‘কোনো মাই চান না সন্তানরে হাতছাড়া করতে। সন্তান অইল একজন মায়ের বুকের ধন। একেবারে উপায় না দেইক্কা, হাসপাতালের পাওনা শোধ দেওনের লইগাই পোলাডারে বেইচা দিছিলাম।’ অসহায়তার এ আর্তি ২৮ বছর বয়সী মা তামান্না আক্তারের। চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার হানিরপাড় গ্রামের মো. আলমের স্ত্রী তিনি। প্রসববেদনা নিয়ে সম্প্রতি ভর্তি হন ওই উপজেলার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। অস্ত্রোপচারে তাঁর ছেলেসন্তানের জন্ম হয়। হাসপাতালের ২৭ হাজার টাকার বিল হয়। কিন্তু সেই টাকা শোধ করতে না পারায় বাড়ি ফিরতে পারছিলেন না তিনি। হাসপাতালের পাওনা মেটাতে নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে এক নারীর কাছে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন তিনি। গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশিত হলে প্রশাসনের সহায়তায় নিজের সন্তানকে কোলে ফিরে পান এই মা।
তামান্নার এই সন্তান বিক্রির খবরে অনেকের সংবেদনশীল মনে হয়তো গভীর দাগ কেটেছে। অনেকে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে সন্তান বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা আমাদের দেশ যে অভিনব, তা কিন্তু নয়। গত ২০ জানুয়ারি প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে পিরোজপুরের এক দম্পতির সন্তান বিক্রির খবর প্রকাশিত হয়েছে। পরিমল ব্যাপারীর নিজের জমিজমা নেই, তাই থাকেন অন্যের ঘরে। টুকটাক ঘটকালি আর এর-ওর কাছে চেয়েচিন্তে যা টাকা পান, তা দিয়েই কষ্টেসৃষ্টে চলে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে সংসার। তাঁর ঘরে এসেছে নতুন অতিথি। কিন্তু তার মুখে খাবার তুলে দেবেন কীভাবে? অভাবের তাড়নায় ১৮ দিনের কন্যাশিশুকে বিক্রি করে দেন শহুরে এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে। মেয়েটাও ভালো থাকবে, বেশ কিছু নগদ টাকাও পাওয়া যাবে, এ–ই ছিল আশা। তবে যে পরিমাণ টাকা পাওয়ার কথা ছিল, তা তিনি পাননি। এক প্রতারক চক্র তাঁদের সন্তান বিক্রির সিংহভাগ টাকা নিয়ে যায়। একপর্যায়ে বিষয়টি জানাজানি হলে ওই শিশুকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরে শিশুটিকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেন আদালত। শিশুটির মা কাজল ব্যাপারী বলেন, ‘আমার স্বামী অভাবে থাকায় ও মেয়ের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে ধনী একটি পরিবারকে শিশুটিকে দত্তক দিয়েছিলাম। আমি তো মা। মায়ের মন সন্তানের জন্য ছটফট করে। সন্তানকে ফিরে পেয়ে আমি খুশি।’
সারোগেসি পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য সম্মতি ও সম্পর্কের প্রশ্নটি অনিবার্যভাবেই সামনে চলে আসে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ দুই প্রশ্নকে হাওয়া করে দিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার মানদণ্ডটাই এখানে একমাত্র বিবেচ্য হয়ে ওঠে। দারিদ্র্যকে এখানে নির্মমভাবে ব্যবহার করা হয়। শুধু নিঃসন্তান দম্পতিই নন, সন্তান জন্মদানে সক্ষম ধনী ও সেলিব্রিটিরা এ স্রোতে শামিল হন। শাহরুখ খান, প্রীতি জিনতাসহ সেলিব্রিটিরা মা-বাবা হয়েছেন। সেই খবর মহাধুমধামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সবচেয়ে পঠিত সংবাদের শীর্ষেও থেকেছে। অথচ সারোগেসি মা টিকে থাকার ভিত্তিই হচ্ছে সমাজে দারিদ্র্য টিকে থাকা। দারিদ্র্য নেই তো সারোগেসি নেই।
২.
সম্প্রতি সারোগেসি পদ্ধতিতে মা হয়েছেন বলিউড তারকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। জরায়ু ভাড়া নিয়ে এভাবে তাঁর মা হওয়া নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সন্তান ধারণে অক্ষম দম্পতির ক্ষেত্রে সারোগেসি পদ্ধতিতে মা হওয়াটা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের একটা বড় আশীর্বাদ। কিন্তু সামাজিক প্রেক্ষাপটে যখন এর প্রয়োগ হয়, তখন বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে চলে আসে।
ভারতকে বিশ্বের সারোগেসি হাব বলা হয়। একসময় বিশ্বের ধনী দেশগুলো থেকে দম্পতিরা ভারতের সারোগেসি ক্লিনিকগুলোয় আসতেন গরিব নারীদের জরায়ু ভাড়া নিয়ে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য। ভারতের নারী অধিকারকর্মীদের তীব্র বিরোধিতার মুখে বিদেশিদের জন্য এটা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতে সারোগেসি থেকে বছরে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার আয় হয়। ওই প্রতিবেদনে গর্ভ ভাড়া দিয়ে সন্তান জন্ম দেওয়া কয়েক নারীর জীবনের রূঢ় গল্প তুলে আনা হয়। কেরালার এক নারীর তিন সন্তান। দিনমজুর স্বামী। অভাব-অনটনের সংসার। শ্বশুরের চিকিৎসার খরচ মেটাতে পরিবারটি বেশ কিছু টাকা ঋণ করে ফেলে। সেই ঋণ শোধ করতে নিজের গর্ভ ভাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ জন্য তাঁদের সঙ্গে সারোগেসি ক্লিনিক থেকে চুক্তি করা হয়। কিন্তু কাদের ভ্রূণ তিনি গর্ভে ধারণ করছেন, তা কখনোই জানতে পারেননি। এমনকি সন্তান জন্মের পর তার মুখটাও তিনি একবারের জন্যও দেখতে পারেননি। অন্য আর তিন সন্তানের মতোই তাঁর একই মমত্ব রয়ে যায়। প্রতিবছর অদেখা সন্তানটির জন্মদিন উদ্যাপন করেন।
সারোগেসি পদ্ধতিতে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য সম্মতি ও সম্পর্কের প্রশ্নটি অনিবার্যভাবেই সামনে চলে আসে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ দুই প্রশ্নকে হাওয়া করে দিয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার মানদণ্ডটাই এখানে একমাত্র বিবেচ্য হয়ে ওঠে। দারিদ্র্যকে এখানে নির্মমভাবে ব্যবহার করা হয়। শুধু নিঃসন্তান দম্পতিই নন, সন্তান জন্মদানে সক্ষম ধনী ও সেলিব্রিটিরা এ স্রোতে শামিল হন। শাহরুখ খান, প্রীতি জিনতাসহ সেলিব্রিটিরা মা-বাবা হয়েছেন। সেই খবর মহাধুমধামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সবচেয়ে পঠিত সংবাদের শীর্ষেও থেকেছে। অথচ সারোগেসি মা টিকে থাকার ভিত্তিই হচ্ছে সমাজে দারিদ্র্য টিকে থাকা। দারিদ্র্য নেই তো সারোগেসি নেই।
৩.
তামান্না–কাজলের সন্তান বিক্রি আর সেলিব্রিটিদের অন্য মায়ের জরায়ু ভাড়া নিয়ে মা হওয়া—দুটো ঘটনায় দারিদ্র্য ও অসমতার সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম প্রকাশ। মা ও নবজাতকের সম্পর্ককে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রকৃতি সুশোভন সম্পর্ক বলে মনে করা হয়। সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতিতে এ সম্পর্ক সবচেয়ে পবিত্র বলে বিবেচিত। অথচ সেই সম্পর্ককে অর্থনৈতিক বাস্তবতা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। কারও অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই বলে তিনি সন্তান জন্ম দিতে পারবেন না কিংবা পারলেও হাসপাতালের বিল শোধ করতে গিয়ে নবজাতককে বেচে দিতে হবে। আবার কারও অর্থনৈতিক সামর্থ্য আছে বলেই সদ্যোজাত সন্তানকে মায়ের বুক থেকে টেনে নিজেদের কুক্ষিগত করতে হবে।
নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তানের আকাঙ্ক্ষাটাও স্বাভাবিক। কিন্তু অর্থনৈতিক সামর্থ্যের কারণে তাঁদের কেন মায়ের কোল খালি করে আনতে হবে! এস ও এস শিশুপল্লীর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে অভিভাবকহীন বা এতিম শিশুর সংখ্যা ৪৪ লাখ। তাদের মধ্যে ৬৫ দশমিক ৮০ শতাংশ শিশু মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভোগে। মৃত্যুহার প্রতি ১ হাজারে ৪১ দশমিক ১ শতাংশ। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে ৭৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বাল্যবিবাহ হয়ে যায় ৬৪ দশমিক ৯০ শতাংশের। অন্যদিকে ‘মেল ইনফার্টিলিটি ইন বাংলাদেশ: হোয়াট সার্ভ বেটার ফার্মাকোলোজিক্যাল হেল্প’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিঃসন্তান দম্পতির সংখ্যা ৩০ লাখের মতো।
দেশে অভিভাবকহীন শিশু ও নিঃসন্তান দম্পতিদের সংখ্যার যে অনুপাত, তাতে বিপুলসংখ্যক শিশুর আশ্রয় হতেই পারত এ পরিবারগুলো। কিন্তু এখানে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা এবং রাষ্ট্রীয় আইনের সীমাবদ্ধতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ ও রাষ্ট্র মানবিক হলে এ সংকট অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। তবে দারিদ্র্য কিংবা হাসপাতালের বিল শোধ করতে না পেরে সন্তান বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক কোনো সমাজের স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে নির্দেশ করে না। চুইয়ে পড়া অর্থনীতি থেকে চুইয়ে সমাজের প্রান্তিক অংশের কাছে যৎসামান্যও কি পৌঁছাতে পারছে, যাতে নবজাতক বিক্রি করে দেওয়ার মতো অসহায় বাস্তবতার সামনে মায়েদের আর পড়তে না হয়?
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক