সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান অবশেষে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রচার সংস্থা পিবিএস নেটওয়ার্ককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, খাসোগিকে হত্যার দায় তাঁর ওপরেই বর্তায়। তবে এটা হতাশাজনক যে যুবরাজ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, এমন ব্যাপক প্রমাণ থাকার পরও তিনি এ ব্যাপারে জবাবদিহি করা এড়াতে পেরেছেন। এটা অগ্রহণযোগ্য।
সৌদি আরবের প্রবীণ সাংবাদিক খাসোগিকে সর্বশেষ গত বছরের অক্টোবরে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করতে দেখা গিয়েছিল, যেখানে তাঁর বাগ্দত্তা হাটিস সেনগিজকে বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাওয়ার কথা ছিল। কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও ফিরে না আসায় তাঁর বাগ্দত্তা খাসোগির নিরাপত্তার আশঙ্কা করে বিষয়টি পুলিশকে জানান। আসলে হত্যাকারীরা চেয়েছিলেন খাসোগি যেন সৌদি আরবের নেতৃত্বের সমালোচনা করতে না পারেন এবং এ জন্য তাঁকে চিরদিনের মতো চুপ করিয়ে দেন। অথচ খাসোগি নিজের দেশকে ভালোবাসতেন এবং একদিন সেখানে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।
সম্ভবত এই মামলার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক তথ্য হলো, খাসোগি এমন একজন সাংবাদিক ছিলেন, যিনি অন্যায় ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলতেন এবং চাইতেন সৌদি আরব একটি সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত হোক।
হত্যার তদন্তকারী তুর্কি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন যে হত্যাকারীরা সৌদি সরকারের উচ্চপর্যায়ের আদেশের ভিত্তিতে কাজ করেছেন। এ ছাড়া জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে ‘খাসোগির হত্যাকাণ্ডটি পরিকল্পিত এবং বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সৌদি আরব দায়ী।’ তিনি আরও জানতে পেরেছেন যে সৌদি যুবরাজ ও অন্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে খাসোগি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ রয়েছে। তবে সৌদি সরকার জাতিসংঘের র্যাপোর্টিয়ারের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুবরাজের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছিল।
এখন সৌদি যুবরাজ বলছেন, খাসোগি হত্যার দায় তাঁর নিজের। কারণ, তিনি যখন কার্যত রাষ্ট্রের ক্ষমতায়, তখন খাসোগি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। পিবিএসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সৌদি যুবরাজ বলেছেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের সব দায়দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।’ অথচ তিনি প্রথমে বলেছিলেন, ‘আমাদের লুকানোর কিছুই নেই’ এবং রিয়াদের কর্মকর্তারা বারবার তাঁদের গল্প পরিবর্তন করেছিলেন। যদিও যুবরাজ পিবিএসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে যাচ্ছে, তা তাঁর আগে জানা ছিল না, কিন্তু এটা সত্য যে তাঁকে জবাবদিহি করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। খাসোগির হত্যা মামলা অবশ্যই গণমাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে আনতে হবে এবং তিনি ও তাঁর পরিবার যাতে ন্যায়বিচার পায়, সে জন্য চাপ বাড়াতে হবে এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা সৌদি যুবরাজকে রক্ষা করতে এবং জবাবদিহি এড়ানোর ব্যাপারে তাঁকে খুব বেশি দিন সহায়তা করতে পারবেন না। খাসোগি হত্যার অল্পদিনের মধ্যেই ট্রাম্প জি-২০–এর সম্মেলনে মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং তাঁকে একজন ‘শক্তিশালী ব্যক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেন, যিনি ‘সত্যিই তাঁর দেশকে ভালোবাসেন’।
সৌদি যুবরাজ খাসোগিকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন—সিআইএর এমন প্রতিবেদনের পরও ট্রাম্প তাঁকে ‘মহান মিত্র’ বলে অভিহিত করেন। এ ধরনের নির্মম হত্যাকাণ্ড সৌদি যুবরাজের অজান্তে চালানো হয়েছে, এটা অবিশ্বাস্য এবং এ কারণেই ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের কথা বলতে হবে এবং এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাতে হবে।
পশ্চিমা রাজনীতিবিদেরাও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছেন এবং তাঁরা খাসোগি হত্যায় তেলসমৃদ্ধ দেশটির ভূমিকার বিষয়টি অগ্রাহ্য করে তাঁদের সম্পর্কের অর্থনৈতিক ও আর্থিক সুবিধার দিকে মনোনিবেশ করেছেন। এটা খুবই দুঃখজনক।
যাহোক, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার স্বার্থে, আমার মতো সাংবাদিকেরা চাই, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার রক্ষার স্বার্থে খাসোগির মৃত্যুর জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক। যাঁরা যেকোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের মুখোমুখি হয়েছেন, তাঁদের আদালতে বিচার চাইতে হবে। এই কারণেই জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডে সৌদি যুবরাজ বা অন্য কেউ যদি জড়িত থাকেন, তাঁকে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে।
একজন মুসলিম হিসেবে আমি সৌদি যুবরাজকে একটি বার্তা পাঠাতে চাই যে বিশ্বের পবিত্রতম মুসলিম ভূমির অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও আপনি আপনার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে চলেছেন। যখন ইসলাম সত্য, শান্তি এবং প্রতিটি মানবজীবনের দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানায়, তখন আপনি কেন নিজের ভাইকে হত্যা করছেন?
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
তাসনিম নাজির: ব্রিটিশ সাংবাদিক ও লেখক