খোলা চোখে

সেই প্রতিবাদ কই?

ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদে প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের বিক্ষোভ
ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদে প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের বিক্ষোভ

সাম্প্রতিক বাংলাদেশে একের পর এক এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে, কারও কারও ভাষায় যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এর মধ্যে একটি হলো হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত একটি ভাস্কর্যের অপসারণ। অন্যটি বিশিষ্ট নাগরিক অধিকারকর্মী সুলতানা কামালকে হত্যার হুমকি। অধ্যাপক আফসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা ও তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবিও এই তালিকায় পড়ে। এর বাইরেও রয়েছে সংখ্যালঘু ও উপজাতি নাগরিকদের ওপর হামলা।

প্রতিটি ঘটনারই প্রতিবাদ হয়েছে। পত্রিকায় বিবৃতি গেছে, ছোটখাটো প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কড়া কড়া কথার লেখা পড়েছি। বিবৃতি দেওয়া ও ফেসবুকে যা খুশি লেখা, এই হলো পৃথিবীর সহজতম কাজের দুটি। এই দুটি কাজে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা, সুশীল সমাজের সদস্যরা ও আরাম কেদারায় বসে রাজনীতি করতে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁদের দক্ষতা তর্কাতীত। একটা কিছু ঘটলেই হলো, সঙ্গে সঙ্গে বিবৃতি। প্রতিবাদের বিষয় যা-ই হোক, সেসব বিবৃতির ভাষা প্রায় একই রকম। কম্পিউটারের বদৌলতে আজকাল ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’ খুব জনপ্রিয় হয়েছে। ৩০ বছর আগে আমাকে একটি দৈনিকে সম্পাদকীয় লিখতে হতো। কোনো কোনো বিষয় ছিল, যা প্রতিবছরই ঘুরেফিরে আসে। তখন দেখেছি, ড্রয়ারের পুরোনো কপি খুঁজে, আগে-পিছে দু-চার শব্দ পরিবর্তন করে, সেই পুরোনো সম্পাদকীয়ই চালিয়ে দেওয়া হতো। আমাদের আজকের বিবৃতি কালচার তার থেকে খুব ভিন্ন কিছু নয়।

অনেক সময় এসব বিবৃতির পেছনে প্রকৃত কোনো প্রতিবাদের ইচ্ছা কাজ করে না, করতে হয় তাই করা। আমি উদাহরণ হিসেবে ভাস্কর্য অপসারণ প্রশ্নে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের একটি বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মেনন সাহেব শুধু একটি বাম ঘরানার রাজনৈতিক নেতাই নন, তিনি বর্তমান সরকারের একজন মন্ত্রীও বটে। ভাস্কর্য সরানোর দাবি তুলেছিল হেফাজতে ইসলাম, পরে প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, ওইখানে ভাস্কর্য স্থাপন তিনি পছন্দ করেননি। অধিকাংশ ভাষ্যকারই একমত, ভোটের রাজনীতি মাথায় রেখে বর্তমান সরকার হেফাজতের দাবিটি মেনে নিয়েছে। গত সপ্তাহে ঢাকায় রুশ বিপ্লবের ৭০তম বার্ষিকী উপলক্ষে এক সভায় মেনন সাহেব কঠোর ভাষায় ভাস্কর্য সরানোর এই কর্মটির সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি ছিল হেফাজতের দাবির কাছে ‘নির্লজ্জ নতিস্বীকার’। তিনি নিজ দলের কর্মীদের প্রতি নির্দেশ দেন, তাঁরা যেন এই ভাস্কর্য অপসারণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হন।

খুবই কড়া কথা, কিন্তু ঠিক কার বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানালেন মেনন সাহেব? যে নির্লজ্জ নতিস্বীকারের কথা তিনি বললেন, সেই নতিস্বীকারকারী ব্যক্তি বা সংস্থাটাই-বা কে? ভাস্কর্য অপসারণ তো সম্ভব হয়েছে বর্তমান সরকারের সম্মতিতে। তাহলে কি তিনি সেই সরকারের কথাই প্রকারান্তরে বলছেন, কিন্তু মুখ ফুটে সরকারের নামটি বলতে পারছেন না? কিন্তু তারপরও এ কথা আমাদের নজর এড়ায় না যে তিনি আপসকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। তাহলে কি তিনি নিজের সরকারের বিরুদ্ধেই সে ডাক দিলেন?

বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ধরি মাছ না ছুঁই পানি। মেনন সাহেব ও তাঁর মতো অন্য যাঁরা ভাস্কর্য অপসারণ প্রশ্নে বিবৃতি দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছেন, তাঁরা সবাই খুব সাফল্যের সঙ্গে হাতে পানির স্পর্শটি না লাগিয়ে দিব্যি মাছটি ধরে ফেলতে চাইছেন। জনাব মেনন যদি সত্যি সত্যি ভাস্কর্য অপসারণের সিদ্ধান্তকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে ভাবতেন, তাহলে তিনি শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ বলে ভাবতেন না।

