পঞ্চগড়ের সুমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারেন। তিনি সৌদি আরব থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন। তাঁর ফিরে আসার বিষয়ে সরকার, সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস ও ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি সহায়তা করেছে। ফিরে এসেছেন গেন্ডারিয়ার ডালিয়া আক্তার। লালমনিরহাটের শিরিন বেগমসহ আরও অনেকে। যাঁরা সুমির মতো দেশে যোগাযোগ করতে পেরেছেন কিংবা সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে সহায়তা চেয়েছেন, তাঁরা ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু যাঁরা সেই সুযোগটুকু পাননি, তাঁরা ‘নরকযন্ত্রণা’ ভোগ করছেন।
সুমি আক্তারের ওপর নির্যাতনের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশে-বিদেশে আলোড়ন হয়। ছবিতে দেখা যায়, সুমি হাউমাউ করে কাঁদছেন আর তাঁকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন। তাঁর ভাষ্য: তারা আমাকে প্রতি রাতেই মারত। মার খেতে খেতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লেও তারা মার বন্ধ করত না। আমি প্রতিবাদ করলে তারা আরও বেশি মারত। বাড়ির মালিক তাঁর হাতে গরম তেল ঢেলে দিয়েছেন। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায় তিনি দেশে ফিরে এসেছেন।
পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার দিনমজুর রফিকুল ইসলামের মেয়ে সুমি। ৩০ মে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে। সুমির অভিযোগ, চাকরিতে যোগ দেওয়ার সাত দিনের মাথায় তাঁর নিয়োগকর্তা তাঁর ওপর নির্যাতন শুরু করেন। তিনি জানতে পারেন, তাঁকে ৪ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল।
সুমির প্রথম নিয়োগকর্তা তাঁর ওপর নিয়মিত নির্যাতন চালাতেন। এরপর ওই নিয়োগকর্তা সুমিকে ইয়েমেনের সীমান্তবর্তী এলাকার আরেক ব্যক্তির কাছে ২২ হাজার সৌদি রিয়েলে বিক্রি করে দেন। সেখানেও তাঁকে নিয়মিত নির্যাতন করা হতো। তারা ঠিকমতো খাবার দিত না। একদিন গৃহকর্তাকে অনুরোধ করে দেশের বাড়িতে টেলিফোন করার সুযোগ পান। এরপর তিনি শৌচাগারে গিয়ে তাঁর ওপর নির্যাতনের কাহিনি স্বামী নুরুল ইসলামকে জানান।
রূপসী বাংলা ওভারসিস নামের একটি সংস্থার মাধ্যমে সুমি সৌদি আরবে যান। কিন্তু ওই সংস্থার সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর ছাড়পত্র ছিল না। তারা জ্যোতি ইন্টারন্যাশনাল নামের অন্য একটি সংস্থার মাধ্যমে পাঠিয়েছে। এভাবে সুমি, শিরিন ও ডালিয়াদের ভাগ্য বিভিন্ন হাতে ঘুরতে থাকে। তাঁরা জানেন না কী চুক্তি ও শর্তে সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছে। সেখানে যাওয়ার পর তাঁদের নিয়োগপত্র ও পাসপোর্ট মালিক নিয়ে নেন। ফলে পালিয়ে যাওয়ারও সুযোগ থাকে না।
গতকাল শুক্রবার সুমির সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো। তিনি জানান, গার্মেন্টসে চাকরি করার সময় তাঁর মামির মাধ্যমে নুরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে হয়। এরপর স্বামী নুরুল ইসলাম তাঁকে বলেন, ‘তুমি সৌদি আরব যাও। সেখানে তুমি নার্সিংয়ের কাজ করবে।’ তখন সুমি বলেন, ‘বাবা-মা তো আমাকে পাঠাতে চান না। আমি কেন সৌদিতে যাব।’ এরপর নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সেখানে গেলে তোমার ভালো হবে।’ সুমি দেশে ফিরে পঞ্চগড়ে মা–বাবার বাড়িতে উঠেছেন। স্বামী নুরুল ইসলাম সেখানে গেলেও তিনি দেখা করেননি। সুমিকে জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কেন এখন স্বামীর সঙ্গে যেতে চান না, তিনি তো আপনার দেশে আসার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘আমি তো সৌদিতে যেতে চাইনি। স্বামীই আমাকে রূপসী বাংলা ওভারসিস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাচার করে দিয়েছেন।’ সুমির বক্তব্য হলো, ‘আমি সৌদিতে আটকা পড়ার পর স্বামী আমাদের বাড়িতে এসে ৬০-৭০ হাজার টাকা নিয়ে গেছেন। বাবার টাকাপয়সা ছিল না। একটা গরু ছিল। সেটি বিক্রি করেও টাকা দিয়েছেন। এরপর আমি দেশে আসার আগের দিন গাড়ি ভাড়ার কথা বলে আরও ১০ হাজার টাকা নিয়েছেন। এ ছাড়া টাকা দাবি করে বাবার নামে মামলাও করেছেন। আমি এই লোকের সঙ্গে “সেফারেশন চাই”।’
সুমিকে জিজ্ঞেস করি, সৌদি আরবে থাকতে তাঁর মতো অবস্থায় পড়েছেন, এ রকম কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে? তিনি বললেন, ‘না, সেফ হোমে যে কদিন ছিলাম, সেখানে আর কেউ ছিল না।’ দেশে ফিরে আসায় সহযোগিতা করার জন্য তিনি জেদ্দায় অবস্থিত বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসের কর্মকর্তা আবদুল হকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
সুমি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, এখনো তিনি অসুস্থ। সৌদিতে থাকতে তিনি দুই চোখেই আঘাত পেয়েছেন। চিকিৎসক দেখে বলেছেন, তাঁর দুই চোখের কর্নিয়ায়ই সমস্যা আছে। বাবা গরিব। চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য তাঁর নেই।
সুমি আক্তারকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে যখন তাঁর স্বামী নুরুল ইসলাম সরকারের কোনো সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না, তখন ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। তারা তাঁর আবেদনপত্রটি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়। সুমি আক্তারের খবরটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও উদ্যোগী ভূমিকা নেন। তিনি রিয়াদে সৌদি কনস্যুলেটকে তাঁকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার পরামর্শ দেন।
আল-জাজিরা টিভি সৌদিফেরত আরও দুই নারীর করুণ কাহিনি প্রচার করেছে। লালমনিরহাটের নমরিকারি গ্রামের বাসিন্দা শিরিন বেগম। বসতভিটা ছাড়া তাঁদের কোনো ধানি জমি নেই। স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে অনেক কষ্টে ছিলেন। একদিন খবর পেলেন মাত্র ৪০ হাজার টাকা দিয়ে মাসে ২০ হাজার টাকা বেতনে সৌদি আরবে কাজ পাওয়া যায়। স্থানীয় এক মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সৌদি আরব যান গত মে মাসে। তাঁকে বলা হয়েছিল মাত্র চারজনকে রান্না করে খাওয়াতে হবে। মাসে বেতন ২৩৫ ডলার। কিন্তু নির্ধারিত বাড়িতে কাজ নিয়ে দেখেন অনেক লোক। শিরিন তাঁদের পছন্দমতো খাবার রান্না করতে না পারলেই তাঁর ওপর নির্যাতন চলত। একদিন পরিবারের বড় ছেলে তাঁর ওপর নির্যাতন চালানোর চেষ্টা করলে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করেন। পরদিন একইভাবে আক্রান্ত হলে শিরিন কাছের পুলিশ স্টেশনে গিয়ে নালিশ করেন। শিরিনের কাছে বৈধ কোনো কাগজপত্র ছিল না। এ কারণে তাঁকে চার সপ্তাহ জেল খাটতে হয়। এরপর বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফেরেন। তাঁর জিজ্ঞাসা, ‘আমি সেখানে চার মাস কাজ করলেও দুই মাসের বেতন পেয়েছি। এখন মহাজনের টাকা কীভাবে শোধ করব?’
গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা ডালিয়া আক্তার। সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন পঙ্গু হয়ে। তিনি গিয়েছিলেন ২০১৮ সালের জুলাইতে। মাসে বেতন ২৬০ ডলার। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো। গৃহকর্ত্রী কথায় কথায় তাঁকে লাঠি দিয়ে মারতেন। ডালিয়া সেখানে কাজ করতে না চাইলে তারা আরেক পরিবারে তাঁকে বিক্রি করে দেয়। নির্যাতন সইতে না পেরে তিনি তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এতে তাঁর এক পা ভেঙে যায়। এ অবস্থায় বাড়ির মালিক তাঁকে বাংলাদেশ দূতাবাসে রেখে যান। তিন সপ্তাহ থাকার পর ডালিয়া আক্তারও দেশে ফেরেন খালি হাতে। তিনি বলেছেন, ‘সৌদি আরবে যাওয়ার আগে আমি সুস্থ মানুষ ছিলাম, এখন পঙ্গু। পরিবারের জন্য বোঝা।’
সৌদি আরবে গিয়ে বাংলাদেশি নারী কর্মীরা যে নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন, তার দায় কে নেবে? প্রথম আলোর কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজের প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারলাম ‘সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর পর খোঁজ নেয় না কেউ’। যদিও এ ব্যাপারে দুই দেশেরই দায় আছে। বাংলাদেশের দায় হলো যাওয়ার আগে কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া, আরবি ভাষাটা শেখানো। সেখানকার পরিবেশ ও আবহাওয়ার সঙ্গে তারা খাপ খাওয়াতে পারবেন কি না, সেসব দেখা। একশ্রেণির আদম ব্যাপারী প্রতিষ্ঠান সোনার হরিণের খোয়াব দেখিয়ে তাঁদের সেখানে পাঠায়। সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানো শুরু হয় ১৯৯১ সালে। এরপর দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি সই হয়। এরপর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ লাখ ৯৩ হাজার ৫৮৮ নারী সৌদি আরবে গেছেন। দেশটিতে কর্মী পাঠানোর নিবন্ধন রিক্রুটিং এজেন্সির প্রায় ৭০০ (জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান)। অনেক এজেন্সি সেখানে নারী কর্মী পাঠানোর নামে পাচার করে বলে অভিযোগ আছে। সরকার ১৬৭টি এজেন্সিকে কালো তালিকাভুক্ত করার পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
সৌদি আরবে মানবাধিকার পদে পদে ভূলুণ্ঠিত। তাই বলে বিদেশি নারী কর্মীদের সঙ্গে তারা দাসসুলভ ব্যবহার করতে পারে না। নির্যাতন চালাতে পারে না। আগে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা থেকে প্রচুর নারী কর্মী সৌদি আরবে যেতেন। নির্যাতনের কারণে তারা সেখানে নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে।
নির্যাতন সইতে না পেরে একজন সুমি ফিরে এসেছেন। কিন্তু আরও অনেক সুমি সেখানে বন্দী জীবনযাপন করছেন। তাঁদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেবে কি সরকার?
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com