সুমন জাহিদের মৃত্যুর খবর পেলাম মেসেঞ্জারে। এরপর নানাভাবে আরও অনেক তথ্য হাতে এল নানাভাবে। ঢাকার বাইরে আছি বলে ওর কাছে যেতে পারিনি, তবে প্রজন্ম ’৭১-এর সদস্যরা দুঃসংবাদ পাওয়ার পরপরই চলে গেছে পুলিশ ফাঁড়িতে, তারপর হাসপাতালে। তাঁর শেষযাত্রার পুরোটা সময় তাঁর বন্ধুরা তাঁর পাশে থাকবে।
সুমন জাহিদের মৃত্যু খুন, আত্মহত্যা নাকি দুর্ঘটনা—তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। আমি আমার যে সতীর্থকে চিনি, শহীদ সেলিনা পারভীন যার মা, সেই সুমন জাহিদ আত্মহত্যা করতে পারে—এমন কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। জীবনের কঠিনতম সময়গুলো ও পার করেছে। ভাগ্য সব সময় সুপ্রসন্ন থাকেনি, এরপরও লড়াকু সুমন কোথাও পরাজয় স্বীকার করে নেয়নি। ঢাকা মহানগরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নাম শহীদ সেলিনা পারভীন সড়ক করার পেছনে সুমন জাহিদের একক সংগ্রামের কথা অনেকেরই মনে আছে। ঠান্ডা মাথায় সুমন জীবনের সব হতাশার সঙ্গে লড়েছে এবং সফল হয়েছে।
সুমন জাহিদের সঙ্গে নামের মিল থাকায় আমরা পরস্পরকে ডাকতাম ‘মিতা’। প্রজন্ম ’৭১ আমাদের মিলিয়েছিল। একাত্তরে স্বজনহারা মানুষেরা মিলেছিল এই প্ল্যাটফর্মে। তবে প্রথম আলো পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকায় প্রজন্ম ’৭১-এর গণ্ডির বাইরেও ওর সঙ্গে আমার স্মৃতি অনেক। মায়ের একটি ছবি নিউমার্কেটের একটি স্টুডিও থেকে কেমন করে আবিষ্কার করল, তার বর্ণনা করে ও বলত, ‘মিতা, একটু লিখে দাও।’ কিংবা পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে মায়ের নামে সড়ক করার ব্যাপারে লিখে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যও আসত ও। মাঝেমধ্যেই দেখতাম, জাতীয় পতাকায় মুড়িয়ে বড় ছেলেটাকে মোটরসাইকেলের সামনে বসিয়ে ছুটে চলেছে সুমন। মনে হতো, বাংলাদেশের প্রতি এত মমত্ব ওর থাকবে না তো কার থাকবে? মায়ের মৃত্যুর পর কেউই তো ছিল না ওর। একা একা জীবনের পথটা ঠিক করেছে সুমন জাহিদ।
ঘাতকদের বিচার যখন চলছিল, তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছিল সুমন জাহিদ। এরপর থেকে ওকে ফোনে হুমকি দিয়ে আসছিল কেউ কেউ। এ নিয়ে ও পুলিশের কাছেও গিয়েছে। একটা বড় সময় ধরে নানা ফোন থেকে ওকে হুমকি দেওয়া হতো। সুমন জাহিদের এ রকম মৃত্যু তাই এই প্রশ্নকেও সামনে নিয়ে আসে যে ওই হুমকিদাতাদের কেউ কি সুমনকে হত্যা করল? ওকে হত্যা করে ট্রেন লাইনের ওপর রেখে যাওয়া হয়েছিল কি না, তা-ই বা কে বলবে? ওকে ট্রেনে কাটা পড়তে কি কেউ দেখেছে? আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার। সুমন জাহিদ আত্মহত্যা করতে পারে বলে আমার মনে হয় না। এ রকম একজন লড়াকু সৈনিক হঠাৎ করে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করবে, তা ভাবতেও পারি না আমি।