওয়া নিয়ে উত্তেজনায় রাতে ঠিকঠাক ঘুমাতে পারেনি তাওসিফও। চট্টগ্রাম সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে সে। বারবার জুতা মুছে একদম চকচক করে নিয়ে সকালে দৌড় দিল। ছোট ভাইয়ের কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতেই বললেন তাহসিন বিনতে রফিক আরশী, করোনার কারণে সেশনজটের ধাক্কা নিয়েও আফসোস একটি সরকারি কলেজে এ অনার্স পড়ুয়ার।
শুরু থেকে চাইলেই যেসব এলাকায় সংক্রমণ কম ছিল, সেসব এলাকায় স্কুল চালিয়ে নেওয়া, এরপর সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ধাপে ধাপে বন্ধ, আবার সংক্রমণ কমার সময় ধাপে ধাপে খোলা—কত কিছুই করা যেত। সরকারের পরামর্শক কমিটি শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে এলে স্কুল খুলে দিতে বললেও তার আগেই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে, স্কুল বন্ধের তালিকায় বিশ্বে না আবার প্রথম হয়ে যায়!
সরকারের নির্দেশনা মেনে সব স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রস্তুতি তো ছিলই, এর বাইরেও ফুল দিয়ে বরণ, বেলুন দিয়ে গেট সাজানো, চকলেট উপহার, ড্রাম বাজিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানানোর কত বাহারি আয়োজন পত্রিকান্তরে দেখা হলো। এমনকি, বন্যার কারণে পানিবন্দী স্কুলে আসতে শিক্ষার্থীদের জন্য লম্বা সাঁকোও বানিয়ে দিয়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকেরা মিলে। তা না করে উপায় আছে! তাঁদের মতে, ‘আমাগো পোলাপাইন স্কুলে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে আছে।’ গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ভাউমান টালাবহ মডেল হাইস্কুলের সেই সাঁকো হয়ে ওঠে আনন্দের এক সেতু। টাঙ্গাইলের পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী তো ছোট নৌকা নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলেই চলে এল। এ রকম উত্তেজনা ছিল শিক্ষকদেরও। হাটহাজারী গার্লস অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা কামরুন নাহার চৌধুরী তো এত দিন পর শিক্ষার্থীদের কাছে পেয়ে খুশিই আটখানা। ফোনে একটি আশঙ্কার কথাও শোনালেন, আমাদের প্রতিষ্ঠান বড় হওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারছি, কিন্তু সব জায়গায় সেটা সম্ভব না-ও হতে পারে। তা ছাড়া বাইরে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই, গণপরিবহনেও চড়ে আসতে হয় অনেক শিক্ষার্থীকে।
দেড় বছর পর এমন উৎসবমুখর দিনে বিষাদের ছায়াও কি ছিল না। ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, চট্টগ্রামের শিক্ষক আবুল মনছুর কথা বলতে বলতে কেঁদেই ফেললেন। তিনজন সহকর্মী হারালেন এ করোনাকালে। সকালের নাশতা ভাগ করে না খেলে যে সুব্রত চৌধুরী অভিমান দেখাতেন, খালি পড়ে আছে তাঁর ডেস্ক। করোনায় বারবার স্কুল খোলার তারিখ পেছানোর চাপ আর নিতে পারেননি। কখন স্কুল খুলবে, চাকরি থাকবে কি না, এসব দুশ্চিন্তায় হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন আবৃত্তিপাগল এ শিক্ষক। স্কুলই ছিল বিয়ে না করে জীবন কাটিয়ে দেওয়া শিক্ষক শাহীন আক্তারের ঘরবাড়ি। শিক্ষার্থীরাই ছিল তাঁর সন্তান, তাদের কাছ থেকেই যেন মাতৃত্বের স্বাদ পেতেন তিনি। আরেক শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিকের মুখে লেগে থাকত রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতা-গানের কলি। দুজনেই মারা গেলেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে। প্রতিষ্ঠানের সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মূলে থাকতেন এ তিনজন। আবুল মনছুর বলছিলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন এ তিনজন। আর তাঁদেরই কিনা আমরা হারালাম। আমার এখনো বিশ্বাস হয় না, তাঁরা নেই। মনে হয় ছুটিতে আছেন। ছুটি শেষ হলেই ফিরবেন।’ তাঁর কান্না আমাকেও চুপ করিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানটিতে ২০-২৫ শিক্ষার্থী তাদের অভিভাবক হারিয়েছে করোনায়। স্কুল খুলে গেছে, বাবা কিংবা মা তাঁদের কখনো আর স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাবেন না। এমন আনন্দের দিনে স্কুলে এসে শিক্ষার্থীরা দেখল, তাদের প্রিয় শিক্ষকেরাই নেই। আরও অনেক প্রতিষ্ঠানেই নিশ্চয়ই এ বেদনা চেপে বসেছিল।
