মতামত

স্কুল-কলেজের তালা খোলাই যথেষ্ট নয়

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলেই বিবেচনা করা দরকার। অতিমারির সূচনা থেকেই সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিল এবং অনলাইনে শিক্ষা প্রদানের কথাবার্তা যতটা জোরেশোরে বলা হয়েছিল, ঠিক ততটাই ব্যর্থ হয়েছে। বারবার ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলার পরও এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান হবে, এমন আশা করা যায় না। যে দেশে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি পৃথিবীর শেষ পাঁচটি দেশের একটি, সেখানে এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা ছিল না। ফলে এ নিয়ে বাক্যবিস্তার নিরর্থক।

করোনা মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিয়ে আমরা সবাই অবগত। কয়েক দফা লোকদেখানো ‘বিধিনিষেধ’, বেশ কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা এবং মাঝেমধ্যে টিকা প্রদানের ‘উৎসব’ হচ্ছে গত ১৮ মাসের অভিজ্ঞতা। এর মধ্যে একেবারে স্থির থেকেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা। সবকিছুই ‘স্বাভাবিক’ থেকেছে; কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দরজায় তালা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর যে হাতে গোনা কয়েকটি দেশে এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ। শেষ খবর হচ্ছে, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন, আগামী অক্টোবর মাসে ধাপে ধাপে খুলতে পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সবকিছুই ‘স্বাভাবিক’ থেকেছে; কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দরজায় তালা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর যে হাতে গোনা কয়েকটি দেশে এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।

বৈশ্বিকভাবে করোনা মহামারির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের মধ্যে তিনটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, শিক্ষা খাতে প্রভাব। দীর্ঘদিন ধরে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় একটি প্রজন্মই পিছিয়ে পড়বে। যেসব দেশে স্বল্প সময়ের জন্যও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, সেখানেও এই উদ্বেগের কথা বলা হচ্ছে। একটা বড় সমস্যা হচ্ছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের কী করে ফেরানো যাবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষের পুষ্টির অভাব। কারণ আয় হ্রাসের কারণে দরিদ্র মানুষ কম খাদ্য গ্রহণ করছে। ভবিষ্যতে এই পুষ্টিহীনতার প্রতিক্রিয়া হবে। তৃতীয়ত হচ্ছে, আয়বৈষম্য বৃদ্ধি। করোনাকালেও ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন। এর তিনটির কোনোটি থেকেই বাংলাদেশ মুক্ত নয়। দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা মোকাবিলায় সরকারের কোনো ধরনের পরিকল্পনা আছে, এমনকি ভাবনা আছে বলেও প্রতীয়মান হয় না। করোনাকালে মানুষ দরিদ্র হয়েছে, পরিকল্পনামন্ত্রী এটাই মানতে রাজি ছিলেন না।

করোনা মোকাবিলায় সরকারের মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি এবং সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা নেই, সেটা গত দেড় বছরে পদে পদে প্রকাশিত হয়েছে। অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি কেবল রাজনীতি বা অর্থনীতিতেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে তা নয়, জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের ওপরও প্রভাব রাখে। সরকারের পদক্ষেপগুলোর ব্যর্থতার প্রমাণ হচ্ছে, প্রণোদনা প্যাকেজগুলো শেষ পর্যন্ত ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য কোনো ধরনের সাহায্য হলো না। টিকা সংগ্রহ ও বিতরণের হাল কী, সেটা সবাই জানেন। কিন্তু এর পরের পরিস্থিতির জন্য দায় কার? সামান্য যোগ-বিয়োগের হিসাব না করে টিকাদান উৎসবের আয়োজন ‘সাফল্যের’ গল্প হিসেবে ভালো শোনায়, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ।