নিজেদের বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষের শক্তি’ নাম দিয়ে ৪৩ জন ব্যক্তির আরেকটি বিবৃতিও আমাদের নজরে এসেছে। ভাস্কর্য অপসারণ প্রশ্নে সুলতানা কামালের বক্তব্যের প্রতিবাদে হেফাজত তাঁর বহিষ্কার ও গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়েছে। এই ৪৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক, যাঁরা আদতে নামকরা বুদ্ধিজীবী অথবা সুশীল সমাজের নেতা, তাঁরা খুব কঠোর ভাষায় এই হুমকির প্রতিবাদ করেছেন। মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আক্রান্ত হচ্ছে, সেই কারণে তাঁরা এসব শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা এসব সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনি প্রক্রিয়া শুরুরও দাবি জানিয়েছেন। অনুমান করি, এই আইনি প্রক্রিয়া শুরুর দাবিটি বর্তমান সরকারের প্রতি নির্দেশিত। এ কথার অর্থ বুদ্ধিজীবীরা আশা করছেন, বর্তমান সরকার, যাদের সমর্থনে ভাস্কর্যটি সরানো হলো এবং হেফাজতের সঙ্গে যাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তারা হেফাজতের হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবে। এই বুদ্ধিজীবীরা সবাই অতি সম্মানীয়, অতি প্রজ্ঞাবান। কিন্তু শিয়ালের কাছে মুরগি রাখতে দিলে তার কী ফল, সে কথা তো তাঁদের অজ্ঞাত থাকার কথা নয়। তাহলে এই বিবৃতি কি আসলে কোনো প্রতিবাদ, নাকি প্রতিবাদের একটা ভানমাত্র?

লক্ষ করবেন, যাঁরা এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন তাঁদের কেউ কেউ সরাসরি অথবা অলক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে যুক্ত। অনেকেই সরকারের কাছ থেকে সর্বোচ্চ খেতাব পেয়েছেন। তাঁদের প্রতিবাদ অনেক বেশি অর্থপূর্ণ হতো যদি তাঁরা প্রতিবাদ হিসেবে সে খেতাব ফিরিয়ে দিতেন, বলতেন যে সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী শক্তির সঙ্গে আপস করে, তাদের কাছ থেকে পুরস্কৃত হতে চান না তাঁরা। কিন্তু এই কাজটি করলে যে সরকারের কাছ থেকে তাঁরা মাঝেমধ্যে মুলোটা-কলাটা পেয়ে থাকেন, তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হবে। সর্বনাশ, তাহলে যে কলা-মুলো দুটোই যাবে!

তুলনা হিসেবে ভারতের বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহের কাছে মোদি সরকার যেভাবে ‘নির্লজ্জ নতিস্বীকার’ করেছে, তার প্রতিবাদে কী করেছেন তার উদাহরণটি বিবেচনায় আনুন। ভারতে সব আইনি ব্যবস্থার প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ একদিকে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়েছে, অন্যদিকে মুক্তিচিন্তার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তারা তাদের দৃষ্টিতে বিতর্কিত গ্রন্থ প্রকাশ ও প্রদর্শনীর অপরাধে বইয়ের দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে, কোনো কোনো মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন লেখকের ওপর সরাসরি হামলাও করেছে। এর কোনোটাই সরকারের সমর্থন বা সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব হতো না, এই অভিযোগে অর্ধশতাধিক লেখক-শিল্পী তাঁদের সরকারি পুরস্কার ও খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের একজন হলেন লেখিকা নয়নতারা সেহগাল। পণ্ডিত নেহরুর ভাগনি, প্রায় ৯০ বছরের এই লেখিকা বলেছেন, মুক্তবুদ্ধির ওপর এমন অনায়াস আক্রমণের মুখে তিনি চুপ করে থাকতে পারেন না। বাঙালি কবি মন্দ্রাকান্তা সেনও তাঁর সরকারি খেতাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেছেন, একজনের ওপর এই আক্রমণ আসলে আমাদের সবার ওপর আক্রমণ।

ক্ষমতাসীনদের অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সবার আগে ওঠে বুদ্ধিজীবীদের ভেতর। তাঁরাই আলোর পথটা দেখান। আমেরিকায় মার্কিন সমরনীতির প্রতিবাদ জানিয়ে লেখক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিকদের কঠোর নৈতিক অবস্থানের কথা সুবিদিত। বসনিয়ায় বিল ক্লিনটন সরকারের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে স্টেট ডিপার্টমেন্টের একাধিক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছেন। ইরাক যুদ্ধের প্রতিবাদে গ্রেপ্তার হবেন জেনেও সেনাবাহিনী ত্যাগ করেছেন অনেক কর্মকর্তা ও সৈনিক। ওবামা আমলে আফগানিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলার প্রতিবাদে সেনাবাহিনীর ধর্মযাজকের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন একজন সেনাসদস্য।

এমন নয় যে নয়নতারা সেহগাল অথবা মন্দ্রাকান্তা সেন তাঁদের খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে ভারতে সাম্প্রদায়িকতা হ্রাস পেয়েছে। ক্রিস্টোফার জন আন্তাল ধর্মযাজকের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন বলে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলা বন্ধ হয়েছে, তাও নয়। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করি কী করে যে, যাঁরা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ অগ্রাহ্য করে বৃহত্তর নৈতিক দায়িত্ব মাথায় নিয়ে এভাবে প্রতিবাদে অংশ নেন, তাঁদের কারও প্রতিবাদই লোক দেখানো ব্যাপার নয়। নিজে কিছু হারাতে পারেন, সে কথা জেনেই তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, কেউ কেউ সে জন্য কড়া মূল্য দিতেও বাধ্য হয়েছেন। তাঁদের এই প্রতিবাদ আমাদের উদ্বুদ্ধ করে, আমরা নড়েচড়ে বসি।

দেশ হিসেবে, জাতি হিসেবে আমরা এক কঠিন দুঃসময়ের মুখোমুখি। শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নয়, আধুনিক নাগরিক সমাজের সদস্য হিসেবে যেসব মূল্যবোধ আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, তার অনেক কিছুই এখন হুমকির সম্মুখীন। দেশের সবচেয়ে অগ্রসর বলে যাঁদের আমরা বিবেচনা করি, তাঁদের মধ্যে শুধু বুদ্ধিজীবী নন, সুশীল সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও রয়েছেন। তাঁদের সবার আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ানোর এখনই সময়। তাঁরা আলো হাতে আঁধারে পথ দেখাবেন, সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি