রাখাইন প্রদেশে হামলা

সু চির প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে

ঘর ছেড়ে যাচ্ছেন মংডুর লোকজন
ঘর ছেড়ে যাচ্ছেন মংডুর লোকজন

আবারও রক্ত ঝরল মিয়ানমারে। ৯ অক্টোবর পাঁচ শতাধিক মানুষ মিয়ানমারের বাংলাদেশ–ঘেঁষা উত্তর-পশ্চিম মংডু ও বুথিডং শহরে পুলিশের তিনটি তল্লাশিচৌকিতে যে হামলা করল, তাতে নয়জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। হামলাকারীরা মূলত ছুরি ও গুলতি-জাতীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। হামলাকারীরা ৫০টি বন্দুক ও ১০ হাজারটি গুলি নিয়ে পালিয়েছে। সরকারি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। হামলার পর এসব গোষ্ঠীর সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়েছে।
স্থানীয় ও সরকারি সূত্রে জানা গেছে, মুসলমান নাগরিকেরা এই হামলা চালিয়েছে। একটি অপরীক্ষিত ভিডিও ফুটেজ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে মনে হচ্ছে, এটি ওই হামলারই ফুটেজ। এতে দেখা যায়, একদল মানুষ বলছে, ‘দুনিয়ার সব রোহিঙ্গা জিহাদের জন্য প্রস্তুত হও, জিহাদে যোগ দাও’। এখন কথা হচ্ছে, হামলা চালানোর জন্য তো ওই এলাকা সম্পর্কে জানা থাকা দরকার, আবার অনেক মানুষকে জড়োও করতে হয়। ফলে মনে হচ্ছে, স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন এতে অংশ নিয়েছে। সম্ভবত এর পেছনে বাইরের সমর্থনও রয়েছে। তবে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ কারা এই হামলা চালিয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
এই হামলার মধ্য দিয়ে রাখাইন প্রদেশে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে গেল। হামলায় যে পরিমাণ মানুষ অংশ নিয়েছে এবং যে কৌশলে হামলাটি চালানো হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, এটা খুবই পরিকল্পিত হামলা ছিল। এটা বলার কারণ হচ্ছে, এত দিনের এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতে মুসলমানদের কখনো পরিকল্পিতভাবে সহিংস প্রতিরোধ করতে দেখা যায়নি।

এই হামলাকারীদের মধ্যে অনেকেই যে রোহিঙ্গা, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে। রাখাইন প্রদেশের ৯০ শতাংশ মানুষই রোহিঙ্গা। কিন্তু তারা কীভাবে সংগঠিত হলো, তা পরিষ্কার নয়। রাখাইন প্রদেশের ১৩ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ মিয়ানমারে কার্যত রাষ্ট্রবিহীন অবস্থায় বসবাস করছে। বহু বছর ধরে বৌদ্ধদের সঙ্গে তাদের যে উত্তেজনা চলছিল, তার বিস্ফোরণ ঘটে ২০১২ সালে। তখন দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়। আর প্রায় দেড় লাখ মানুষ নোংরা আশ্রয়শিবিরে চলে যেতে বাধ্য হয়, যেখানে তারা এখনো পচে মরছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে ক্রমেই হতাশা বাড়ছে। তারা মনে করছে, কিছুই হচ্ছে না, কোনো পরিবর্তন আসছে না। যদিও মিয়ানমারে নেতা অং সান সু চি সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিশন রাখাইন প্রদেশের এই সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করবে।

আমরা জানি, বহু বছর ধরেই রোহিঙ্গাদের সংগঠিত সশস্ত্র শক্তি নেই। স্থানীয় সরকারের কিছু কর্মকর্তা অবশ্য বলছেন, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন এই হামলার জন্য দায়ী। জানা মতে, সেই নব্বইয়ের দশক থেকে এই গোষ্ঠীটি সক্রিয় নয়, যদিও রাখাইনের জাতীয়তাবাদী মানুষ, সরকারি কর্মকর্তা ও কখনো কখনো বাংলাদেশ এ ধরনের ঘটনার জন্য এদের দায়ী করেছে।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে মিয়ানমারের মংডু শহরের সীমান্তরক্ষী পুলিশচৌকিতে মারাত্মক হামলা হয়েছে। এরপর যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। এতে একজন বাংলাদেশি সীমান্তরক্ষী নিহত হন। ২০১৬ সালের মে মাসে বাংলাদেশের দক্ষিণের একটি জেলায় ৩৫ জন সশস্ত্র হামলাকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরের এই নিরাপত্তাচৌকিতে হামলা চালিয়ে একজন কমান্ডারকে হত্যা করে ১১টি অস্ত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। অভিযোগ আছে, এই হামলার নেতৃত্বে ছিলেন একজন পাকিস্তানি নাগরিক, যাঁর সঙ্গে কথিত বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা নাগরিকেরাও ছিলেন। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনকেও অভিযুক্ত করা হয়।

কিন্তু এসব অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ না থাকায় কোনো সংগঠনের পরিচিতি সম্পর্কে নতুন করে দাবি উঠলে তা খতিয়ে দেখতে হবে, যতক্ষণ না তাদের সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া যায়। এখন কথা হচ্ছে, এই হামলা কে বা কারা করেছে, সেটা বড় কথা নয়। বিষয়টা হচ্ছে, এর ফলে রাখাইন প্রদেশের রাজনৈতিক, মানবাধিকার ও মানবিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসবে। এটা যেমন স্বল্পমেয়াদি হবে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদিও। ৯ অক্টোবরের হামলার পরই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ওই এলাকায় বড় ধরনের অভিযান চালিয়েছে। তারা হামলাকারীদের ধরতে এবং লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে ওই এলাকা ঘেরাও করে তল্লাশি চালিয়েছে। এই অভিযানে অনেক মানুষ মারা গেছে।

নিকট ভবিষ্যতে উত্তর রাখাইন প্রদেশে এ ধরনের হামলা ঠেকাতে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান আরও জোরদার হবে। ইতিহাসে দেখা যায়, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী মুসলমানদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেনি। ফলে আশঙ্কা আছে, তারা সেখানে থাকলে উত্তেজনা আরও বাড়বে এবং স্থানীয় মানুষ নিগৃহীত হবে, যেটা তাদের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাদের মৌলিক অধিকার সংকুচিত হবে। শিগগিরই এ পরিস্থিতির উত্তরণের সম্ভাবনা নেই। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, রাখাইন প্রদেশে এসব সমস্যার সমাধান বের করা ও কফি আনানের কমিশনের পক্ষে কাজ করা খুবই কঠিন হয়ে উঠবে।

মিয়ানমারে ইসলাম ও ইসলামি চরমপন্থীদের ব্যাপারে এমনিতেই ভীতি রয়েছে, ৯ অক্টোবরের এই হামলার কারণে তা আরও বেড়ে যাবে। দেশটির অতি জাতীয়তাবাদী ভিক্ষু ইউ উরাথু ইতিমধ্যে সামাজিক মাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছেন, নিরাপত্তা বাহিনী যেন ‘দেশ ও নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য’ সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়। নির্বাচনের পর চরমপন্থী বৌদ্ধ সংগঠনগুলো একটু বেকায়দায় ছিল। এই সুযোগে তারা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। মিয়ানমারের অন্য যেসব প্রদেশে মুসলমান জনসংখ্যা বেশি, সেখানে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে শুধু মিয়ানমারেই নয়, অন্যান্য দেশেও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে পারে। সেটা হলে মধ্যপন্থী মানুষদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

অং সান সু চি তো মিয়ানমারকে সহিষ্ণু রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করছিলেন, এসব কারণে তাঁর সেই প্রচেষ্টা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জর মুখে পড়বে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, ক্রাইসিস গ্রুপ ডট অর্গ থেকে নেওয়া।

রিচার্ড হোরসে: ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার-বিষয়ক পরামর্শক।