দিল্লির চিঠি

সুষমার ললিত-সংকট

নরেন্দ্র মোদি, সুষমা স্বরাজ, ললিত মোদি
নরেন্দ্র মোদি,   সুষমা স্বরাজ,  ললিত মোদি

বছর ঘুরতে না ঘুরতে নিছক এক ‘মানবিক কারণ’ যে তাঁর সরকারে সংকট সৃষ্টি করবে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি হয়তো তা কল্পনাও করেননি। অবশ্য শুধু সংকট বললে সব বলা হবে না, বলতে হবে সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে আসা এটাই মোদির প্রথম রাজনৈতিক সংকট।
এবং ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস, মোদির সংকটের মূলেও রয়েছেন আর এক মোদি। ললিত মোদি।
রাজনৈতিক এই সংকটের কাটাছেঁড়া করার আগে দ্বিতীয় মোদি সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলে নেওয়া যাক। ললিত মোদি এক প্রখর বুদ্ধির মানুষ। যে আইপিএল নিয়ে আজ কয়েক বছর ধরে গোটা বিশ্ব উত্তাল, ললিতই তার মস্তিষ্ক। তবে সেই মস্তিষ্ককে তিনি অন্যভাবে ব্যবহার করে প্রভূত অনৈতিক সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন বলে অভিযোগ। এসব অভিযোগ ক্রমশ এতটাই জোরালো হয়ে ওঠে যে আইপিএল কমিশনারের পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে দেদার অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ ওঠে। ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের অধীনে থাকা সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। প্রবল বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে গ্রেপ্তারি এড়াতে শেষ পর্যন্ত তিনি বিলেতে আশ্রয় নেন। ভারত সরকার তাঁর পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়। শেষ পর্যন্ত মামলা করে বাতিল হওয়া পাসপোর্ট ফিরে পেলেও ভারত সরকার মোদিকে বাগে আনতে পারেনি। বরং ফের তিনি খবরের শিরোনামে। শুধু তা-ই নয়, বিলেতে বসে ললিত হুংকার ছেড়েছেন, ভারতের যেসব মিডিয়া এই বিতর্কে তাঁর পেছনে হাত ধুয়ে লেগেছে, তাদের সবাইকেই তিনি আইনি প্যাঁচে জড়িয়ে ঘোল খাইয়ে ছাড়বেন।
বিতর্কটা কী, এত দিনে তা-ও মোটামুটি সবার জানা। ললিত পর্তুগাল যেতে চাইছিলেন স্ত্রীর ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য। ভিসা পেতে তিনি ধরেন যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাংসদ কিথ ভাজকে। কিথ খুবই প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয়। ললিত যাতে ভিসা পান, সে জন্য তিনি ধরেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে। অনুরোধ, ললিতের জন্য যুক্তরাজ্য সরকারকে তিনি যেন একটু বলে দেন। সেই অনুযায়ী যুক্তরাজ্যকে সুষমা বলেন, ললিতকে ভিসা দেওয়ার বিষয়টি ব্রিটিশ সরকার যেন তাঁদের আইন অনুযায়ী বিবেচনা করে দেখে। সেই সঙ্গে সুষমার বাড়তি সংযোজন, ললিতকে ভিসা দেওয়া হলে ভারত ও যুক্তরাজ্যের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব পড়বে না। সুষমার বার্তার পরদিনই ললিত ভিসা পান। শুধু পর্তুগাল নয়, দেখা যায় ললিত আরও কয়েকটা দেশে গিয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে ফুর্তি করে চমৎকার সময় কাটিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি যেসব ছবি পোস্ট করেছেন, যাতে তাঁর স্ত্রী ও শ্যালিকাদের ছবিও রয়েছে, সেগুলো দেখলে অবশ্য মনে হয় না তাঁর স্ত্রী ক্যানসারের রোগী এবং চিকিৎসার সময় স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য তিনি যারপরনাই উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন।
খবরটা প্রথম ছাপা হয় বিলেতের এক বিখ্যাত কাগজে। খবরের সূত্র কিথ ভাজের ই-মেইল চালাচালি। দেখা গেল, ললিতের হয়ে সুষমার অনুরোধের জন্য কিথ ভাজ ধন্যবাদ জানাচ্ছেন সুষমার আইনজীবী স্বামী স্বরাজ কৌশলকে। বিতর্ক বড় হয়ে ওঠে। খুব সংগত কারণেই প্রশ্ন তোলা হয়, যাঁকে হাতে পেতে ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রক হাপিত্যেশ করে বসে আছে, যিনি দেশে ফিরে নিজেকে তদন্তের মুখে দাঁড় করাতে রাজি নন, তাঁর জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন উমেদারি করবেন? কেন তিনি সেই অনুরোধ করার আগে অর্থ মন্ত্রকের সঙ্গে পরামর্শ করবেন না? কী স্বার্থ রয়েছে সুষমার?