ক্লাসরুম থেকে হারিয়ে গেল করোনাকালে আত্মহত্যাকারী দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীও। এদের ৭৩ জনই স্কুল, ৪২ জন বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজ, ২৭ জন কলেজ ও ২৯ জন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। তাদের বেশির ভাগের বয়স ১২ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। সম্প্রতি আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপ থেকেই এ তথ্য জানলাম আমরা। তাদের আত্মহননের পেছনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কারণ ছিল এই মহামারি। এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না থাকলে হয়তো তাদের অনেককেই হারাতে হতো না। খালি পড়ে ছিল সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শেষ প্রান্তে আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের অনেক বেঞ্চ। কারণ, করোনাকালে স্কুলের ৫০ জন ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। এমন চিত্র কুড়িগ্রাম সদরের সারডোব উচ্চবিদ্যালয়েও। দেড় বছর পর স্কুল খোলার আনন্দে ক্লাসে ঢুকেই বিষণ্নতা নেমে আসে নবম শ্রেণির নার্গিস আক্তারের চেহারায়। কারণ, ক্লাসের নয়জন মেয়ের মধ্যে আটজনেরই বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। বাকি আছে শুধু সে। নিজের স্বপ্নভঙ্গের ভয়ই এখন চেপে বসেছে তার ভেতর। করোনাকালে শুধু যশোরের কেশবপুর উপজেলাতেই তিন হাজার বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। বুঝে নিতে বাকি থাকে না, গোটা দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে কত মেয়ের স্কুলে ফেরা হলো না।
চরফ্যাশনের বকতিরহাট সিনিয়র মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শামিম তো কারখানায় পুড়ে কয়লাই হয়ে গেল। করোনায় মসজিদের ইমামতির চাকরি গেল বাবার। মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় পরিবারকে সহায়তা করতে এবং নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে রূপগঞ্জে হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় চাকরি নিয়েছিল শামিম। সেটিই কাল হয়ে দাঁড়াল তার জন্য। পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছা ছিল তার। চরফ্যাশনের দক্ষিণ আমিনাবাদ কবি মুজাম্মেল হক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া মোহাম্মদ হাসনাইনের ছোট্ট দেহটি আগুনে পুড়ে কতটুকু ছোট হয়ে গিয়েছিল জানি না। কিংবা মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের সোমারানী বর্মণের দেহটাও, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। কারখানাটি চলতই মূলত শিশুশ্রমে। সেই ফাঁদেই পড়েছিল করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক শিশু। অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৫৪ শ্রমিকের মধ্যে বড় অংশই ছিল শিশু। আর দুই মাস অপেক্ষা করলে হয়তো তারা আবার স্কুল-মাদ্রাসায় ফিরে যেত। তাদেরও হয়তো ক্লাসে যাওয়ার আনন্দে আগের রাতে ঠিকঠাক ঘুম হতো না, তাদেরও হয়তো ঈদের দিন মনে হতো। কিন্তু তাদের ফেরা হলো না, কোনো দিন ফিরবে না তারা। অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে তারা আর কখনো গাইবে না, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক