সুদের হার ও খেলাপি ঋণ

বছরের প্রথম থেকে বাড়তে থাকা ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের হার নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক, সমালোচনা ও অসন্তোষ যখন সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়, সেই পরিস্থিতিতে ১ জুলাই ২০১৮ থেকে ঋণ ও আমানতের ওপর সুদের হার যথাক্রমে ৯ ও ৬ শতাংশ নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন বিএবি। এই নিম্নমুখী সুদের হার নির্ধারণের আগে অবশ্য বহু কিছু ঘটে গেছে। ব্যাংকগুলোর নগদ সংরক্ষণের হার ১ শতাংশ কমানো, বেসরকারি ব্যাংকে সরকারি তহবিলের ৫০ শতাংশ রাখার অনুমতি—এসব পদক্ষেপের পরও বিএবির তরফ থেকে প্রতিশ্রুত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সুদের হার কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। বস্তুত একটা মুক্তবাজারে যে সুদের হার এভাবে সময় বেঁধে দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না, সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সবশেষে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকের মুনাফার ওপর করপোরেট করহারে ২ দশমিক ৫ শতাংশ ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করার পর সুদের হার কমানোর একটা মরিয়া প্রয়াস হিসেবে ব্যাংক পরিচালকদের সংগঠন থেকে এই ঘোষণা আসে।

এভাবে সুদের হার নির্ধারণের প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ, সুদের হার প্রধানত নির্ভর করে ঋণের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। এই ধারণার পক্ষে যে সহজ উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে, সেটা হচ্ছে বিগত বছরগুলোর ক্রমনিম্নমুখী সুদের হার। সে সময় সুদের হারের নিম্নগতির পেছনে ছিল না কারও নির্দেশ, সিদ্ধান্ত বা প্রণোদনা। বাজারের স্বাভাবিক গতি তথা তারল্যের অবাধ সরবরাহই তখন সুদের হারকে ক্রমাগত নিচে ঠেলে দিচ্ছিল। এমনকি সুদের হার এমন পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল যে মহলবিশেষ থেকে সাধারণ সঞ্চয়কারীদের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছিল। কারণ, যাঁরা কেবল আমানতের সুদের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল, সেই সব মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ এবং অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের তখন সমূহ বিপদ।

সুদের হারের এই নিম্নহারের কারণে আয়প্রবাহে ধস নামা রোধ করার জন্য, বিশেষ করে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ করে তাদের মুনাফার প্রবৃদ্ধি সমুন্নত রাখার প্রক্রিয়া শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, ২০১৬ অর্থবছরের প্রথমে যেখানে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ শতাংশ, সেখানে পরবর্তী অর্থবছরের শেষে হয় ১৬ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা ২০১৭ সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে এসে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬ শতাংশে। ঋণের এই প্রবৃদ্ধি আমানতের প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গিয়ে ব্যাংকগুলোর একসময়কার তারল্য স্বস্তির অবসান ঘটায়। ডিসেম্বর ২০১৬-তে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ, সেটি মার্চ ২০১৭-তে ১২ দশমিক ২১ শতাংশ আর জুলাই ২০১৭-তে নেমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশে। অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ঘাটতির সঙ্গে যুক্ত হয় সে সময়ের নিম্ন রেমিট্যান্স প্রবাহ। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে দাঁড়ায় ৮৫ কোটি ডলারে, এক বছর আগে যা ছিল ১০৬ কোটি ডলার। রেমিট্যান্সের মাসওয়ারি এই চিত্র ছিল বিগত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

নিম্ন সুদের হারের কারণে আয়ের ঘাটতি পুষিয়ে নিতে ব্যাংকগুলোর আমানতের সঙ্গে সংগতিহীন ঋণবৃদ্ধি এবং আমদানি করা মূলধনি যন্ত্রপাতির বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের কারণে একসময় বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর পক্ষে ঋণ আমানত অনুপাতের সহনীয় মাত্রা বজায় রাখা দুষ্কর হয়ে পড়ে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক-নির্ধারিত হার লঙ্ঘন বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকের প্রায় নৈমিত্তিক একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ঋণদান কার্যক্রমে লাগাম টানার জন্য ব্যাংকগুলোর ঋণ আমানত অনুপাত চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শেষে (এডিআর) ৮৫ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশে নির্ধারণ করে তা জুনের মধ্যে কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও বাজারের বাস্তবতা বিবেচনা করে পরবর্তী সময়ে সেই সীমা ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রলম্বিত করা হয়েছে।

এ রকম পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ করে এডিআর নির্ধারিত সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে উদ্যোগী হয়। কারণ, এই অনুপাত কমানোর জন্য বিতরণকৃত ঋণ দ্রুত ফেরত আনা অসম্ভব। ফলে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করাই ছিল ব্যাংকগুলোর জন্য সহজ পন্থা।

বহুল আলোচিত উচ্চ সুদের হার কমানোর প্রয়াসে অবশেষে বিএবি সুদের হারের একটা হার নির্দেশ করেছে, যাকে ব্যঙ্গার্থে কেউ নয়ছয় বলে অভিহিত করছেন। ঋণের ওপর ৯ এবং আমানতের ওপর ৬ শতাংশ সুদের যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট বিভ্রান্তি। কারণ, এই দুই হার ঋণ বা আমানতের একক হার হতে পারে না। অতীতেও একক হার কখনোই ছিল না। দ্বিতীয় আরেকটা বিষয় সাধারণ মানুষের কাছে পরিষ্কার করা দরকার যে জুলাই মাসের ১ তারিখ থেকে সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ কিংবা আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সুদের হার কমানোর এ প্রক্রিয়া শাস্ত্রসম্মত না হলেও বর্তমান ব্যবস্থায় পর্যায়ক্রমেই তা কার্যকর করতে হবে। তার কালপরিধি কত বা কেমন হবে, সেটি এখনই আগাম বলে দেওয়া যাচ্ছে না।

ঋণের ওপর সুদের উচ্চ হার নিয়ে অভিযোগ কেবল আমাদের দেশে নয়, সব দেশেই এটা খুব সাধারণ অভিযোগ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সাংবাৎসরিক মুনাফার প্রবৃদ্ধি সমুন্নত রাখতে হলে সুদের হার ধরে রাখা কিংবা নিম্নমুখী হারের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে উচ্চ হার আরোপ করার বিকল্প পথ থাকলেও তা সীমিত ও অনিশ্চিত। এই বিকল্প পথ হচ্ছে ঋণ বৃদ্ধি, সেটি হতে পারে চাহিদা সাপেক্ষে বর্তমান গ্রহীতাদের মধ্যে কিংবা সম্পূর্ণ নতুন গ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ বিতরণ। এর মধ্যে শেষোক্তটি ঝুঁকি বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত কম নিরাপদ। সুতরাং সবচেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে বর্তমান গ্রহীতাদের সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু সেটিও সহজ নয়। কারণ, সে ক্ষেত্রে গ্রাহক বাজারের প্রতিযোগিতামূলক সুদের সুযোগ নিয়ে বিকল্প ঋণদাতা ব্যাংকের শরণাপন্ন হতে পারে। তাই ব্যাংকগুলো সুদের হার কমাতে না পারলেও বিভিন্ন কমিশনের নামে বাড়তি মাশুল আদায় করার চেষ্টা করে। এই প্রবণতার বিরুদ্ধেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় প্রায়ই উপেক্ষা করা হয় যে ঋণের ওপর উচ্চ সুদের হারের অনেকগুলো নিয়ামকের মধ্যে খেলাপি ঋণও একটি প্রধান নিয়ামক। কারণ, ব্যাংকগুলোর পক্ষে বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি রক্ষা করার পর খেলাপি ঋণের ক্ষতি হজম করে নিজেদের মুনাফা সমুন্নত রাখার জন্য বাড়তি হারে সুদ আরোপ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। ঠিক এই জায়গায় এসে দুটো পরস্পরবিরোধী ধারণার মুখোমুখি হয়। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদ আরোপ করতে বাধ্য হয়, নাকি উচ্চ সুদের কারণে গ্রহীতারা খেলাপি হয়ে যান। দেখা যাচ্ছে, উচ্চ খেলাপি ঋণের সঠিক কারণ খুঁজে বের করার জন্য আমাদের দীর্ঘ বিতর্কে লিপ্ত হতে হবে। কারণ, সুদের হার কেবল ব্যাংকিং খাতের জন্য নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

বিনিয়োগ এবং ব্যবসায়িক কিংবা শিল্পায়নে অর্থায়ন নিয়ে সুদের হারের যে একপেশে যুক্তিটি দেওয়া হয়, সেটি হচ্ছে এ রকম, উচ্চ সুদের কারণে ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা কমে যায়, যা শেষাবধি গ্রহীতাকে খেলাপিতে পরিণত করে। কারণ, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে কিংবা মুদ্রাস্ফীতির
হার বেশি হলে ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়িয়ে এ ধরনের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার কমালে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও কমাতে উদ্বুদ্ধ হয়। আমাদের মানতে হবে যে সুদ হচ্ছে ঋণ গ্রহীতার প্রদেয় মূল্য। একটা আদর্শ বাজার অর্থনীতিতে ঋণের এই মূল্য নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক-উদ্বেগ থাকে না। ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণের ওপর সুদই হচ্ছে আয়ের মূল উৎস। অথচ এই ঋণদান বাণিজ্য ব্যাংকের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম। সুতরাং উচ্চ খেলাপি ঋণের হার ব্যাংকগুলোর মুনাফা অর্জনের মূল প্রতিবন্ধক।

এত সবকিছু ডিঙিয়ে ব্যাংকগুলোকে মুনাফা করতে হয়, আবার জনকল্যাণ তথা আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে হয়, অর্থনীতিতে বাণিজ্য এবং শিল্পায়নের চালিকা শক্তি হিসেবেও ভূমিকা রাখতে হয়। সুদ আয় যেহেতু ব্যাংকের আয়ের মূল উৎস, সেটি নির্ধারণে বহুবিধ নিয়ামক কাজ করে, সেই সুদহার আবার অর্থনীতির গতিরও অন্যতম একটি নিয়ামক, সেটির বিষয়ে ত্বরিত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না, তাকে বাজারের শক্তির ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত। কারণ, একটা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে গ্রহণযোগ্য সুদহার না থাকলে ব্যাংকই তার ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হবে।

ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার
fmainuddin@hotmail.com