প্রচলিত সংবাদমাধ্যম সৌদি আরবকে অবমূল্যায়ন করার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করে না। তারা সৌদিতে সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত ‘লোহিত সাগর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’কে ‘হোয়াইট ওয়াইশ’ বলে তির্যক সমালোচনা করেছে। গত ডিসেম্বরে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ‘গ্র্যান্ড প্রিক্স’ ও ‘ডাকার র্যালি’ নিয়েও তারা বিদ্বেষপূর্ণ সমালোচনা করে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বাদশাহ আবদুল্লাহ অর্থনৈতিক নগরে গলফ টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রেও একই মাত্রার সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
কানাডার সংগীত তারকা জাস্টিন বিবার ও ফ্রান্সের ডিজে ডেভিড গুয়েতা সম্প্রতি সৌদি আরবে কনসার্টে গান গেয়ে গেছেন। যদিও মানবাধিকার লঙ্ঘন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো ইস্যুতে তাঁদের সৌদি আরবে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন অনেকে। সৌদি আরবে এখন একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। দেশটির কট্টর সমালোচকেরা এত দিন ধরে পরিবর্তনের কথা বলে এসেছেন। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যখন সত্যি সত্যি সেই পরিবর্তনটা ঘটছে, সেটা সাধুবাদ তাঁরা জানাতে পারছেন না।
সৌদি আরবে কেন দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে না বলে যাঁরা এখন সমালোচনায় মেতে উঠেছেন, তাঁদের অবশ্যই সেখানে যে বড় পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, সেটার প্রকৃতি বুঝতে হবে। দেশটির ইতিহাস সম্পর্ককেও ধারণা থাকতে হবে।এসব সমালোচনা আমলে নেওয়ার প্রয়োজন নেই সৌদি নেতাদের। কিন্তু যাঁরা দেশটির বদলের মূল কারিগর, তাঁদের সমাজের বিভিন্ন স্তরের উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। এটা মোটেই সহজ কোনো কাজ নয়। সৌদি আরবের তরুণ প্রজন্ম ও ক্রমবর্ধমান বিশ্বজনীন মানসিকতার লোকজনের আশা ও প্রত্যাশা তাদের স্বীকার করে নিতে হবে, তাতে সাড়াও দিতে হবে। আবার একইভাবে গভীরভাবে ধর্মীয় ভাবাপন্ন একটি সমাজের রক্ষণশীল অংশের আবেগের প্রতিও শ্রদ্ধা থাকতে হবে।
সৌদি আরবে যে পরিবর্তনের বাতাস বইছে, তার কেন্দ্রে রয়েছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি সম্প্রতি তাঁর দেশের ইতিহাসের অন্ধকারময় একটি অধ্যায় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। সেটি হলো ১৯৭৯ সালে উগ্রবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক মক্কা অবরোধ। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ওই ঘটনাটি ঘটেছিল। ওই হামলাটি ছিল সৌদি আরবের জন্য বড়সড় একটা ধাক্কা। এর ফলে সৌদি আরব আরও বেশি রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করে। বাইরের বিশ্বের জন্য নিজেদের দরজা বন্ধ করে দেয়।
সৌদি আরবে যে পরিবর্তনের বাতাস বইছে, তার কেন্দ্রে রয়েছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি সম্প্রতি তাঁর দেশের ইতিহাসের অন্ধকারময় একটি অধ্যায় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। সেটি হলো ১৯৭৯ সালে উগ্রবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক মক্কা অবরোধ। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর ওই ঘটনাটি ঘটেছিল। ওই হামলাটি ছিল সৌদি আরবের জন্য বড়সড় একটা ধাক্কা। এর ফলে সৌদি আরব আরও বেশি রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করে। বাইরের বিশ্বের জন্য নিজেদের দরজা বন্ধ করে দেয়।
২০১৮ সালে সিবিএস টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সৌদি যুবরাজ বলেছেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশ জনগণের উন্নয়ন যে রকমটা করে, আমরা সেই স্বাভাবিক উন্নয়নটাই করছি।...মেয়েরা এখন গাড়ি চালাচ্ছে। সিনেমা হলে সিনেমা চলছে। নারীরা সব জায়গায় কাজ করছে।’
১৯৭৯-এর দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার চার দশক পর সৌদি আরব উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করেছে। যদিও সেই উন্নয়ন অন্য দেশের আদলে হচ্ছে না। সৌদি আরব এত দিন তেলনির্ভর জ্বালানি যুগের অন্যতম অগ্রপথিক ছিল। এখন তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী দেশ হতে চায়।
ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য ভিশন-২০৩০ রূপকল্প তৈরি করেছে সৌদি আরব। তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা তারা করেছে। জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা তারা করছে।
সৌদি আরব এখন বাইরের দুনিয়ার জন্য নিজেদের দরজা খুলে দিচ্ছে। বিপুলসংখ্যক বিদেশি পর্যটক টানার জন্য তারা একগুচ্ছ বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক স্থান দিরিয়াকে ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্প এবং লোহিত সাগরের তীরের স্মার্ট মেগাসিটি নিয়োম গড়ে তোলা।
সৌদি আরবে এখন ক্রীড়া ও বিনোদনজগতের মহাতারকাদের নিজেদের দেশে নিয়ে আসছেন। তাদের এই সফরের অভিজ্ঞতা বাকি বিশ্বকে দেশটি সম্পর্কে নতুন ধারণা দেবে। তাতে সৌদি আরব সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারণা ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করবে।
চারবারের ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন সেবাস্তিয়ান ভেটেল। গত ডিসেম্বরে জেদ্দায় নারীদের গাড়ির রেসিংয়ে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আমরা যখন এ ধরনের কোনো দেশে যাই, তখন খুব বেশি নেতিবাচক উদাহরণের দিকেই আমাদের মনোযোগটা থাকে। আমরা যদি পশ্চিম ইউরোপের চোখে দেখি, তাহলে আমাদের কাছে মনে হবে সৌদি আরবে অনেক পরিবর্তন দরকার। কিন্তু এটাও সত্য বেশ কিছু পরিবর্তন সেখানে হচ্ছে।’ নারীদের গাড়ির রেসিংয়ে অংশ নেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে নিতে বলেন, ‘এটা খুব বড় পার্থক্য গড়ে দেয়।’
সৌদি আরবের কট্টর সমালোচকেরা এই পরিবর্তনকে বুঝতে সক্ষম নন। সৌদি আরবকে কী ধরনের দেশ হিসেবে তাঁরা দেখতে চান? আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে বেমানান রক্ষণশীল একটা দেশ?
সৌদি আরব ৩ কোটি ৫০ লাখ জনগোষ্ঠীর এমন একটা দেশ, যেখানকার অর্ধেকই ২৫ বছরের নিচে। এই তরুণদের প্রত্যেকের তাঁদের নিজেদের ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা ও স্বপ্ন রয়েছে। তাঁদের মঙ্গলের জন্য সৌদি আরবের বৃত্ত ভাঙার সময় এসেছে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনূদিত
জনাথন গর্নাল ব্রিটিশ সাংবাদিক