>জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি ও টাকা ভাগাভাগির অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেখানে আন্দোলন করছেন। তাঁরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করছেন। অন্যদিকে প্রশাসনের দাবি, কোনো দুর্নীতি হয়নি। বিষয়টি শিক্ষকেরা কীভাবে দেখছেন, এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক বশির আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মাইদুল ইসলাম।
প্রথম আলো: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক হলো কেন?
বশির আহমেদ: অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ২০১৪ সালে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৫ সালেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সমস্যার বিষয়টি সরকারের কাছে তুলে ধরেন। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও ৫ থেকে ৬ হাজার ছেলেমেয়েকে হলের বাইরে থাকতে হয়। অনুষদ ভবনও প্রয়োজনের তুলনায় কম, লাইব্রেরি অসম্পূর্ণ, শিক্ষার্থীদের স্পোর্টস কমপ্লেক্স নেই। অডিটরিয়াম ব্যবহারের অযোগ্য। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বাসস্থান নেই। প্রভোস্টদের আবাসিক ব্যবস্থা নেই। এ রকম মিলিয়ে ২৩ ধরনের স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়। পরে সেটি মাস্টারপ্ল্যানে রূপ নেয় এবং ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর একনেকের বৈঠকে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন পায়।
প্রথম আলো: কিন্তু আপনারা অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করলেন না কেন?
বশির আহমেদ: গত জুনে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট কক্ষে একটা বৈঠক আহ্বান করি। সেখানে শিক্ষার্থীরা কিছু অসংগতির কথা তুলে ধরেন। তাঁরা জানতে চাইলেন, মাস্টারপ্ল্যানের যেসব পূর্বশর্ত, সেগুলো মানা হয়েছে কি না, ডিটেইল সুয়ারেজ আছে কি না, রাস্তা আছে কি না ইত্যাদি। শিক্ষার্থীরা বললেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ঘিরে তিনটা আবাসিক হল হলে দমবন্ধ অবস্থা তৈরি হবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হবে। পরে তাঁদের দাবি মেনে এই তিনটি হলের জায়গাও পরিবর্তন করা হলো।
প্রথম আলো: ১২ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে তিনটি দাবি পেশ করা হয়। আপনারা প্রথম দুটি মানলেও তৃতীয়টি মানলেন না কেন?
বশির আহমেদ: তাঁদের তৃতীয় দাবি ছিল, উপাচার্যের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ, তার তদন্ত তাঁকেই করতে হবে। উপাচার্য বললেন, যেহেতু অভিযোগটা তাঁর বিরুদ্ধে, সেহেতু তিনি তদন্ত করতে পারেন না। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত চাইতে পারেন কি না, সে বিষয়ে আইনজ্ঞের পরামর্শ নেওয়ার জন্য সময় নিলেন।
প্রথম আলো: ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যে উন্নয়নকাজের ‘ফেয়ার শেয়ার’ চাইতে উপাচার্যের কাছে গিয়েছিলেন, সেটি গোপন নয়। তাঁরা বলেছেন, ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর শাখা টাকা পেয়েছে, তাঁরা পাবেন না কেন?
বশির আহমেদ: এখানে ছাত্রলীগের মধ্যে তিনটি গ্রুপ আছে। সভাপতির একটি, সাধারণ সম্পাদকের একটি এবং এর বাইরে তৃতীয় গ্রুপ। আমার ধারণা, নিয়ন্ত্রক শক্তি, যারা অনেক সময় এ ধরনের বড় প্রকল্প থেকে (অর্থ) নেয়, নানাভাবে নেওয়ার চেষ্টা করে। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ঈদের আগে তাঁর বাসায় এসেছিলেন, তাঁরা এই বিষয়ে কিছু কথা হয়তো বলেছেন। অন্যদিকে উপাচার্য বলেছেন, ৪ বা ৬ শতাংশ তাঁদের দিলে কাজ হবে কী করে?
প্রথম আলো: অভিযোগটা এসেছে, ওই কমিশন–বাণিজ্যের সঙ্গে উপাচার্য ও তাঁর পরিবার জড়িত।
বশির আহমেদ: আমরা যেভাবে উপাচার্যকে জানি, তিনি খুবই পরিশীলিত মানুষ। তাঁর ব্যক্তিগত সততা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা সন্দেহের ঊর্ধ্বে। তাঁর যে পারিবারিক ঐতিহ্য, তাতে এ ধরনের লেনদেনে সংশ্লিষ্ট থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তাঁর স্বামী একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং পিএইচডি করেছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, কেউ বড় হতে হলে তাঁর পেছনে পরিবারের অনেক ত্যাগ থাকে। আমি উপাচার্যের পরিবারকে সেভাবেই দেখি।
প্রথম আলো: কিন্তু ছাত্রলীগের নেতারা তো দাবি করেছেন, টাকা ভাগাভাগি হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, আমরা টাকা নিয়েছি এবং সেখানে উপাচার্যের ছেলে ও স্বামী উপস্থিত ছিলেন।
বশির আহমেদ: রাব্বানীর সঙ্গে যে ফোনালাপ, সেটা বানানো। এটা হচ্ছে ১৩ তারিখের ঘটনা। যে ছেলের মুঠোফোন থেকে এটা গেছে, তাঁর সঙ্গে আমাদের প্রক্টরের কথা হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, তুমি কবে এটা করেছ? তাঁর কথায় স্পষ্ট, শোভন ও রাব্বানী যখন নিশ্চিত হয়েছেন যে তাঁরা কমিটিতে থাকছেন না, তখন এই কথোপকথন ছেড়েছেন। এটা উপাচার্যের সততা, ব্যক্তিত্ব, ভাবমূর্তি—সবকিছুকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র। উপাচার্য নিজে এটার সঙ্গে জড়িত নন, তাঁর পরিবারও না।
প্রথম আলো: দুর্নীতি হয়েছে, উপাচার্যের পরিবার যুক্ত থাকুক বা না থাকুক। যাঁদের সন্তুষ্ট করে কাজ করতে হবে বলে ঠিকাদার মনে করেছেন, তাঁদের টাকা দিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে আপনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কি মনে করেন যে তাঁদেরকাজ করতে দেওয়া উচিত?
বশির আহমেদ: আমি যেটা বলব, কারা টাকা দিয়েছে, তাদের তো আমরা চিনি না। কে টাকা পেয়েছে, সেগুলোও আমরা জানি না। সেগুলো বিভিন্নভাবে এসেছে, সাজানো হোক বা কাউকে বিপদে ফেলার জন্য হোক। সেটা তদন্তের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসবে। মাননীয় উপাচার্য বারবারই বলছেন, যদি কোনো অবৈধ লেনদেন হয়ে থাকে, সেটা তদন্তের মধ্য দিয়ে যাতে বের হয়ে আসে।
প্রথম আলো: আন্দোলনকারীরাও তো তদন্তের দাবি করেছেন।
বশির আহমেদ: উপাচার্যও তদন্তের পক্ষে। আমরাও তদন্ত চাইছি। তদন্তের আগে তো আপনি কাউকে শাস্তি দিতে পারেন না। তবে বিষয়টা হচ্ছে, কে তদন্তটা করতে পারে। তাঁরা দাবি করেছেন বিচার বিভাগীয় তদন্ত। এটা তো উপাচার্য করতে পারেন না। ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আচার্য বা দুদক—যে–ই এই তদন্ত করবে, আমরা তাকেই সহযোগিতা করব।
প্রথম আলো: আন্দোলনকারীদের যে তালিকা দেখালেন, তার মধ্যে তো বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের অন্য গ্রুপ। এই দ্বন্দ্ব কেন?
বশির আহমেদ: এই দ্বন্দ্ব আগে ছিল না। প্রথম মেয়াদে যখন ফারজানা ইসলাম উপাচার্য হলেন, সবাই একসঙ্গে ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি যাতে উপাচার্য না হতে পারেন, সে জন্য শরীফ এনামুল কবিরের সমর্থকেরা চেষ্টা চালাতে থাকেন। এটা ব্যক্তিগত ঈর্ষা থেকে। এতে ডান–বাম–বিএনপি–আওয়ামী লীগের একাংশ—সব এক হয়েছে। আন্দোলন করার জন্য ছাত্রদের আবেগকে কাজে লাগানো হয়েছে।
প্রথম আলো: অডিও ফাঁস হওয়ার পরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহ–উপাচার্যসহ আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষকের মুঠোফোনের সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বশির আহমেদ: আমরা শুনেছি, যাঁরা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কয়েকজনের ফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এটা করার ক্ষমতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। এখানে জ্ঞানের শক্তি ছাড়া আমাদের কোনো বাহিনীও নেই, পুলিশও নেই।
প্রথম আলো: এর প্রতিবাদে সহ-উপাচার্য আমির হোসেন তো সেদিনের মিটিংয়েও আসেননি?
বশির আহমেদ: তাঁর সম্পর্কে যদি একটু বলি, অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির, আমির হোসেনসহ আমরা সবাই একটা গ্রুপেই ছিলাম। কিন্তু উপাচার্য দ্বিতীয় মেয়াদে আসার পর থেকে শরীফ এনামুল কবির আলাদা গ্রুপ করেন। আমির হোসেন ওই গ্রুপে আছেন। তিনি (আমির হোসেন) এখন সিনিয়র আছেন। কোনো রদবদল হলে তিনি উপাচার্য হবেন, এ ধরনের স্বপ্ন তাঁর আছে।
প্রথম আলো: ধন্যবাদ আপনাকে।
বশির আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন:
উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে