খোলা চোখে

সুযোগ পেলে মেয়েরা আকাশ ছোঁবে

নেপাল থেকে মেয়েদের এএফসি ফুটবলে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসা বাংলাদেশের মেয়েরা
নেপাল থেকে মেয়েদের এএফসি ফুটবলে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসা বাংলাদেশের মেয়েরা

গল্পটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে, আলাপ সেখান থেকেই শুরু করা যাক।
কবিগুরুর বয়স তখন সত্তর পেরিয়েছে। একদিন সকালে তাঁর নজরে এল একটি ছোট্ট মেয়ে, সদ্য হাঁটা শিখেছে, টলমল করে হেঁটে আসছে। সাহায্য করার জন্য কবিগুরু তাঁর কড়ে আঙুলটি বাড়িয়ে দিতেই মেয়েটি খপ করে তার পুরো হাতখানাই ধরে ফেলল। স্মিত হেসে কবি বললেন, ‘বাহ্, আমি তোমাকে একখানা আঙুল দিলাম, আর তুমি আমার পাণিগ্রহণ করতে চাও!’
পরিহাসের মতো মনে হলেও গল্পটা মনে পড়ল বাংলাদেশে একটি মৌলবাদী গোষ্ঠীর ব্যবহার দেখে। চলতি সরকার, যারা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে, রাজনৈতিক সুবিধার কথা মনে রেখে মৌলবাদীদের খুশি করতে তাদের কোনো কোনো ক্ষেত্রে রেয়াত দিয়েছিল। সরকারকে চাপে ফেলা গেছে ভেবে এই দলগুলো নিজেদের দাবি বাড়িয়েই চলল। শুধু কড়ে আঙুলে তারা খুশি নয়, পুরো হাতখানাই তাদের চাই। সাম্প্রতিক সময়ে এই মৌলবাদী গোষ্ঠীকে খুশি করতে সরকার এমন একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা আমাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে এই সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকা হয়তো সহজ হবে, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির ও সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন আসবে।
উদাহরণ হিসেবে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই সংস্কারের কথা আমরা আগে আলোচনা করেছি। হেফাজতে ইসলাম নামের একটি সংগঠনের দাবি মেটাতে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরিবর্তনগুলো করা হয়েছিল খুব গোপনে। এনসিটিবি প্রথমে হেফাজতের কথা মেনে নিতে আপত্তি জানালে ওই দলের নেতারা বোর্ড কর্তৃপক্ষকে ডিঙিয়ে সরকারের ওপর মহলে যোগাযোগ করেন, সেখান থেকেই সবুজসংকেত আসার পর ইতিমধ্যে মুদ্রিত হয়েছে এমন হাজার হাজার বই বাতিল করে তা নতুন করে ছাপাতে হয়েছে। ‘কোথায়, কার সঙ্গে কথা বললে কাজ হবে, সে আমাদের জানা আছে,’ দলের এক নেতা বিদেশি সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন।
তবে শুধু পাঠ্যবই সংস্কারে মৌলবাদীরা খুশি হবে, তা মনে হয় না। নিউইয়র্ক টাইমস–এর কাছে এই দলের এক নেতা তাঁদের পরবর্তী অভিলাষের কথা জানিয়েছেন (<https:// nyti. ms/2 kgs7 JJ>)। তাঁরা আর্ট বা চিত্রাঙ্কন জিনিসটাই পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দিতে চান। আমাদের ধর্মে মানুষের ছবি আঁকা নিষিদ্ধ, তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েদের সে শিক্ষা কেন দেওয়া হবে? তাঁরা প্রশ্ন রেখেছেন।
এই দাবির বিষয়ে সরকার এখনো রা করেনি, তবে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো নিয়ে মৌলবাদীদের আরেক পুরোনো দাবি তারা সম্প্রতি মেনে নিয়েছে। এরা দীর্ঘদিন থেকে যুক্তি দেখিয়ে আসছে, মুসলিম দেশসমূহে ৯-১০ বছরের মেয়েরা বিবাহযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। আমাদের দেশেই-বা তা কেন হবে না? সম্প্রতি সংসদে নতুন আইন গৃহীত হয়েছে, যাতে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ নির্ধারণ করা হলেও ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ এই বয়স কমানো যাবে। ঠিক কত কম বয়সের মেয়েদের বেলায় এই ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ কার্যকর হবে, তা নির্ধারিত হয়নি। তবে অনুমান করি, স্থানীয় আদালত সম্মত হলে এই বয়স ১০ বা ১১ পর্যন্ত কমে আসতে পারে। বিশেষ পরিস্থিতির ব্যাখ্যা হিসেবে জানানো হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে কম বয়সী মেয়েরা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার হয়। এমন মেয়েদের বেলায় এই আইন কার্যকর হবে। এ কথার অর্থ, যে ধর্ষকের হাতে মেয়েটি লাঞ্ছিত হলো, ধরে-বেঁধে তার হাতেই মেয়েটিকে তুলে দেওয়া হবে। সরকারের একজন মন্ত্রী এই ব্যবস্থাকে মানবিক বলে বর্ণনা করেছেন।
মৌলবাদী গোষ্ঠী, বিশেষ করে হেফাজতের নেতারা সরকারের এই সিদ্ধান্তে মহা খুশি। নিউইয়র্ক টাইমস–এর কাছে এই দলের এক নেতা বলেছেন, মেয়েরা বিশেষ এক বয়সের আগে বিয়ে করতে পারবে না, আমরা এই নিয়ম মেনে নিতে পারি না (<http://nyti. ms/2 m8 gN4 C>)।
বলাই বাহুল্য, অধিকাংশ সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ সরকারের এই সিদ্ধান্তে উদ্বিগ্ন হয়েছেন। এমনিতেই শিশু বিবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে এক নম্বর। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, বাংলাদেশে শিশু বিবাহ রীতিমতো ‘মড়কের’ আকার নিয়েছে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, বাংলাদেশের মেয়েদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। আরও ভয়ের কথা, দেশের ২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে মাত্র ১১ বছর বয়সের মধ্যেই দিয়ে দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই সব মেয়ে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। এখানে উল্লেখ করা ভালো, জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুসারে ১৮ বছরের অনূর্ধ্ব ছেলে বা মেয়ে শিশু হিসেবে পরিগণিত হয়। শিশু, অতএব এই বয়সের ছেলে বা মেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে। ১৯৮৯-তে গৃহীত এই সনদে যেসব দেশ সবার আগে স্বাক্ষর করে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম।
প্রশ্ন করা যেতে পারে, মৌলবাদীদের খুশি করতে আমাদের ‘প্রগতিশীল’ সরকারকে কেন একের পর এক আপসমূলক সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাব টাইমস–এর প্রতিবেদনেই রয়েছে। হেফাজতের এক নেতা পত্রিকাটিকে জানিয়েছেন, সব দলের রাজনীতিকদেরই দেশের মানুষের মধ্যে তাঁদের ‘জনপ্রিয়তা’ মাথায় রাখতে হয়। এ কথার অর্থ, অনুমান করি, হেফাজতিরা মনে করেন নির্বাচনে জিততে হলে তাঁদের চটালে সরকার বা বিরোধী দল কারোরই খুব ভালো হবে না। বরং ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে পাশে পেলে ক্ষমতায় টিকে থাকা সহজ হবে। ফলে তাঁদের না চটিয়ে সবচেয়ে দুর্বল যারা, অর্থাৎ শিশুদের, তাদের স্বার্থটাই জলাঞ্জলি দেওয়া গেল!
তবে পাঠ্যপুস্তক সংস্কার করে বা মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে যে মৌলবাদীরা ক্ষান্ত দেবেন, তা মনে হয় না। তাঁদের দাবির তালিকা অত ছোট নয়। তাঁদের কেউ কেউ এরই মধ্যে দাবি করেছেন, ঢাকার সুপ্রিম কোর্টের সামনে ন্যায়বিচারের প্রতীক যে নারীমূর্তিটি রয়েছে, তা সরাতে হবে।
এ কথায় কোনো সন্দেহ নেই, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের মেয়েরা অভাবিত অগ্রগতি অর্জন করেছে। হেফাজতের এক নেতা যুক্তি দেখিয়েছেন, ছেলে আর মেয়েরা এক নয়। ছেলেরা যা পারে, মেয়েরা তা পারে না। ‘যেমন ধরুন, ছেলেরা গাছে উঠতে পারে, মেয়েরা পারে না।’ এদের হয়তো নজরে পড়েনি মেয়েরা এখন কেবল গাছেই চড়ছে না, হিমালয় পর্যন্ত জয় করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়েরা ছেলেদেরও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে, এমনকি রাজনীতিতেও মেয়েদের উপস্থিতি এখন লক্ষণীয়। আর ক্রীড়াক্ষেত্রে তো মেয়েরা রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সেই কলসিন্দুরের অজপাড়াগাঁয়ের ১৫-১৬ বছরের মেয়েরাই বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল দল, যারা বিদেশ থেকে ট্রফি নিয়ে আমাদের গর্বিত করেছে। দক্ষিণ এশীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আমাদের মেয়েরা শুধু সাঁতার নয়, ভারোত্তোলনেও সোনা ছিনিয়ে এনেছে।
মেয়েদের এই অগ্রগতির পেছনে বর্তমান সরকার, বিশেষত এর প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। মেয়েদের অগ্রগতির ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত অঙ্গীকারের কথা অবিদিত নয়। ২০১৪ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্বাস দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের কম মেয়েদের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ১৮ বছরের কম এমন মেয়েদের বিয়ে একদম নিষিদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর। সেই প্রধানমন্ত্রীর সরকারের অধীনে মেয়েদের বিয়ের বয়স শিথিল করার এই সিদ্ধান্ত আমাদের ব্যথিত করেছে, উদ্বিগ্ন করেছে।
কোনো গোষ্ঠী মানুক বা না মানুক, ১৮ বছর বয়সের কম এমন কোনো মেয়েরই বিয়ে হওয়া উচিত নয়। এই বয়সের মেয়েরা স্কুল-কলেজে যাবে, ডাক্তার বা বিজ্ঞানী হতে শিক্ষা গ্রহণ করবে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হবে। তারা কেবল তখনই বিয়ে করবে, যখন সে জন্য নিজেরা প্রস্তুত এবং সেই বিয়ে হবে স্বেচ্ছায় ও তাদের সম্মতিতে। এখানে সাংসদ ও ধর্মীয় নেতাদের নাক গলানোর কোনো অধিকার থাকার কথা নয়।
গত বছর সাফ গেমসে ভারোত্তোলনে সোনা ছিনিয়ে নেওয়ার পর মাবিয়া আখতার চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলেছিলেন, তাঁর স্বপ্ন একদিন অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। এক মাবিয়া নয়, আরও হাজারো মাবিয়া রয়েছে, যারা সুযোগ পেলে আকাশ ছোঁবে। দয়া করে তাদের সে সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ করে দেবেন না।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।