এ রকম লেজেগোবরে অবস্থার মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থেকেছে। শপিং মল বা ফেরিঘাটের ভিড়ের চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিড় থেকে কেন বেশি ভাইরাস ছড়াবে, সেটা জনস্বাস্থ্যের তত্ত্ব দিয়ে বিচার করা যাবে না। এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক। সরকারের মন্ত্রীরা সম্প্রতি ইচ্ছায় অথবা অসাবধানতাবশত স্বীকার করেছেন। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রতীকী ক্লাস নিতে শুরু করলে এ নিয়ে একধরনের মাথাব্যথা দেখা দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কয়েক মাস ধরেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রস্তুতির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কী প্রস্তুতি নিয়ে শেষ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে, তা এখনো জানা যায়নি।

টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা অগ্রাধিকার পাবেন কি না, সেটা সরকার বলেনি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাস্ক পরার বিষয়ে নিশ্চিত করা এবং তাদের পরীক্ষা করার দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে, সেটাও জানা নেই। কোনো প্রতিষ্ঠানে আক্রান্তের সংখ্যা কোন মাত্রায় গেলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছেন, এমন ব্যক্তিদের ব্যাপারে কী ধরনের নজরদারি থাকবে, প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানগুলো কার শরণাপন্ন হবে, এসব তথ্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের জানা জরুরি। বিভিন্ন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে খোলা হয়েছে; সেগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে ধার করা যায়। অর্থনৈতিকভাবে এবং সমাজকাঠামোর বিবেচনায় বাংলাদেশের সমপর্যায়ের দেশগুলোর অভিজ্ঞতাই বেশি কাজে লাগবে।

করোনাকালে শিক্ষা খাতের যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে, সেটা কেবল প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই আপনা-আপনি পূরণ হবে, এমন আশা করা বাতুলতাই নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীনতারও লক্ষণ। সমাজে শিক্ষায় বৈষম্য সব সময় ছিল, এই দেড় বছরে উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্তদের সন্তানেরা নিজস্ব উদ্যোগে তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পেরেছে। দরিদ্রদের সন্তানেরা আরেক দফা পেছাল।

করোনাকালে শিক্ষা খাতের যে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে, সেটা কেবল প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেই আপনা-আপনি পূরণ হবে, এমন আশা করা বাতুলতাই নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীনতারও লক্ষণ। সমাজে শিক্ষায় বৈষম্য সব সময় ছিল, এই দেড় বছরে উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্তদের সন্তানেরা নিজস্ব উদ্যোগে তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পেরেছে। দরিদ্রদের সন্তানেরা আরেক দফা পেছাল। ইতিমধ্যে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফেরানোর পথ তো কেবল স্কুলের দরজার তালা খুলে দেওয়া নয়। ব্র্যাক ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায় বলা হচ্ছে, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অন্যান্য সময়ের তুলনায় দেশে বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বেড়েছে, যা ২৫ বছরে সর্বোচ্চ। করোনাকালে পারিবারিক আয় বন্ধ হওয়ার কারণে যেসব পরিবার তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারবে না, তাদের কাছে স্কুল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় সরকারকেই পৌঁছার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে এ কাজে এনজিওসহ অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা যায়। এ জন্য দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা কি সরকারের আছে?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়টির সব শিক্ষার্থীকে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে টিকা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা হবে’ (সমকাল, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১)। পর্যায়ক্রমিকভাবে ছাত্রাবাস ইতিমধ্যেই খোলা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব শিক্ষার্থীকে দেওয়ার মতো টিকা সরকারের হাতে আছে কি না। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিদ্ধান্ত কী, তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে কথিত ‘গণরুমের’ যে ব্যবস্থা চালু আছে, তা এক বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীর ভাগ্য সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের হাতে তুলে দেয়। এই সুযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি এই অমানবিক ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হয়, তবে অন্তত একটা ইতিবাচক দিক দেখা যাবে। রাজনৈতিক দিক বিবেচনা করলে এটি আশা করা যায় না, কিন্তু এসব শিক্ষার্থীর জীবন ও জনস্বার্থের বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ কি কিছুই করতে পারবে না?

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট