মতামত

সোলাইমানি যেভাবে পুতিনকে পক্ষে টানলেন

কাশেম সোলাইমানি ও ভ্লাদিমির পুতিন
কাশেম সোলাইমানি ও ভ্লাদিমির পুতিন

বিরাট পদে থাকা ব্যক্তির ভূমিকা ইতিহাসে কত ছোট হতে পারে, ডোনাল্ড ট্রাম্প তা প্রমাণ করেছেন। বিরাট দেশের অযোগ্য নেতা হিসেবে তিনি বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর নির্দেশে খুন হওয়া ইরানি জেনারেল সোলাইমানির মৃত্যুর পরও বড় হয়ে উঠছেন। মাঝারি শক্তির বড় নেতা হিসেবে তিনি মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি পশ্চিমা নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আলোচনায় আবার নতুন করে আসছেন জেনারেল কাশেম সোলাইমানি।

গত জানুয়ারি মাসের শেষে লেবাননের হিজবুল্লাহর প্রধান নেতা হাসান নাসরুল্লাহর সাড়াজাগানো এক সাক্ষাৎকার লেবাননের আল মায়াদিন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়। সেখানে তিনি দাবি করেন, জেনারেল সোলাইমানিই হলেন সেই লোক, যিনি রাশিয়াকে বুঝিয়ে সিরিয়ার পাশে দাঁড় করিয়েছেন। আর সেটা হয়েছিল রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে মুখোমুখি দুই ঘণ্টার বৈঠকে। আধুনিক সময়ের দুই শ্রেষ্ঠ সামরিক কৌশলবিদের আলাপ নির্ঘাত এক ঐতিহাসিক ঘটনা। কারণ, এরপরই মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা বদলে যেতে শুরু করে। আইএস পরাস্ত হয়, আসাদ টিকে যান, ইরাকে মার্কিনবিরোধী মিলিশিয়ারা শক্তিশালী হতে শুরু করে।

সামরিক হিসাব-নিকাশের বাইরে সোলাইমানি পুতিনের কাছে আরেকটি বিপদের আশঙ্কা স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, ‘আসাদকে যেতে হবে’ স্লোগান আর জিহাদি অভিযানের লক্ষ্য দামেস্কের পতন ঘটিয়ে এক মিথ্যা খিলাফতের প্রতিষ্ঠা করা, যাদের আসল নিশানা ইরান নয়, রাশিয়া।

এতে সিরিয়ায় সুদিন না এলেও আরেকটি ইরাক হওয়া থেকে রক্ষা পায় দেশটি। আমেরিকা-ইসরায়েল-সৌদি ত্রিশূলের মধ্যপ্রাচ্যকে সম্পূর্ণ কবজা করে ইরানকে পঙ্গু করার কর্মসূচি এতেই ভেস্তে যায়। চীনা বিশ্বায়নের বাহন বেল্ট অ্যান্ড ওয়ে প্রকল্প মধ্যপ্রাচ্যে সুযোগ পায়। আর আরও পোক্ত হয় ইরান-রাশিয়া-চীনের মৈত্রী। অন্যদিকে বাধ্য হয়ে তুরস্কের এরদোয়ানকে হতে হয় মার্কিনবিরোধী। তারা দেখল, ইরান-রাশিয়ার সুবিধাজনক অবস্থানের সঙ্গে মিতালি করা তুরস্কের জন্যও সুবিধাজনক।

সিরীয় যুদ্ধের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ঘুরে যাওয়ার ওই সময়টি ছিল ২০১৫ সাল। পশ্চিমা গণমাধ্যমে চলছে ‘আসাদকে বিদায় নিতেই হবে’ প্রচার। বিদ্রোহী সালাফি ও আইএসের কাছে ধারাবাহিকভাবে পরাস্ত হচ্ছে আসাদের বাহিনী। এ রকম এক সময়ে নাসরাল্লাহ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সোলাইমানির বৈঠকের দূতিয়ালি করেন। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় মস্কোতে। সেখানে পুতিন একা ছিলেন না, ছিলেন তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রীসহ প্রধান প্রধান জেনারেল ও সামরিক উপদেষ্টারা।

কোনো ভিনদেশি কমান্ডারের পক্ষে পরাশক্তির প্রতাপশালী নেতাকে নিজের পরিকল্পনায় রাজি করানো বিপুল ব্যক্তিত্বের আর ধারালো যুক্তির কাজ। নাসরাল্লাহ বলছেন, ‘(বৈঠকে) সোলাইমানি সিরিয়া ও ওই অঞ্চলের বিশদ কৌশলগত প্রতিবেদন পেশ করে তাঁর প্রস্তাবিত চিন্তা ও কাঙ্ক্ষিত ফলের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। তিনি ব্যবহার করেন বৈজ্ঞানিক, নৈর্ব্যক্তিক, সামরিক এবং যুদ্ধক্ষেত্রের ভাষা। তাঁর হয়ে কথা বলে মানচিত্র, ভূ-ভাগ, সংখ্যা ও পরিসংখ্যান। বৈঠক শেষে পুতিন সোলাইমানিকে বলেন, “আই অ্যাম কনভিন্সড”। এভাবে সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত হয়।’

নাসরাল্লাহ অবশ্য পরিষ্কার করেন যে পুরো ব্যাপারটা ঘটেছিল সিরিয়ার অনুরোধে। যেভাবে ইসরায়েল ও সৌদি আরবসহ পশ্চিমা শক্তি বিদ্রোহীদের দিয়ে সিরিয়াকে লিবিয়ার কায়দায় ধ্বংস করতে চেয়েছিল, তাতে ইরানের একার পক্ষে তা মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত, সোলাইমানি যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যে কৌশলগত বিন্যাস সাজিয়েছিলেন, তা রাশিয়ার জন্য লাভজনক ছিল। তৃতীয়ত, ওই অঞ্চল সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান, প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব আর সাহসিকতার কারণে সোলাইমানিই ছিলেন উপযুক্ত ব্যক্তি, যাঁকে পুতিন ভরসা করতে পারেন।

সামরিক হিসাব-নিকাশের বাইরে সোলাইমানি পুতিনের কাছে আরেকটি বিপদের আশঙ্কা স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, ‘আসাদকে যেতে হবে’ স্লোগান আর জিহাদি অভিযানের লক্ষ্য দামেস্কের পতন ঘটিয়ে এক মিথ্যা খিলাফতের প্রতিষ্ঠা করা, যাদের আসল নিশানা ইরান নয়, রাশিয়া। সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে রাশিয়ার গ্রজনির দূরত্ব মাত্র ৯০০ কিলোমিটার এবং যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের জিহাদিদের দিয়ে সাবেক সোভিয়েতের মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলো এবং রুশ মুসলিম সমাজকে জিহাদি করে রাশিয়ার তলপেটে আঘাত করা।

২০১৫–এর সেপ্টেম্বর থেকেই আকাশে রুশ বিমান আর ভূমিতে লেবানিজ হিজবুল্লাহ, ইরানের বিপ্লবী গার্ড ও সিরিয়া বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। সে সময়টায় সোলাইমানিকে পাওয়া যেত হয় দামেস্কের যুদ্ধনিয়ন্ত্রণ কক্ষে, নয়তো বাগদাদে বসে শিয়া মিলিশিয়াদের পরিচালনার কাজে।

২০১৫ সালের জুলাই মাসের এই গোপন বৈঠকের খবর সে সময় রয়টার্স প্রকাশ করে। তাতে জানা যায়, এই বৈঠকের কয়েক মাস আগে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ইরানের খামেনির বৈঠকে সিরিয়ার সাহায্যে ইরান-রাশিয়া যৌথ বাহিনী গঠনের আলাপ হয়। এর পর খামেনি পুতিনের কাছে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে পাঠান। পুতিন নাকি তাঁকে বলেন, ‘ঠিক আছে, আমরা হস্তক্ষেপ করব। আগে কাশেম সোলাইমানিকে পাঠাও।’
মিত্ররা বলে থাকেন, নিজের আইডিয়া অন্যকে বুঝিয়ে রাজি করানোয় সোলাইমানি এক নম্বর। তা ছাড়া তাঁর ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের বিস্তৃত অভিজ্ঞতা, সরাসরি সৈন্যদের কাছ থেকে পাওয়া ধারণা, পরিস্থিতির নিখুঁত বিশ্লেষণ। দুনিয়ার এক নম্বর ভূরাজনৈতিক দাবাড়ু পুতিনের আস্থা অর্জন করা থেকেই তা বোঝা যায়।

২০১৫–এর সেপ্টেম্বর থেকেই আকাশে রুশ বিমান আর ভূমিতে লেবানিজ হিজবুল্লাহ, ইরানের বিপ্লবী গার্ড ও সিরিয়া বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। সে সময়টায় সোলাইমানিকে পাওয়া যেত হয় দামেস্কের যুদ্ধনিয়ন্ত্রণ কক্ষে, নয়তো বাগদাদে বসে শিয়া মিলিশিয়াদের পরিচালনার কাজে। আইএসকে তাড়াতে একসঙ্গে তিনি ইরাক ও সিরীয় ফ্রন্টে তৎপর ছিলেন। সাধারণ সৈনিকের মতো থেকেছেন বাংকারে। একযোগে সমন্বয় করেছেন বেশ কটি দেশের সামরিক অভিযান।

সোলাইমানির লক্ষ্য শুধু সিরিয়া ছিল না। তিনি চেয়েছেন ইরাক থেকে মার্কিন সেনারা চলে যাক, মধ্যপ্রাচ্য দখলমুক্ত হোক। তাঁর কাজের ধরনের একটা নমুনা দিয়েছেন হিজবুল্লাহর মহাসচিব হাসান নাসরাল্লাহ। কূটনৈতিক সফরে বাগদাদে আসার পর মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মৃত্যুর চার দিন আগে সোলাইমানি বৈরুত আসেন। ‘আমি শুধু একটু গল্প করতে এসেছি’ বলেছিলেন তিনি নাসরাল্লাহকে। পরে রাতের দিকে তিনি নাসরাল্লাহর কাছে ইরাকের মিলিশিয়াদের জন্য ৬০ জন হিজবুল্লাহ কমান্ডার দিতে বলেন। ভোরের দিকে তাদের নিয়ে সোলাইমানি যাত্রা করবেন। নাসরাল্লাহর জন্যও মধ্যরাত থেকে ভোরের মধ্যে এত সামরিক নেতা এক জায়গায় করা কঠিন। কিন্তু সোলাইমানি ছিলেন নাছোড়বান্দা। নাসরাল্লাহ যখন বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছেন, তিনি দেখেন, তাঁর বন্ধু তখন তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ছেন। ভোর হলো, ৬০ না হোক, ৪০ জন কমান্ডার নিয়ে সোলাইমানি বিমানে করে উড়াল দিলেন। বাকি কমান্ডাররা পরে যান। ইরাকে ইরানপন্থী মিলিশিয়ারা কেবল আইএসকেই পরাস্ত করেনি, মার্কিন বাহিনীর জন্যও মারাত্মক হুমকি হয়ে আছে।

সোলাইমানি নেই, কিন্তু তাঁর রচিত ভূরাজনৈতিক কৌশল অনেকটাই বাস্তবায়িত। রাশিয়া সেখানে আমেরিকার প্রবল প্রতিপক্ষ, ইরান আরও জোরদার। ইয়েমেনের হুতিরা বাইডেন প্রশাসনের মাধ্যমে সন্ত্রাসী তালিকার বাইরে এল। অর্থাৎ সৌদি আরব ইয়েমেনে পরাস্ত হলো।

এই ব্যক্তি জানতেন, যুদ্ধ হচ্ছে রাজনীতির সম্প্রসারণ। তাঁর সামরিক রাজনীতি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসকে তিনি যতটা বদলে দিয়েছেন, আর কাউকে তেমনটা দেখা যায়নি। ইরানের প্রতিরক্ষা বলয়কে তিনি ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেন পর্যন্ত প্রসারিত করেছেন। এভাবে ইরান উঠে এসেছে দর–কষাকষির জায়গায়। এই সামরিক কৌশলগত অবস্থানের কারণে ওদিকে চীন, এদিকে রাশিয়াকে তারা মিত্র হিসেবে পেয়েছে। এ জন্য কেউ কেউ বলেন, চে গুয়েভারা যদি সফল হতেন, তাহলে সোলাইমানির মতো হতেন।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
faruk.wasif@prothomalo.com