স্বার্থের কথাটাই বিরোধীরা বড় করে তুলে ধরছে। ধরবেও। কারণ, স্বরাজ কৌশলের সঙ্গে ললিতের বন্ধুত্ব গত বাইশ বছরের। এই সম্পর্কে কোনো লুকোছাপা নেই। স্বরাজ-সুষমার কন্যা বাঁশরি আইন পাস করে সাত বছর ধরে ললিতের হয়ে মামলা লড়ছেন। অর্থাৎ, বাঁশরির মক্কেল ললিত। এই ঘনিষ্ঠতার দরুন ললিতের হয়ে কথা বলতে সুষমার আটকায়নি। কিন্তু রাহুল গান্ধীর প্রশ্ন ও যুক্তিও তো ফেলে দেওয়ার মতো নয়? নরেন্দ্র মোদিকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে কংগ্রেসের সহসভাপতি বলেছেন, গোটা ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন মদদ ছিল। এই সরকার, এই দেশ চালাচ্ছেন একজনই। নরেন্দ্র মোদি। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত মোদিকে না জানিয়ে সুষমা নিতেই পারেন না। তাহলে কেন সুষমা স্বরাজের ইস্তফা দাবি? প্রধানমন্ত্রীর উচিত সুষমাকে ছেঁটে ফেলা। অথচ তা না করে এক মোদি অন্য মোদিকে আড়াল করছেন। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বিস্ময় প্রকাশ করে জানতে চেয়েছেন, একজন লোক পালিয়ে বেড়াচ্ছে। লোকটা অপরাধী। তার বিরুদ্ধে কয়েক শ কোটি টাকা পাচারের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এমন লোককে যদি ‘মানবিক কারণে’ ভিসা দেওয়ার অনুরোধ করা হয়, তাহলে সন্ত্রাসীরাও তো মানবিক কারণ দেখাতে পারে? কংগ্রেস, দুই কমিউনিস্ট পার্টি, জনতা দল (সংযুক্ত), রাষ্ট্রীয় জনতা দল এ বিষয়ে খড়্গহস্ত। কংগ্রেস তো সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ দাবি করে বলেছে, ললিত মোদির পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার মামলায় সরকার আদৌ বিরোধিতা করেনি। কেন? কারা দায়ী? নিরপেক্ষ তদন্তেই একমাত্র তা প্রকাশ পাবে। তাদের কটাক্ষ, যে সরকার কালোটাকার অপরাধীকে আড়াল করছে, তাদের মুখে কালোটাকা ফেরানোর দাবি হাস্যকর।
মজার বিষয়, সব বিরোধী দল কিন্তু সুষমার বিরুদ্ধে রে রে করে মাঠে নামেনি। বরং সুষমার ‘মানবিক কারণ’ যুক্তিকে সমর্থন করে কেউ কেউ পাশে দাঁড়িয়েছে। যেমন, সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টি—এ দুই দল সুষমার আচরণে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো কিছু দেখছে না। তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভার সাংসদ সৌগত রায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করেও পিছিয়ে গেছেন। দলনেত্রীর নির্দেশে তাঁদের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়ান মার্কিন মুলুক থেকে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, সৌগত যা বলেছেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত মত। দলের নয়। কারণ, দল বিষয়টি এখনো ভাবনাচিন্তা করেনি। দক্ষিণের দলগুলোরও মুখে কুলুপ। ফলে মূলত কংগ্রেস ও বামদের মোকাবিলা করা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সহজতর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এটা ঠিকই যে সুষমা স্বরাজ কখনোই নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ ছিলেন না। বরং মোদিকে প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার করা নিয়ে দলে যখন বিতর্ক হচ্ছিল, সুষমা তখন তার ঘোরতর বিরোধিতা করে লালকৃষ্ণ আদভানির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকি, সরকার গড়ার পর মোদি যে কোর টিম তৈরি করেন, সেখানেও সুষমার স্থান হয়নি। মোদি-অমিত শাহ-অরুণ জেটলির ত্রিভুজের বাইরেই সুষমা থেকে গেছেন আজও। পররাষ্ট্র মন্ত্রকের দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হলেও কোনো বিষয়েই সুষমাকে সেই অর্থে সামান্যতম ‘ফ্রি হ্যান্ড’ মোদি দেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সুষমাকে উপেক্ষা করার উপায় মোদির নেই। এর একটি কারণ যদি হয় সুষমার প্রশাসনিক দক্ষতা, সর্বস্তরে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এবং সংঘ পরিবারের সান্নিধ্য; অন্য কারণটি তাহলে তাঁর তুখোর বাগ্মিতা ও ভাবমূর্তি। সাংসদ হিসেবে তিনি কতটা তুখোড়, লোকসভার বিরোধী নেত্রী হিসেবে সুষমা তার উদাহরণ যেমন বারবার রেখেছেন, তেমনই এক বছর ধরে বিভিন্ন সংসদীয় বিতর্কে বিরোধী যুক্তি খণ্ডন করে গেছেন। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি যে ধরনের মূল্যবোধের কথা বলে থাকে, সুষমার মধ্যে সেসবের বাহ্যিক প্রতিফলন দেখা যায়। সাজে-পোশাকে-আচরণে তিনি প্রকৃত ভারতীয় নারীর প্রতিভূ। মোদি জানেন, রাজনৈতিক দিক থেকে সুষমা তাঁর বিরোধিতা করলেও এই সংকট ও সন্ধিক্ষণে নিজের মন্ত্রীকে আড়াল করতেই হবে। সুষমার সঙ্গে কথা বলে মোদি তাই সেই সিদ্ধান্তই নিয়েছেন, যা তাঁর চরিত্রের সঙ্গে মানানসই।
একেবারে শুরু থেকেই মোদি তাঁর অভ্যন্তরীণ ডাকাবুকো চরিত্র জাহির করে গেছেন। তিরিশ বছর পর একার ক্ষমতায় দিল্লি দখল, কারও সাহায্য ছাড়াই সরকার গঠন তাঁর মধ্যে যে আস্থা ও বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, ওই ডাকাবুকো চরিত্র, ওই ডোন্ট কেয়ার ভাব তার সঙ্গে মানানসই। ফলে সরকারের শুরুতেই তিনি পছন্দের আমলাকে নিয়োগ করতে অর্ডিন্যান্স জারি করেছিলেন। বিদেশ ভ্রমণের সময় সাংবাদিক নিয়ে যাওয়ার চিরকালীন প্রথাও বাতিল করে দিয়েছেন। প্রথম বছরে কোনো কোনো দলীয় সদস্যের আলটপকা মন্তব্যে সামাজিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। সাধ্বী নিরঞ্জন বা গিরিরাজ সিংয়ের কথাবার্তা শালীনতার সীমা টপকালেও মোদি তাঁদের ইস্তফা দিতে বলেননি। লাভ জিহাদ কিংবা ঘর ওয়াপসির মতো অর্বাচীন পরিকল্পনা অশান্তি ডাকলেও মোদি প্রকাশ্যে নিজের অসন্তোষ জাহির করেননি। বিতর্ক থিতিয়ে যেতে সময় দিয়েছেন। পরিবহনমন্ত্রী নিতিন গড়কড়ির বিরুদ্ধে ব্যবসায়িক অনিয়মের সরকারি রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও মোদি অবিচল থেকেছেন। সুষমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘মানবিক কারণের’ যুক্তিকেই তিনি অকাট্য মেনে বিরোধীদের দাবির কাছে মাথা না নোয়ানোর সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। দল ও সংঘ পরিবারও এ ক্ষেত্রে এক মত—সুষমা এমন কিছু করেননি, যার সঙ্গে আর্থিক দুর্নীতি জড়িত। তাঁর সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে, কিন্তু আর্থিক দুর্নীতির নামগন্ধ তাতে নেই। কাজেই সুষমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধীদের হাত শক্ত করার কোনো অভিপ্রায় মোদির নেই। তাঁর ধারণা, কংগ্রেস ও মিডিয়া খুব বেশি দিন এটা জিইয়ে রাখতে পারবে না।
সময়টাও মোদি-সুষমার পক্ষে সহায়ক। সংসদের বাদল অধিবেশনের এখনো এক মাস দেরি। অতএব, ‘ললিতকাহিনি’ যে সংসদকে উত্তাল করে রাখবে, সেই আশঙ্কাও এই মুহূর্তে নেই। ললিতের ভিসা নামক কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বিরোধীরা ভবিষ্যতে কোনো বিষধর সাপের খোঁজ পেলে অবশ্য অন্য কথা। তত দিন পর্যন্ত সুষমাকে মোদি প্রশ্রয়ই দেবেন।
মোদিকে আরও ভরসা জুগিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। কিথ ভাজের বিরুদ্ধে তারা কোনো তদন্ত করবে না জানিয়ে দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর চাপ অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। বাহাত্তর ঘণ্টা কেটে গেলেও নরেন্দ্র মোদি মুখে রা কাড়েননি। স্টাইলচ্যুত হওয়ার কোনো লক্ষণ এখনই দেখাতে তিনি নারাজ।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।