>
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, প্রথম আলো ও ইউএনএফপিএর আয়োজনে ‘সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নারীর সমতা, ক্ষমতায়ন এবং মা ও শিশুস্বাস্থ্যের সুরক্ষা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো।
আলোচনায় সুপারিশ
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে
কর্মজীবী অভিভাবকেরা িকছু সময় সন্তানদের সঙ্গে থাকলে এরা মাদকসহ অনৈতিক কাজ থেকে দূরে থাকবে
জনপ্রতিনিধিরা জন্মনিবন্ধন সনদ সঠিকভাবে দিলে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব
প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে সন্তানদের সঙ্গেও খোলামেলা আলোচনা করা প্রয়োজন
নারীর হাতে টাকা না থাকলে ক্ষমতায়ন হবে না। তাই নারীবান্ধব ব্যবসায়িক পরিবেশ দরকার
সবার সমান অধিকারের িবষয়ে আরও জোর দিতে হবে।
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলো আর জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) সমঝোতার ভিত্তিতে দীর্ঘ মেয়াদে সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধ, তাদের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পুষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এর আগে মৌলভীবাজারে চা-শ্রমিকদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। আজ কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখন আলোচনা করবেন আশেক উল্লাহ রফিক।
আশেক উল্লাহ রফিক
আলোচনার শুরুতে একটু পেছনে ফিরে যেতে চাই। অন্ধকার যুগে শিশুদের, বিশেষ করে মেয়েশিশুদের জীবন্ত কবর দেওয়া হতো। আর সনাতন ধর্মে সতীদাহ প্রথা ছিল। কী এক বিভীষিকাময় সময় ছিল তখন। সেখান থেকে মানবজাতি অনেক দূর এগিয়েছে। এখন অধিকার নিয়ে ভাবছি। একসময় জীবন নিয়ে সংশয় ছিল। এমন একটি অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছে।
আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ, যেখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা সেভাবে হচ্ছে না ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক গোঁড়ামির কারণে। সবকিছু মিলিয়ে এখনো আমাদের অনেক ক্ষেত্রে কাজ করতে হবে। অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
আজকের গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা মাঠপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। একসময় সম্পদে নারীর অধিকার ছিল না। এখন রাষ্ট্র বা সরকার চিন্তা করছে সমতায়নের জন্য। সেখানে ধর্মীয়, সামাজিকসহ অনেক ধরনের বাধা রয়েছে। আইন ও ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত যে সম্পদ বোন বা নারীদের পাওয়ার কথা, তা-ও আমরা অনেক সময় দিই না। এ বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ আয় করেন বলে পুরুষদের আধিপত্য রয়েছে। অনেক নারী আয় করেন না বলে নিগৃহীত হন। এটা বন্ধে নরীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। তাঁদের শিক্ষিত করতে হবে।
পোশাকশিল্পে বিপ্লব হয়েছে। আজ যদি এসব নারী আয় করতে না পারতেন, তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াত? তাই নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে ব্যাপকভাবে চিন্তা করতে হবে। কেননা, ক্ষমতার সঙ্গে অর্থনীতির বিশাল সংযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি।
আবু সাইদ মো. হাসান
এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) অর্জনের সময় নির্ধারণ করা হয় ২০৩০ পর্যন্ত। এসডিজির ১৭টি গোল বা লক্ষ্য রয়েছে। এগুলো মূলত ভিশনারি ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা।
এসডিজির যে গোলগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো যদি সমন্বিতভাবে একসঙ্গে এগিয়ে নিতে না পারি, তাহলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। কেউ যাতে পিছিয়ে না পড়ে, সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এসডিজির প্রতিটি লক্ষ্য একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি অর্জিত না হলে অন্যটি অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। সবার কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়াই এসডিজি ৩–এর মূল লক্ষ্য।
কিছু কিছু দেশ লক্ষ্য অনুযায়ী এগোতে পারছে না। তেমনিভাবে যদি আমাদের দেশে খেয়াল করি, তাহলে দেখব যে সব বিভাগ সমানভাবে এগোচ্ছে না। জেলা ও উপজেলার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তাই পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ যত ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা দূর করতে হবে। এবং এসব সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এটাই এসডিজির মূল লক্ষ্য।
পিন্টু কান্তি ভট্টচার্য
মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক জরিপে দেখা গেছে, ৩০ শতাংশ মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়েছে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি।
২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির গোল লক্ষ্য অর্জনের বিষয়টি অনেকাংশে নির্ভর করে নারী ও যুবগোষ্ঠীর পরিবার পরিকল্পনা সেবা, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের অধিকারসহ অন্যান্য অধিকার যথাযথ কার্যকর করার ওপর। ১৯৭৫ সালে যেখানে পরিবার পরিকল্পনা ব্যবহার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, বর্তমানে তা ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অনেক অগ্রগতি থাকলেও বড় একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাল্যবিবাহ। বাংলাদেশে প্রায় ৫৯ শতাংশের ওপরে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এতে ৩১ শতাংশ কিশোরী ১৮ বছরের পূর্বে মা হচ্ছে। এতে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি থেকে যায়।
মো. আবদুস সালাম
এমডিজিতে আমাদের অনেক অর্জন ও অগ্রগতি রয়েছে। এইডস ও ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে আশানুরূপ উন্নতি হয়েছে। তবে মাতৃমৃত্যুর হার রোধে আশানুরূপ উন্নতি করতে পারিনি। এ ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। গর্ভবতী নারীদের প্রসূতি ও প্রসূতি–পূর্ব সেবার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অনেকে গর্ভবতী নারী স্বাস্থ্যসেবা সম্পন্ন করেন না। এই হার কমাতে হবে।
চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গা, বিশেষ করে দ্বীপাঞ্চল, পার্বত্যাঞ্চল এলাকায় সহজে যোগাযোগ করা যায় না। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও এগুলোর সঙ্গে অনেক এলাকার দূরত্ব ১৫-২০ কিলোমিটার। ফলে যাতায়াতব্যবস্থার কারণে ইচ্ছা থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসতে পারছেন না। আবার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে দক্ষ জনবলের অভাব আছে। যানবাহনের সংকট রয়েছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবও আছে।
মিয়ানমার থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা এ দেশে এসেছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা নারী গর্ভবতী। এসব নারীর ডেলিভারির বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এসডিজিতে মাতৃমৃত্যুর হার লাখে ৭০ নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ১০ বছরে মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর জন্য অনেক কিছু করা হয়েছে, কিন্তু আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু সরকারের একার পক্ষে এটি সম্ভব নয়। সবাই মিলে যদি কাজ করা যায়, তাহলে একটি ভালো ফল আসবে।
মো. আলী হোসেন
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ১৭টি গোল বা লক্ষ্য ধরা হয়েছে। আর গোলগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটি খুবই নিবিড়ভাবে যুক্ত। যেমন সুবিচার না পেলে কোনো কিছুই হবে না। দারিদ্র্য দূর করতে না পারলে হবে না। আমাকে রাস্তায় বের হতে হবে। খেতে হবে। পুষ্টিই যদি নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে প্রসূতিসেবা বলেন আর স্বাস্থ্যসেবা বলেন, কিছুই কাজে আসবে না। তাই এসব বিষয় একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত। একসময় এ ধরনের বৈঠক ঢাকার ফাইভ স্টার হোটেলগুলোতে হতো। এখন কক্সবাজারে হচ্ছে। তবে এটি যদি কুতুবদিয়া, মহেশখালীতে হতো, তাহলে সেখানকার লোকজন আরও বেশি উপকৃত হতো। আমাদের তৃণমূলে যাওয়া দরকার, যেতে পারছি না।
কক্সবাজার মূলত উপকূলীয় এলাকা। এসব এলাকার মানুষ সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। বর্ষার সময় ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত দেখানো হয়, তখন তারা জীবন বাঁচাবে নাকি জীবনের উন্নতি করবে? নাকি সংগ্রাম করবে? শিক্ষায়, কর্মক্ষেত্রে ও স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণ ইতিবাচক। তবে অনেক সমস্যা চিহ্নিত করা হলেও তা নিরসন করার ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে যায়।
শবনম মুশতারী
আমার বাড়ি কক্সবাজারের কুতুবদিয়া এলাকায়। সেখানে নারী ও শিশুরা খুব অসহায় অবস্থায় আছে। মেয়েরা পড়ালেখা করলে তা মাঝপথে থেমে যায়। এখানকার অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা কম। স্কুলপড়ুয়া কোনো ছাত্রীকে এলাকার বখাটেরা উত্ত্যক্ত করলে ওই মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন মা-বাবা। অনেকের এভাবেই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু এটা তো কোনো সমাধান নয়। কুতুবদিয়ার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্স নেই। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে দূরের এলাকার রোগীদের আনা-নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে রোগী মারা যায়।
খালেদা বেগম
আজকের বৈঠকে এমডিজি ও এসডিজি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এসব আমাদের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কতটুকু জানেন? আমার তো মনে হয় তাঁদের অনেকের এ বিষয়ে ধারণা নেই।
আমি কক্সবাজারের মেয়ে হিসেবে বলতে পারি, এই অঞ্চলের মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে আসতে অনেক বেশি বাধাবিপত্তি পেরোতে হয়। প্রথমেই তারা বাধা পায় পরিবার থেকে। মা-বাবা, ভাই-বোন এমনকি স্বামীরাও নিরুৎসাহিত করেন। তাঁদের কথা, মেয়েরা বাইরে কেন চাকরি করতে যাবে? ঘরে টাকাপয়সা সব আছে। তুমি ঘরে বসে থাকো।
আমরা কেউ নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করি না। প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমরা কজন সন্তানদের সঙ্গে আলোচনা করি? তাদের সঙ্গে আলোচনা করা খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশ এখন যৌবনের দ্বারপ্রান্তে। তাই আমাদের তরুণদের জন্য বিভিন্ন সমন্বিত কর্মসূচি নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
শামীম আকতার
ভৌগোলিক ও প্রতিবেশগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের অন্য জেলাগুলোর চেয়ে কক্সবাজারের নারীদের অবস্থান পুরোপুরি ভিন্ন।
আমরা শিক্ষার দিক দিয়ে, সচেতনতার দিক দিয়ে অনেক দূর পিছিয়ে আছি। কক্সবাজার যেমন সম্ভাবনাময় জেলা, তেমনি সমস্যাবহুল জেলাও।
আমি ব্যক্তিগতভাবে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কক্সবাজারের বাল্যবিবাহ, নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র তৈরি করেছি বিভিন্ন সোর্স থেকে। এসব চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখেছি, অন্য জেলাগুলোতে দারিদ্র্যের কারণে বাল্যবিবাহ হলেও কক্সবাজারে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে হয়ে থাকে।
দারিদ্র্যের কারণে নয়; অশিক্ষা, অসচেতনতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, যৌন নির্যাতন এবং একশ্রেণির মানুষের বিশেষ লোভের কারণে এখানকার মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। তারা অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
কাজিরা আন্তরিক ও দায়িত্বশীল হলে বাল্যবিবাহের হার কমে যাবে। আবার জনপ্রতিনিধিরা জন্মনিবন্ধন সনদ সঠিকভাবে দিলে কক্সবাজারে বাল্যবিবাহ রোধ করা কোনো বিষয় নয়। কিন্তু তাঁরা এত বেশি উদাসীন যে কেউ এলেই যাচাই-বাছাই না করে সনদ দিয়ে দেন। সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে।
মিজানুর রহমান
কক্সবাজারের শুঁটকিপল্লিতে প্রায় চার হাজার নারী কাজ করেন। যাঁদের বেশির ভাগই বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ পাননি।
তাঁদের মধ্যে মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই। আবার শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন।
মাতৃত্বকালীন ছুটি বলে কিছু একটা যে আছে, অনেকে তা জানেন না।
শুঁটকিপল্লির কাজের পরিবেশ ভালো নয়। সেখানে কাজের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নেই। শুঁটকি তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। নারীরা গ্লাভস ছাড়াই খালি হাতে এসব মিশ্রণ ব্যবহার করেন।
অনেক নারীর সঙ্গে তাঁদের শিশুসন্তানেরাও সেখানে কাজ করে। সবাই স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছে। আর সবাই বিষক্রিয়ার শিকার হচ্ছে।
এ ছাড়া গর্ভবতী নারীরা এসব শুঁটকিপল্লিতে কাজ করায় তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও ঝুঁকির মধ্যে থাকে। আবার এসব পল্লিতে কাজ করে একজন নারীর দৈনিক আয় হয় মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
দিদারুল আলম
আমরা সাড়ে সাত হাজার মাদকাসক্ত নিয়ে কাজ করছি। এসব মাদকাসক্ত সন্তানের পরিবার নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। এসব পরিবারে সব দোষ এসে পড়ে মায়ের ওপর। স্ত্রীরাই সন্তান আর সংসারের দেখাশোনা করবেন, এমন অমূলক ধারণা এসব পরিবারে রয়েছে। কর্মজীবী অভিভাবকেরা অন্তত রাতের খাবার সন্তানদের সঙ্গে খেতে পারেন। এতে সন্তানদের জন্য কিছু সময় বরাদ্দ রাখলে ছেলেমেয়েরা মাদক থেকে দূরে থাকবে।
মাদকাসক্ত সন্তানদের নিয়ে পরিবারগুলো এমন অবস্থায় আছে, তাদের কাছে এমডিজি, এসডিজি ও নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে ভাবার সময় নেই।
রোহিঙ্গারা আসার পর হঠাৎ করে কক্সবাজারে অনেক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এসব চাকরিতে মেয়েরা যুক্ত হচ্ছে। তাহলে কি বলা যায়, এত দিন সুযোগের অভাবে নারীরা চাকরি করতে পারেননি? তাই নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর হয়ে যাচ্ছে। যা আছে তা দূর করতে হবে।
রেজাউল করিম চৌধুরী
জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জনকে প্রথমেই বিশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি, তাঁরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল সামাল দিয়েছেন। আমরা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় শরণার্থীদের বিষয়টি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবস্থাপনা করেছি।
ইতিমধ্যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, প্রায় ৬০ হাজার শিশু জন্ম নেবে। এই রোহিঙ্গারা অনেক দিন ধরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। আমিও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এমনও দেখেছি, ১৫-১৬ বছর বয়সী মেয়েদের চার-পাঁচটি সন্তান রয়েছে। আমরা যেহেতু তাদের সমাদর করেছি, আশ্রয় দিয়েছি, তাই তাদের ভালো কিছু দিতে হবে।
গত ২০ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের জন্য এনজিও ব্যুরো থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কোনো প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এনজিওগুলো কাজ করতে পারে না। এই টাকা দিয়ে বয়স্ক শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা যেত। পুরো কক্সবাজার জেলায় জন্মনিবন্ধন বন্ধ রয়েছে। ১০ লাখ রোহিঙ্গার জন্য এতগুলো মানুষকে বঞ্চিত করা যেতে পারে না।
আবু মোর্শেদ চৌধুরী
নারীর সমতা ও ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে। এসডিজি অর্জনের জন্য ১৭টি গোল রয়েছে। এসব গোল অর্জনের জন্য আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম শর্ত হচ্ছে, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
নারীর হাতে টাকা না থাকলে ক্ষমতায়ন হবে না। তাই নারীবান্ধব ব্যবসায়িক পরিবেশ দরকার। এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের হাতে রয়েছে মাত্র ১২ বছর। আমাদের নারীদের সচেতন করতে হবে। তাঁরা অবশ্য আগের তুলনায় মোটামুটি সচেতন হচ্ছেন।
স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারীদের ক্ষমতায়ন কতটুকু হচ্ছে তা দেখতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু পূরণ হলো, তা তদারক করতে হবে। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে কতটা উন্নতি হলো, তা বিবেচনায় নিতে হবে। এগুলো করার জন্য দরকার শুধু কৌশলগত ব্যবস্থাপনা ঠিক করা। হাই টেকনোলজি ব্যবহার না করে যদি সহজ কৌশল ব্যবহার করা হয়, তাহলে এসডিজি অর্জন করা সম্ভব।
মায়েঁনু
এই জেলায় রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা ১৪ হাজার ৫৫১। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু নিয়ে কিছু কথা বলব। এই সম্প্রদায়ের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। তাদের বাদ দিয়ে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব না। এখন অর্জন করতে গেলে গর্ভবতী মা, ওই সমাজ ও পরিবারকে সচেতন করতে হবে। তাদের অন্যতম প্রধান সমস্যা ভাষাগত সমস্যা। এই সমস্যার কারণে তাদের অনেকেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে চায় না। তাই ওই সম্প্রদায় থেকে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করতে হবে। তারাই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাবে।
ফলে তারা সহজেই স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারবে। তাদের শিক্ষিত করতে হবে। ভাষাগত সমস্যার কারণে অনেক ছেলেমেয়ে প্রাইমারি স্তরে ঝরে যায়। এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। আর যেসব কুসংস্কার রয়েছে, তা দূর করতে হবে।
পু চ নু
এসডিজি গোলের ৩ নম্বরে বলা হয়েছে, সব বয়সী সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমেই আমাদের নজর দিতে হবে পরিবারে। এটি হচ্ছে প্রাইমারি প্রোডাক্ট অব হেলথ। পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে স্বাস্থ্যসেবাগুলো। গবেষণায় বলা হয়েছে, ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ চিকিৎসা ঘরেই হয়। বাকিরা হাসপাতালে আসে। আর ঘরে কে সেবা করেন? বিশেষ করে মা করেন।
কমিউনিটি গ্রুপ, ক্লিনিক বা সাপোর্ট গ্রুপ হচ্ছে সংযোগ স্থাপনকারী। পরিবারের পরেই রয়েছে এই গ্রুপ। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে (পিপিপি) কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। এটি সুন্দর মডেল। কিন্তু কমিউনিটি গ্রুপগুলো যেভাবে যুক্ত থাকার কথা তা কার্যকরভাবে হচ্ছে না।
তৃতীয়ত, সরকার আমাদের যে অবকাঠামো করে দিয়েছে, যেমন হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু এখানে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিদ্যমান জনবল দিয়ে কি গুণগত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব?
শামিমা পারভিন
এসডিজি সম্পর্কে অধিকারভোগীদের অারও জানা দরকার। বিশেষ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে থেকে বিষয়গুলো কতটুকু অনুধাবন করছেন, কীভাবে বিশ্লেষণ করছেন এবং গোলগুলো বাস্তবায়নে কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন গর্ভবতী মা, তিনি যেখানেই বাস করুন না কেন, সঠিক সময়ে গুণগত সেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও সেবাদানকারী সংস্থার অন্যতম দায়িত্ব। এই গুণগত সেবা নিশ্চিত করতে সেবাদানকারীদের বিভিন্ন প্রকার উদ্ভাবনীমূলক উপায়ে চিন্তা করতে হবে। যেমন ২৪/৭ মিডওয়াইফ সেবা, কমিউনিটি ক্লিনিকের সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্যাটেলাইট ক্লিনিক ইত্যাদি। গুণগত স্বাস্থ্যসেবা প্রসূতি মায়ের দোরগোড়ায় যেন পৌঁছে যায়। এসডিজি গোল ৫ (জেন্ডার সমতা) এমন একটি গোল, যেটি সঠিকভাবে অর্জন করতে পারলে অন্যান্য গোলের উন্নয়ন সূচকগুলো অর্জন অনেক সহজ হবে। ১৬ কোটি জনগণের অর্ধেক নারী জনগোষ্ঠীর সঠিক উন্নয়ন ছাড়া কোনো উন্নয়নই সম্ভব নয়। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে এটি অত্যন্ত জরুরি।
জি এম রহিম উল্লাহ
কক্সবাজারে সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু, নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী ও জেলেগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের অনেকেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করে। সেখানে অনেক কুসংস্কার রয়েছে। গৃহিণীদের ঘরে রাখার মনোভাব কাজ করে। ছেলেসন্তান জন্ম দিতে হবে—এ রকম মনোভাব এখনো রয়েছে। এই মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। স্কুল পর্যায়েও ছাত্রীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। তবে আমাদের সমাজে বিধবারা খুবই নিগৃহীত। তাঁরা শ্বশুর ও বাপের বাড়ি—দুই পক্ষেই সুবিধাবঞ্চিত হন। অবহেলিত থেকে যান তাঁরা।
প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। আবার থাকলেও সেখানে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই। তাই এসব এলাকার প্রসূতি মায়েরা রাতে কোনো কিছু হলে তাঁরা কোথায় যাবেন স্বাস্থ্যসেবা নিতে? অনেক সময় তাঁরা শহরে এসেও চিকিৎসা পান না। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকেরা থাকেন না। অনেকের ক্লিনিকে যাওয়ার সামর্থ্য নেই। অনেকেই আমাদের কাছে ছুটে আসেন।
মনিরুল ইসলাম
এখন এমডিজি থেকে এসডিজিতে উত্তরণ ঘটেছে। এমডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যে কয়টি দেশ ভালো করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী ভালো করা ১৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। তবে পৃথিবীর কোনো দেশই শতভাগ এমডিজি বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনো সমস্যা নেই। শিশুস্বাস্থ্য, মাতৃস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভালো ভালো নীতিমালা করা হয়েছে। আমরা নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পারি, তার প্রমাণ ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে বাংলাদেশের অনেক প্রস্তাব জাতিসংঘে পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে বেশ কিছু এসডিজির গোলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এসডিজি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কেননা, এসডিজির গোলগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি যুক্ত। এসব গোল অর্জনের জন্য মন্ত্রণালয়গুলো পরিকল্পনা দিয়েছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি এবং তা বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না তদারক করা হবে।
আশেক উল্লাহ রফিক
এসডিজির বিষয়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসডিজির গোল বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভাববেন। তিনি নির্দেশনা দেবেন। এখানে রাজনীতির বিষয় জড়িত। এখান থেকে ফিরে গেলে রাজনীতি কোথায় যাবে? এ ছাড়া আরও অনেক বিষয় জড়িত আছে। প্রধানমন্ত্রী গভীরভাবে চিন্তা করবেন। নারীদের আরও সামনে আসতে হবে। নারী যদি মনে করে, নারী হয়ে কেন জন্ম নিলাম। তাহলে নারীর ক্ষমতায়ন কীভাবে সম্ভব? এই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
আব্দুল কুদ্দুস: মাননীয় সাংসদসহ সম্মানিত আলোচকগণ অনেক সময় দিয়েছেন। এ জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
যাঁরা অংশ নিলেন
আশেক উল্লাহ রফিক: সাংসদ, কক্সবাজার-২
মনিরুল ইসলাম: উপপ্রধান, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন
মো. আলী হোসেন: জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার
জি এম রহিম উল্লাহ: উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, কক্সবাজার সদর
মো. আবদুস সালাম: সিভিল সার্জন, কক্সবাজার
পু চ নু: তত্ত্বাবধায়ক, কক্সবাজার সদর হাসপাতাল
পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য: উপপরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ, কক্সবাজার
মায়েঁনু: সহযোগী অধ্যাপক, কক্সবাজার সরকারি মেডিকেল কলেজ
রেজাউল করিম চৌধুরী: প্রধান নির্বাহী, কোস্টট্রাস্ট
দিদারুল আলম: নির্বাহী পরিচালক, নোঙর
আবু মোর্শেদ চৌধুরী: চেয়ারম্যান, পালস ও সভাপতি, কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স
মিজানুর রহমান: উপদেষ্টা, কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট শ্রমিক ইউনিয়ন
খালেদা বেগম: টিম লিডার, ইপসা
শামীম আকতার: সভাপতি, কক্সবাজার বিতর্ক ক্লাব
আবু সাইদ মো. হাসান: টেকনিক্যাল অফিসার, ইউএনএফপিএ
শামিমা পারভিন: চিফ (এআই), জেন্ডার ইউনিট, ইউএনএফপিএ
শবনম মুশতারী: সভাপতি, প্রথম আলো বন্ধুসভা, কক্সবাজার সরকারি কলেজ শাখা
আব্দুল কুদ্দুস: নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রথম আলো, কক্সবাজার
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো