সুবিধাজনক আন্দোলনে আরাম পায় প্রতিপক্ষ

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলায় খালাস পান পাঁচ আসামি
 ছবি: দীপু মালাকার

আসল ক্ষোভটা কার বিরুদ্ধে? যে বিচারক বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের দায় থেকে অভিযুক্ত পাঁচ আসামিকে খালাসি দিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে? নাকি আসামিদের বিরুদ্ধে? ৭২ ঘণ্টার পর ধর্ষণের অভিযোগের মামলা না নেওয়ার পরামর্শের বিরুদ্ধে নাকি খোদ রায়ের বিরুদ্ধে? সাম্প্রতিক কিছু আন্দোলনে দেখা যাচ্ছে, সমস্যার জ্বলন্ত দিকটার বদলে সুবিধাজনক নরম দিকটা নিয়ে মেতে থাকছে। আন্দোলনের প্রতিপক্ষ করা হচ্ছে এমন কাউকে, যাদের বিরুদ্ধে কথা বলা কম বিপজ্জনক?

গত মাসে দেশের কয়েকটি জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হলো। দেশজুড়ে প্রতিবাদ হলো। শাহবাগ থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত বর্ণাঢ্য প্রতিবাদ হলো, কনসার্ট হলো, তারকারা সেসব প্রতিবাদে কথার ফুলকি ছিটালেন। কিন্তু এত বড় ঘটনায় সরকারের দায় ও দায়িত্বের কথা বলা হলো কম। দোষ দেওয়া হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে। অথচ প্রায় প্রতিটি ঘটনায় সরকারি দল ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং তাদের আশ্রিত কিশোর গ্যাংয়ের হাত দেখা গেছে। তারপরও রাজনৈতিক ব্যর্থতাকে সমালোচনার চেয়ে, দোষ দেওয়া হলো ধর্মান্ধতাকে।

‘ধর্মান্ধতা’ অবশ্যই সমস্যা। এর প্রকোপ কমাতে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কাজকর্ম করে যাওয়া দরকার। এটা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। কিন্তু আশু সমস্যার আশু প্রতিকারের জন্য জরুরি ছিল, হামলাকারী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিচারের মধ্যে নিয়ে আসা, তাদের চিহ্নিত করা, তাদের আটক করা। সেটা কি হয়েছে? হাজার হাজার গায়েবি আসামি করা হয়েছে, ভয়ে অনেক গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে গিয়েছিল। তবুও ভাশুরের নাম মুখে নিতে অসুবিধা দেখা যায়।

ভানুমতীর খেল এখানেই শেষ নয়, যেখানে সরকারি দলের কিছু কিছু নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধেই অভিযোগ, সেখানে সরকারপন্থী লোকজনই প্রতিবাদের ময়দান দখল করে ছিলেন। ‘ধর্মেও আছি, জিরাফেও আছি’–এর মতো করে হামলায়ও আছি, প্রতিবাদেও আছি! তাঁরা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বিষ যত ঢেলেছেন, সুষ্ঠু তদন্তের কথা বলতে ততটাই ভুলে গেছেন।

এ ধরনের আন্দোলন কি প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে সাহায্য করে না? কৃত্রিম হুমকিকে বড় করে দেখাতে গিয়ে বাস্তব হুমকিটা এভাবে জনগণের নজরের আড়ালেই থেকে যায়। আড়ালে থেকেই তারা আবার সমাজের মধ্যে নতুন অশান্তি সৃষ্টির উৎসাহ পায়। সংস্কৃতি সংস্কৃতি করলেই সাম্প্রদায়িকতা দূর হয় না, তদন্তের মাধ্যমে সত্য যদি প্রতিষ্ঠা না পায়, তাহলে বিচারের নামে যা হবে, তার নাম প্রহসন। বিচারহীনতাই প্রান্তিক ও দুর্বল করে রাখা মানুষের জন্য বিপদের। বিচারহীনতার বিকল্প নিশ্চয়ই সাংস্কৃতিক বটিকা সেবন নয়!

জিনিসপত্রের দাম বাড়লে মজুতদারদের দোষ দেওয়া হয়। কোনো কোনো মিছিল বড় বাজারে গিয়ে স্লোগান দিয়ে আন্দোলনের দায় সেরে আসে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তথা সরকার দূরে বসে হাসে। জ্বালানি তেলের প্রধান ব্যবসায়ী সরকার। তারাই আমদানি করে, তারাই দাম বাড়ায়। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেছেন, এই দাম বাড়ানো হয়েছে আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে।

দাম বাড়ানোর প্রথম সুফল পাবে সরকার। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) বলছে, দাম না বাড়ালে তাদের ১১০০ কোটি টাকা ঘাটতি হয়। ফিরেই আবার তারা বলছে, বিগত বছরে তারা ৪৩ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। তাহলে এই টাকা গেল কোথায়? যে ঘাটতির কথা তারা বলে, সেটাও কিন্তু মুনাফা থেকে ঘাটতি, আসল থেকে নয়। দাম না বাড়িয়ে মুনাফার হার কমানো যেত। তাতে করে মানুষের পেটে-পিঠে মূল্যবৃদ্ধির গোদা পায়ের এমন লাথি পড়ত না।

অথচ আমরা দেখলাম, আন্দোলন-বক্তৃতা হচ্ছে বাসমালিকদের বিরুদ্ধে। কেন তাঁরা বাসভাড়া বাড়ালেন? তাঁদের এই সুযোগ কে করে দিল? আমরা দেখেছি যিনি কিনা মন্ত্রী, তিনিই আবার শ্রমিকনেতা হিসেবে ধর্মঘট ডাকেন। সরকারের এক হাত (মন্ত্রী হিসেবে) আরেক হাতে (শ্রমিকনেতা হিসেবে) তালি দিচ্ছে, মাঝখানে পাবলিক ভুগছে। কিন্তু সরাসরি সরকারের এমন অন্যায্য ও নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তকে দায়ী করার চেয়ে বাসমালিকদের গালি দেওয়াতেই যেন বেশি আরামের!

ধনিক শ্রেণির কেলেঙ্কারি বেশি মানুষের নজর টানে। সে রকম এক ধনীর দুলালের বিরুদ্ধে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের অভিযোগ ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে বনানী থানায় মামলা হয়। অভিযোগটি আরও ভিত্তি পায় অভিযুক্ত যুবক ও তাঁর বন্ধুদের আরও সব কীর্তির ছবি ও ভিডিও প্রকাশ হয়ে পড়ায়। সাড়ে চার বছর পর সেই আলোচিত মামলার রায়ে আসামিরা খালাস পায়। যে প্রক্রিয়ায় তাঁরা খালাস পেলেন, সেটাই আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত ছিল।

অভিযোগ রয়েছে অনেক যে অর্থ ও ক্ষমতার জোরে অনেকেই আইনের ফাঁক গলে ছাড় পেয়ে যান। সেই ফাঁক কারা, কীভাবে সৃষ্টি করে, সেখানে টাকার জোর আর রাজনৈতিক ক্ষমতার জোর কাজ করেছে কি না, সেদিকে প্রতিবাদীদের দৃষ্টি গেল কম। তাঁরা প্রধান ইস্যু করলেন ওই মামলার রায়দানকারী বিচারকের একটি অগ্রহণযোগ্য উক্তিকে। মামলার বাদীদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি তিনি বলেন, ৭২ ঘণ্টার পরে এলে ধর্ষণের মামলা যাতে না নেওয়া হয়। এটা কোনো আইন বা বিধি নয়, একজন বিচারকের মন্তব্যমাত্র।

এমন মন্তব্যের অবশ্যই প্রতিবাদ হওয়া উচিত। ইতিমধ্যে আইন মন্ত্রণালয় ধর্ষণের শিকার নারীদের চরিত্র হননের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, মাননীয় প্রধান বিচারপতি বিতর্কিত বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহারও করেছেন। বলা যায়, আন্দোলনকারীদের দাবি মিটে গেছে। তাহলেই কি শেষ? অভিযোগকারী দুই তরুণী কি মিথ্যাবাদী ছিল? পাঁচ আসামি সেদিন রেইনট্রি হোটেলে কোনো অপরাধ করেননি? আসামিদের বিপক্ষের সব সাক্ষীকে কি আদালতে হাজির করা গিয়েছিল? না, যায়নি। বাদী ও তাঁর পক্ষের সাক্ষীরা কি ভয়ভীতিমুক্ত ছিলেন? না, তাঁরা তা ছিলেন না।

মামলা চলাকালে তাঁদের ওপর চাপ প্রয়োগের কথা এসেছে। তা ছাড়া আসামিদের স্বীকারোক্তি, প্রকাশিত ভিডিও ও অন্যান্য আলামত বলে, সেই রাতে রেইনট্রি হোটেলে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সুতরাং মূল অপরাধীদের ছেড়ে, তাদের রক্ষকদের হদিস না করে, কেবল বিচারক নিয়ে পড়ে থাকা কি উচিত কাজ হচ্ছে?

আসল সমস্যা ও প্রধান শত্রু চিহ্নিত করতে না পারলে আন্দোলন ব্যর্থ হয়। জনতা সেসবে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সাম্প্রতিক নাগরিক প্রতিবাদগুলি তার চলতি উদাহরণ। গভীরেই যদি যেতে না পারব, তাহলে কীভাবে সমাধানের দেখা পাব?

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.com