পৌরাণিক কাহিনি রামায়ণে উল্লেখ রয়েছে, একবার লঙ্কার রাজা রাবণ সীতার খোঁজে যাওয়া হনুমানের লেজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। হনুমান নিজের লেজের আগুন ছড়িয়ে দিয়ে সমগ্র লঙ্কাপুরি ভস্মীভূত করে দিয়েছিলেন। পরে কিষ্কিন্ধায় ফিরে হনুমান রামকে সীতার খবর দিয়েছিলেন।
রামায়ণের হনুমানের এই কাহিনির সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংসতার কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে প্রায় তিন বছর ধরে পাহাড় আবার অশান্ত হয়ে রয়েছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার বান্দরবানে অতর্কিত হামলায় ছয়জন পাহাড়ি নিহত হলেন। ২০১৫ সালে পাহাড়ের তিনটি আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি, ইউপিডিএফ ও জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা) নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে হানাহানি থামিয়েছিল। শান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল পাহাড়জুড়ে। পর্যটন বেড়েছিল, অপরাধ কমেছিল।
সেই শান্ত পাহাড় আবার অশান্ত হওয়ার নেপথ্যে ছোট একটি ভাঙন। ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে সংবাদ সম্মেলন করে ইউপিডিএফ থেকে ছোট একটি অংশ বেরিয়ে যায়। সে অংশের নেতৃত্বে ছিলেন তপনজ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা। তাঁদের সঙ্গে তখন পাহাড়ের অপর আঞ্চলিক দল জেএসএসের (এম এন লারমা) সখ্য গড়ে ওঠে। তারপর দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে সময় লাগে মাত্র ২০ দিন। ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির নানিয়ারচরে ইউপিডিএফের গ্রামপ্রধান ও ইউপি সদস্য অনাদি রঞ্জন চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শান্ত পাহাড় ফের অশান্ত করার প্রথম পেরেকটি ঠোকা হয়। এ জন্য ইউপিডিএফ তপনজ্যোতি ও তাঁর ক্যাডারদের দায়ী করে।
তার পরের বছর, ২০১৮ সালের ৪ মে নানিয়ারচর যাওয়ার পথে ব্রাশফায়ারে তপন জ্যোতিসহ পাঁচজন খুন হন। তার আগের দিন নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় জেএসএস–এম এন লারমার সহসভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে। দুটি ঘটনার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করে দল দুটি। তারপর বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটে খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজারে, ১৮ আগস্ট। ইউপিডিএফের মিছিল শুরুর প্রাক্কালে নির্বিচারে গুলি চলে। ছয়জনের প্রাণ যায়। তাঁদের মধ্যে সাধারণ মানুষ তিনজন। এভাবে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সহিংসতা চলতে থাকে এ তিনটি দলের মধ্যে। নিয়ন্ত্রণ-আধিপত্যের পাশাপাশি চাঁদাবাজির পুরোনো অভিযোগও ওঠে। তবে চাঁদাবাজির অভিযোগের আড়ালে দলগুলোকে অপরাধপ্রবণ দেখানোর একটা ব্যাপারও থাকে বলে তাদের ভাষ্য। ভূমির অধিকার ফেরতসহ পার্বত্য চুক্তির নানা শর্ত পূরণ না হওয়াও অশান্তির কারণ। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির নেতা গৌতম দেওয়ানের বক্তব্য, পাহাড়িরা দেশপ্রেমিক। কেউ কেউ তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেখাতে চায়। এ ধরনের বৈষম্য, আধিপত্যসহ নানা কারণে বিভক্তি হচ্ছে।
কথাটা মিথ্যা নয়। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তির সময় দল ছিল শুধু জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস। পরের বছর চুক্তির বিরোধিতা করে ইউপিডিএফ গঠিত হয়। আবার সংঘাত শুরু হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। ২০১০ সালে জেএসএস ভেঙে গঠিত হয় জেএসএস-এম এন লারমা। এখন পরিস্থিতি যেন আরও জটিল হচ্ছে।
নতুন করে দুই জেলায় সংঘাত শুরু হওয়ার পর পাহাড়ের পুরোনো আঞ্চলিক দল জেএসএস প্রথমে চুপচাপ ছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে পাহাড়ের রাজনীতিতে একটা নতুন মেরুকরণ হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে দীর্ঘদিনের বৈরিতা ভুলে জেএসএসের সঙ্গে তখন ইউপিডিএফের একটি গোপন সখ্য তৈরি হয়। গত বছরের মার্চে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে উপজেলা নির্বাচন ঘিরে নির্বাচনী গাড়িতে ব্রাশফায়ারে আটজন নিহত হয়। এ জন্য দায়ী করা হয় জেএসএস ও ইউপিডিএফকে।
দুই পার্বত্য জেলায় যখন রক্তপাত চলছিল, তখন তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল বান্দরবান। কিন্তু সাধারণ নির্বাচনের আগে থেকে সেখানে আবির্ভূত হয় ‘মগ পার্টি’ নামের একটি গোষ্ঠী। জেএসএসের আধিপত্যের মধ্যে মগ পার্টি সুবিধা করতে পারছিল না; মার খাচ্ছিল রাজস্থলীসহ বিভিন্ন স্থানে। একসময় মগ পার্টির শক্তি ক্ষয় হয়ে এলে আপাত শান্তির বাতাবরণ দেখা যায়। কিন্তু শান্তি স্থায়ী হয় না। জেএসএস-এম এন লারমা বান্দরবানে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। দলটির বান্দরবান জেলা কমিটি গঠন করা হয় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে বসে, ১৩ মার্চ। মে মাসে নতুন কমিটি দলবল নিয়ে বান্দরবান ঢোকে। তাদের সঙ্গে ছিল খাগড়াছড়ি থেকে আসা বেশ কিছু বহিরাগত। তারা বান্দরবান সদরের বাঘমারা বাজারে একটি কার্যালয়ও বানায়।
কিন্তু বনের রাজা বাঘ সেটা মেনে নেবে কেন? তার খাবারে ভাগ বসানো কিংবা আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে এমন শঙ্কা দেখা দেয় কারও কারও মনে। এ কারণেই বান্দরবানে প্রথম বড় ধরনের হত্যাকাণ্ডটি ঘটে বলে অনুমান করা হয়। জেলা সভাপতি রতন তঞ্চঙ্গ্যাসহ ছয়জনের মৃত্যুর জন্য দলটির সাধারণ সম্পাদক উবামং মারমা জেএসএসকে দায়ী করেছেন। তবে এটা অনেকের কাছে যেন হাতে ধরে বিপদ ডেকে আনার মতো।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মো. ইসলাম বেবী মনে করেন, জেএসএস-এম এন লারমা সক্রিয় হওয়া সন্তু লারমার জেএসএস মানতে পারেনি। এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি বান্দরবানে। এর মধ্য দিয়ে এখানে আঞ্চলিক দলগুলোর সংঘাত শুরু হলো। স্থানীয় আওয়ামী লীগ এর দায় নিতে রাজি নয়। সামনে কী হয় তা নিয়ে চিন্তিত এই নেতা এবং বান্দরবানের পাহাড়ি-বাঙালি সবাই। এই ক্ষত না শুকাতেই গত শনিবার রোয়াংছড়িতে গুলিতে এক নারীর প্রাণ যায়। এ জন্য জেএসএসেক দায়ী করা হয়।
জেএসএস-এম এন লারমা বান্দরবানে শুরুতেই বড় ধরনের হোঁচট খেল। তবে ঘটনার পর উবামং মারমা সংবাদমাধ্যমে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে দাবি করলেও চেহারায় তা স্পষ্ট ছিল না। শক্তির সামর্থ্য সময় বলে দেবে। তবে দুই পার্বত্য জেলার পর বান্দরবানেও যে পাহাড়ি দলগুলোর গৃহদাহের আগুন ছড়াল, তা এ ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। সেটা ছিল সুরের আগুন। এখানে আগুন ভ্রাতৃঘাতী সহিংসতার। সামনের দিনগুলোতে সহিংসতার আগুনের আঁচে আরও প্রাণ যাবে এমন আশঙ্কা তাঁদের।
রামায়ণের হনুমান ইচ্ছা করে নিজের লেজের আগুন লঙ্কার পাহাড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের নতুন নতুন এলাকায় এ আগুন ছড়ানোর দায় কে নেবে?
প্রণব বল: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক